Wednesday, 10 October 2012

জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তা : খরা সহনশীল ধান

জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তা : খরা সহনশীল ধান
ড. এম. জি. নিয়োগী*

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা খরাপ্রবণ অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। এই মুহূর্তে ১ মিলিয়ন হেক্টরের বেশি জমি ইতোমধ্যেই খরাকবলিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে এবং তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।  অসময়ে বৃষ্টিপাত এবং বিলম্বিত বর্ষার কারণে কৃষকরা উপযুক্ত সময়ে আমন ধানের চারা রোপণ করতে পারছে না। আবার অঙ্গজ বৃদ্ধির পর্যায়ে বা ফুল আসার সময়ে অথবা দানা বাধার সময়ে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি না হলে ধানের ফলন আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। খরার মাত্রা বেশি হলে অনেক সময় সম্পূর্ণ ফসলই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এই প্রতিকূল অবস্থার সাথে খাপ খেয়ে কাঙ্ক্ষিত মানের ফসল চাষাবাদ করতে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) সহায়তায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ব্রি ধান ৫৬ নামে একটি খরাসহিষ্ণু স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। ইরি ও ব্রির সহায়তায় স্ট্রাসার বিভিন্ন প্রকল্পে আরডিআরএসসহ বিভিন্ন সংস্থা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে খরাপ্রবণ অঞ্চলে গত দুই মৌসুম ধরে এই জাতটির খরাসহিষ্ণুতা পর্যবেক্ষণ করেছে এবং কৃষকের মাঠে নতুন উদ্ভাবিত এই জাতটির গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণিত হয়েছে। প্রচলিত জাতের আমন ধান মাটির প্রকারভেদে যেখানে ৮-১২ দিনের বেশি খরা সহ্য করতে পারে না, সেখানে ব্রি ধান৫৬ জাতটি ২৭ দিন পর্যন্ত খরা সহ্য করতে পারে। তাই খরাতে যখন কৃষকের ফসল নষ্ট হচ্ছে, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাবলয় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে এই আবিষ্কার আমাদের স্বস্তি দিচ্ছে। এই জাতটি বীজ বপনের ১১০-১১৫ দিনের মধ্যেই কাটা যায়। সে কারণে কৃষক কার্তিক মাসের আকালের সময়ে এই ধান ঘরে তুলতে পারবে। এই ফসলের আরেকটি গুণ হলো- কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে পোকা-মাকড়ের উপদ্রব শুরু হওয়ার আগেই ধান কেটে ফেলা যায়। এতে কৃষক কীটনাশক প্রয়োগের খরচ থেকে রেহাই পায়, যা পরিবেশ সহায়ক। এছাড়াও কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে খরার কবলে পড়ার আগেই যেহেতু এ ধান পেকে যায়, সে কারণে সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হয় না। তাই বাড়তি খরচ থেকেও কৃষক অব্যাহতি পায়। কৃষকের মাঠে খরা মোকাবেলায় অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত ধানের এই জাতটি (লাইন নম্বর আই আর ৭৪৩৭১-৭০-১-১) ভারতে ২০০৯ সনে শাহবাগী ধান এবং ২০১০ সনে নেপালে সুকা ধান ৩ নামে অনুমোদন পায়, যা এখন ভারত ও নেপালের খরাপ্রবণ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় বীজ বোর্ড ২০১১ সনে ব্রি ধান৫৬ নামে এই জাতটিকে অনুমোদন দেয়। বাংলাদেশের কৃষক খরাপ্রবণ অঞ্চলে আমন মৌসুমে এখন এই জাতের ধান চাষাবাদ করে কাঙ্ক্ষিত মানের ফসল ঘরে তুলতে পারবে। 

খরাসহিষ্ণু জাতের বৈশিষ্ট্য
ব্রি ধান৫৬ একটি খরা সহনশীল উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান। এই ধান গাছের উচ্চতা ১১৫ সেমি.। এর জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন। ধানের ছড়ার দৈর্ঘ্য ২২.১-২৫.৪ সেমি.। ১০০০ ধানের ওজন প্রায় ২৩.৬ গ্রাম এবং ধানে চালের পরিমাণ ৬৪.৭%। পাকা ধানের রঙ একটু লালচে এবং চালের আকৃতি লম্বাটে ও মোটা। রান্না করা ভাত ঝরঝরে এবং খেতে সুস্বাদু। খরা না হলে এবং উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে স্বাভাবিক অবস্থায় হেক্টরপ্রতি ৫ টন ফলন পাওয়া যায়। তবে খরার মাত্রা বেশি হলে ফলন কিছুটা কমে যেতে পারে। আষাঢ় মাসের ১৫ তারিখে বীজ বপন করে কার্তিক মাসের প্রথম সপ্তাহে এই জাতের ধান কাটা যাবে। ব্রি ধান৫৬ এর জীবনকাল বিনা ধান ৭ এবং ব্রি ধান ৩৩ এর চেয়েও কম। এজন্য আমন মৌসুমে এই ধান কেটে গম, আলু ও বিভিন্ন রবিশস্য অনায়াসে সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে। প্রজনন পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১৪-২১ দিন বৃষ্টি না হলেও ফসলের তেমন কোন ক্ষতি হবে না। সেক্ষেত্রে ফলন একটু কমে যাবে। তিন থেকে চার সপ্তাহ বৃষ্টি না হলে, ভূগর্ভস্থ পানির গভীরতা ৭০-৮০ সেমি. নিচে থাকলে এবং মাটির আর্দ্রতা ২০% হলেও এ জাতটি হেক্টরে সর্বোচ্চ ৪.০ টন ফলন দিতে সক্ষম।

খরাসহনশীল ধান উৎপাদন কলাকৌশল
সাধারণত খরাপ্রবণ এলাকায় এই ধরনের খরাসহিষ্ণু ধানের চাষ করতে কৃষকদের উৎসাহিত করা হয়। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই খরাজনিত সমস্যায় আমন ধান চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে কারণে ব্রি ধান৫৬ জাতের ধান চাষ বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই আমন মৌসুমে করা যেতে পারে। বিশেষ করে যেসব জমিতে রবিশস্যের চাষ করা হয়, যেসব জমিতে আমন মৌসুমে ব্রি ধান৫৬ জাতের ধান চাষ করা উচিত। এতে কৃষক খরার সময়েও আমন ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন পাবেন। আবার পরবর্তী রবি ফসল সঠিক সময়ে চাষ করে বেশি ফলন ঘরে তুলতে পারবেন।

বেলে দো-আঁশ এবং এটেল দো-আঁশ জমি ব্রি ধান৫৬ চাষের জন্য উপযোগী। উঁচু এবং মাঝারি উঁচু জমিতেও এই ধান চাষ করা যেতে পারে। ভারি, পুষ্ট ও রোগবালাই মুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। বপনের আগে বীজ শোধন করা ভালো। হেক্টরপ্রতি ২৫-৩০ কেজি বা বিঘাপ্রতি ৩.০-৩.৫ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। এক কেজি বীজ শোধনের জন্য তিন গ্রাম ব্যাভিস্টিন ওষুধ এক লিটার পানিতে মিশিয়ে সারা রাত ভিজিয়ে রাখলে বীজ শোধন হয়। এক শতক (৪০ বর্গমিটার) পরিমাণ বীজতলায় ৩.৫-৪.০ কেজি বীজ বপন করা যায়। এরূপ ১ শতক বীজতলার চারা দিয়ে প্রায় ১ বিঘা জমিতে চারা রোপণ করা যাবে। ১ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই অর্থাৎ ১৫ আষাঢ় থেকে ৩১ আষাঢ়ের মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন করা যাবে। দোঁআশ ও এটেল মাটি বীজতলার জন্য ভালো। বীজতলার জমি অর্নুবর হলে প্রতি শতাংশ জমিতে ২ মণ পঁচা গোবর সার দিয়ে বীজতলা উর্বর করতে হবে। এরপর ৩ মিটার লম্বা ও ১ মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে। দুই বেডের মাঝখানে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে যা বীজতলায় পানি দিতে এবং প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশনের জন্য সহজ হয়। জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উফশী রোপা আমন জাতের মতোই। জমি চাষে হেক্টরপ্রতি ৩ থেকে ৫ টন পরিমাণ জৈব সার (গোবর সার বা পচা আর্বজনা) দিলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ অর্থাৎ শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ২০-২২ দিনের চারা রোপণ করতে হবে। যেহেতু এই ধান স্বল্পমেয়াদি, তাই ২০-২২ দিনের বেশি বয়সের চারা রোপণ করলে ফলন কম হবে। প্রতি গুছিতে ২-৩টি চারা রোপণ করা উত্তম। বেশি গভীরতায় চারা রোপণ করলে চারার বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং কুশির সংখ্যাও কমে যায়। সারিবদ্ধভাবে চারা রোপণ করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেমি. এবং প্রতি সারিতে চারা থেকে চারার দূরত্ব ১৫ সেমি. বজায় রাখতে হবে। তবে মাটির উর্বরতা ভেদে চারা রোপণের দূরত্ব কমবেশি করা যেতে পারে। সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করলে প্রত্যেক গাছ সমানভাবে আলো, বাতাস ও সার গ্রহণের সুবিধা পাবে।

মাটি পরীক্ষা করে অনুমোদিত পন্থায় সার প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। পরীক্ষা করা সম্ভব না হলে ব্রি ধান৫৬ এর চাষাবাদে স্বল্পমেয়াদি ধানচাষের মতো প্রতি হেক্টরে  ইউরিয়া ১৭০ কেজি, টিএসপি ৫৬ কেজি, এমপি ১০০ কেজি, জিপসাম ১০০ কেজি, দস্তা ১০ কেজি সার দেয়া যেতে পারে। সর্বশেষ জমি প্রস্তুতের সময় সবটুকু টিএসপি, অর্ধেক পটাশ সার, অর্ধেক জিপসাম এবং অর্ধেক জিংক সালফেট সার একসাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার সমান দুই কিস্তিতে অর্থাৎ রোপণের ১০ দিন পর ১ম কিস্তি, ২০-২৫ দিন পর ২য় কিস্তি প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক পটাশ সার ২য় বার ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক জিংক সালফেট ১ম কিস্তি ইউরিয়ার সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। সালফারের অভাব পরিলক্ষিত হলে জিপসাম ইউরিয়ার মতো উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগের সময় জমিতে যেন ২-৩ সেন্টিমিটার পানি থাকে। ইউরিয়া প্রয়োগের সাথে সাথে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে যাতে সার মাটিতে ভালোভাবে মিশে যায়। দ্বিতীয়বার ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগের সময় জমি থেকে আগাছা পরিষ্কার করে সারকে কাঁদার সাথে মিশিয়ে দিলে ধানগাছ ভালোভাবে সার গ্রহণ করতে পারবে। চারা রোপণের প্রথম ৪০ দিন পর্যন্ত জমিকে আগাছামুক্ত রাখলে পরবর্তীতে সাধারণত আর আগাছা হয় না। আগাছানাশক দিয়েও জমিকে আগাছামুক্ত রাখা যায়। এজন্য চারা রোপণের ৩-৫ দিনের মধ্যে জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় হেক্টরপ্রতি ৮০০ গ্রাম পেটিলাক্লোর অথবা হেক্টরপ্রতি ২০ গ্রাম পাইরাজোসালফিউরোন ইথাইল প্রয়োগ করতে হবে।

ধানের জমির বিভিন্ন স্থানে বাঁশের কঞ্চি পুঁতে দিয়ে পাখি বসার ব্যবস্থা করে দিলে পাখি পোকামাকড় খেয়ে জমিতে পোকামাকড়ের উপদ্রব কমাতে পারে। ধান গাছে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ বেশি হলে উপযুক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। ব্রি ধান৫৬ এ রোগবালাই ও পোকা মাকড়ের আক্রমণ প্রচলিত জাত বি আর১১ এর চেয়ে অনেক কম হয়। প্রাথমিক প্রতিরোধের জন্য ১ম কিস্তি ইউরিয়ার সাথে বিঘাপ্রতি ২ কেজি ফুরাডান অথবা ২ কেজি ৫ জি পেট্রিয়ট জাতের দানাদার কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। ব্রি ধান৫৬ ব্লাস্ট, ব্যাক্টরিয়াল লিফ ব্লাইট (পাতা ঝলসানো) ও মাজরা পোকার আক্রমণে মাঝারি সহ্য ক্ষমতা সমপন্ন। এই ধানে খোল পচা রোগ (সীথ ব্লাইট) অনেক কম দেখা যায়। প্রধান প্রধান ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করতে পারলে এই ধান চাষাবাদে শতকরা ২৫ ভাগ ফলন বেশি হতে পারে। দানাদার কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১-২ ইঞ্চি দাঁড়ানো পানি থাকা প্রয়োজন। জমিতে পাতা পোড়া রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ বন্ধ করে দিতে হবে। জমি থেকে পানি সরিয়ে শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিয়ে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার দিলে পাতা পোড়া রোগের প্রকোপ কিছুটা কম হবে। জমিতে খোল পচা রোগের প্রকোপ খুব বেশি হলে ‘কনটাফ’ (হেঙা কোনাজল) বা টিল্ট (প্রপিকোনাজল) স্প্রে করা যেতে পারে। প্রথম স্প্রে করার ৭ দিন পর ২য় বার স্প্রে করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। জমিতে বৱাস্ট রোগ দেখা গেলে চারা লাগানোর ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর প্রতি বিঘায় ৫০ গ্রাম ‘ট্রোপার’ প্রয়োগ করা যেতে পারে।

সাধারণত বীজ বপনের ১১০-১১৫ দিনের মধ্যে এই ধান পেকে যায়। ৮০ ভাগ ধান পেকে গেলে ধান কেটে ফেলা উচিত। ধানের বীজ সংগ্রহের জন্য ফসল কাটার আগে জমি থেকে আগাছা এবং অন্য ধানের জাত তুলে ফেলতে হবে। এরপর বীজ হিসেবে ফসল কেটে আলাদাভাবে মাড়াই, ঝাড়াই ও ভালোভাবে রৌদ্রে শুকাতে হবে, যাতে আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। তারপর পুষ্ট ধান বাছাই করে পৱাস্টিক ড্রাম বা কেরোসিনের টিন ভালোভাবে পরিষ্কার করে শুকিয়ে রোদে শুকানো বীজ ঠাণ্ডা করে পাত্রে রাখতে হবে। পাত্রের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যেন বাতাস ঢুকতে না পারে। পাত্র মাটির মটকা বা কলসি হলে গায়ে আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। পাত্র মাচায় রাখা ভালো। মাটিতে রাখলে লক্ষ রাখতে হবে যেন পাত্রের তলা মাটির সংস্পর্শে না আসে। পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ১ মণ ধানে আনুমানিক ১৫০ গ্রাম নিম বা নিশিন্দা অথবা বিষ কাটালির পাতা সুঁড়া করে মিশিয়ে দিয়ে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। ঠিকমতো চাষাবাদ করলে হেক্টরপ্রতি ৫ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

সতর্কতা : এই ধানগাছ শুষ্কতা সহ্য করতে পারে, কিন্তু ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না। সেজন্য এই ধানের জাত দেরিতে রোপণ করা যাবে না এবং কোন অবস্থাতেই বোরো মৌসুমে এই ধান চাষাবাদ করা যাবে না।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষকদের মাঝে খরা সহনশীল ধানের বিস্তারে ইউএসএইডের সহায়তায় আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজ করছে। এই কার্যক্রমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্থানীয় এনজিও ও বিভিন্ন বীজ কোম্পানি কাজ করছে। সংশিৱষ্ট সংস্থাগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের খরাঞ্চলে এই প্রযুক্তি দ্র্বত ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষক খরার হাত থেকে তার আমন ধান বাঁচাতে পারবে। পাশাপাশি ধান উৎপাদনের খরচ কমিয়ে কৃষক স্বাবলম্বী হতে পারবে এবং পরিবেশকে অনুকূল রাখতে পারবে। এছাড়াও পরবর্তী রবি ফসল সঠিক সময়ে চাষাবাদ করে অধিক ফলন ঘরে তুলতে পারে। সর্বোপরি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অক্ষুন্ন থাকবে।
সারের মাত্রা জানতে ইন্টারনেট ব্যবহার করুন
কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ*
 
আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডসহ উন্নত দেশের কৃষকরা কৃষির যেকোনো সমস্যা নিজেরাই ঘরে বসে ওয়েবসাইট বা সফটওয়্যার বা অনলাইন থেকে সংগ্রহ করে সমাধান করে। তারা ঘরে বসে কম্পিউটার ও কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে তার জমির ফসলের অবস্থা দেখে। উড়োজাহাজ দিয়ে জমিতে বীজ বপন, সার, সেচ ও কীটনাশক প্রয়োগ করে। আমাদের দেশের কৃষকভাইয়েরা কি ওয়েবসাইট থেকে তার জমির ফসলের সারের পরিমাণ সংগ্রহ করতে পারবেন? দেশের কৃষকরা কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট ইত্যাদি কিছুই বুঝেন না। অধিকাংশ কৃষক বাংলা ইংরেজি পড়তে পারেন না।

২০০টি উপজেলায় বিভিন্ন ফসলের সুষম সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি ওয়েবসাইটে আছে। এর মাধ্যমে সহজেই কৃষক সারের মাত্রা জেনে সার প্রয়োগ করলে দেশে উৎপাদন বাড়বে। এতে সারের অপচয়ও রোধ হবে। কৃষকরা উপজেলার ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে এসে উদ্যোক্তাদের সহায়তায় সহজেই তার জমির সারের মাত্রা জানতে পারছেন। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লৰ্যে কৃষকের দোরগোড়ায় অনলাইনের সুবিধা পৌঁছানোর এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) অনলাইন থেকে জমির ফসলের সারের পরিমাণ জানার বিষয়ে ইউনিয়ন উদ্যোক্তা ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। মাটি পরিক্ষা করে সার প্রয়োগ করলে সারের অপচয় রোধ হয়, মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে, সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়, উৎপাদন বাড়ে ও উৎপাদন খরচ কমে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাটি পরিক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে ধানের ফলন গড়ে শতকরা ২০-২৫ ভাগ এবং অন্যান্য ফসলে শতকরা ১০-১৫ ভাগ বাড়ে। এতে দেশে খাদ্য শস্যের উৎপাদন ২০ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ২৪ মিলিয়ন টনে উন্নীত হবে।

এসআরডিআই ক্যাটালিস্টের সহযোগিতায় মাটিতে ফসলের সারের চাহিদা নিরূপণের সফটওয়্যার তৈরি করেছে। দেশের প্রায় ২০০টি উপজেলায় মাটি পরিক্ষা করে বিভিন্ন পুষ্টির পরিমাণ নির্ণয় করে বিভিন্ন ফসলের পুষ্টির চাহিদা নিরূপণ করে এই সফটওয়্যার তৈরি করেছে। ইতোমধ্যেই ৩০টি এলাকার প্রায় তিন হাজার কৃষক এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে জমিতে সার প্রয়োগ করে সুফল পেয়েছেন। যেকোনো কোম্পানির অনলাইন সংযোগ নিয়ে www.frs-bd.com অথবা frs-srdi.gov.com এই লিংকে প্রবেশ করতে হবে।  তারপর ব্যবহারকারী ও পাসওয়ার্ড হিসেবে উভয় স্থানে  srdi দিতে হবে। নতুন পৃষ্ঠা আসবে সেখানে কৃষকের নাম, গ্রাম, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, মাটির ধরন, ফসলের ধরন (শস্য/আঁশ/ডাল/ সবজি/ মসলা ইত্যাদি), ফসলের নাম, জমির পরিমাণ (শতাংশে), ভূমির শ্রেণী (উঁচু/ মাঝারি উঁচু/ মাঝারি নিচু/ নিচু/ অতি নিচু) এবং টিএসপি/ ডিএপি/ ইউরিয়া সিলেক্ট করতে হবে এবং সার্চ দিতে হবে। আপনার জমিতে নির্দিষ্ট ফসলে কতটুকু সার দিতে হবে এবং কিভাবে  প্রয়োগ করতে হবে তা বের করে দেবে সফটওয়্যার।

এসআরডিআই-এর প্রশিক্ষণে উপস্থিত কৃষকদের জমির তথ্য দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই উদ্যোক্তারা এভাবে সারের পরিমাণ বের করে দেখান ল্যাপটপ থেকে। এর জন্য কৃষকদের এখন মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের দ্বারস্থ হতে হয় না। উদ্যোক্তরা ল্যাপটপ নিয়ে কৃষকদের বাড়িতে বা জমিতে গিয়ে কৃষিবিষয়ক সেবা দিচ্ছেন। দেশের ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে ২৭টি বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে কৃষকদের সেবা দেয়া হয়। এর মধ্যে কৃষি একটি। এখানে একাধিক ল্যাপটপ, স্ক্যানার, প্রিন্টার, ফটোকপি মেশিন, ডিজিটাল ক্যামেরাসহ তথ্যপ্রযুক্তির যাবতীয় যন্ত্রপাতির ল্যাব আছে। কৃষকরা ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে এসেও সার সুপারিশসহ কৃষির যেকোনো সেবা নিতে পারছেন। কৃষকরা এসব সেবায় বিস্মিত ও অভিভূত।

মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও যেকোনো স্থানে যেকোনো সময় সার চাহিদাসহ কৃষি সমস্যার সমাধান জানা যায়। এসআরডিআই এর সাথে গ্রামীণফোন এবং বাংলালিংক চ্যানেল পার্টনার হিসেবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশ কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাংলালিংকে ৭৬৭৬ নম্বরে ফোন করে মাটির স্বাস্থ্য, সারের মাত্রা, প্রয়োগ পদ্ধতি জানা যায়। এ সেবা দেশের বিভিন্ন গ্রামে অবস্থিত ৩ হাজারের বেশি টেলিসেন্টার থেকেও কৃষকরা পেতে পারেন।  গ্রামীণফোনের কমিউনিটি তথ্য কেন্দ্র থেকেও কৃষক ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশ তথ্য পেতে পারেন। মোবাইল ফোনে জমির ধরন, ফসল, ইউনিয়ন, জেলা ও উপজেলার নাম দিয়ে সার প্রয়োগের পরিমাণ পাওয়া যায়। 

কৃষকরা নিজেরা ইন্টারনেট অপারেট না করতে পারলেও উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে সারের প্রয়োগ মাত্রাসহ কৃষিবিষয়ক যেকোনো সমস্যা ও তথ্য কৃষকরা সহজেই পাচ্ছেন। আশা করি, অচিরেই কৃষকরা নিজেরাই মোবাইল ফোন ব্যবহারের মতো ওয়েবসাইট থেকে ঘরে বসে সারসহ যেকোনো কৃষির তথ্য সংগ্রহ করে   প্রয়োগ করতে পারবেন।