সম্ভাবনাময় এগ্রোহোমিওপ্যাথি
এগ্রোহোমিওপ্যাথি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা
বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা। এ শাখার জন্ম হয়েছে একেবারেই সাম্প্রতিক সময়ে।
নেদারল্যান্ডের বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডা. ভইকুন্থ দাস কভিরাজকে
(যিনি গত মার্চ/২০১৩ মাসে মৃত্যুবরণ করেছেন) এগ্রোহোমিওপ্যাথি ডিসিপ্লিনের
পথ প্রদর্শক মনে করা হয়। ডা. কভিরাজ একবার ভারত সফরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন
এবং দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর সুস্থ না হওয়ায় অবশেষে হোমিপ্যাথি চিকিৎসায়
আরোগ্য লাভ করেন। এ থেকে তিনি এ চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং এ
পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর চিকিৎসার পর উদ্ভিদের
ওপর হোমিওপ্যাথি ওষুধের ক্রিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। সুইজারল্যান্ডে
প্রথমে তিনি আপেল গাছের ওপর গবেষণা শুরু করেন এবং হোমিওপ্যাথি ওষুধ
(এট্রোপা বেলেডোনা) ব্যবহারে আপেলের লাল দাগ দূর করতে সক্ষম হন। ডা.
কভিরাজের লেখা ‘হোমিওপ্যাথি ফর ফার্ম অ্যান্ড গার্ডেন’ ২০০৬ সনে প্রকাশিত
হওয়ার পর এ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা শুরু হয়।
অস্ট্রেলিয়া এবং কিউবার মতো উন্নত দেশে এ বিষয়ে গবেষণায় সুফল পাওয়া গেছে।
আমাদে প্রতিবেশী দেশ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে জিএসআর মুর্থি দীর্ঘদিন এ নিয়ে
গবেষণা করেছেন। পাকিস্তানের ড. ইফতেখার ওয়ারিশ ২০০২ থেকে ২০১০ সন পর্যন্ত
সে দেশের তুলা গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণা করে সফলতা অর্জন করেছেন।
আমাদের দেশে একটি কথা প্রাচীনকাল থেকেই
প্রচলিত আছে ‘যার নাই কোন গতি, সে খায় হোমিওপ্যাথি’। যদিও আগে এ কথাটি
খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু বর্তমানে তা ভালো অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।
মানুষ এখন বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। প্রচলিত চিকিৎসা
পদ্ধতি ব্যবহারে ব্যর্থ হয়ে হোমিপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারে অনেক জটিল
রোগ নিরাময়ের যথেষ্ট নজির আছে। আগে স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তিরাই হোমিপ্যাথি
চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিল। বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতেও এলোপ্যাথি শাস্ত্রে
উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্র চর্চা করে। ফলে এই
চিকিৎসা পদ্ধতি এখন শুধু মানুষের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে পশুপাখি এবং
গাছপালা ও ফসলের ওপর প্রয়োগ হচ্ছে।
হোমিপ্যাথির অন্যতম মূলমন্ত্র হচ্ছে
স্বল্প মাত্রায় শক্তিকৃত ওষুধ প্রয়োগ। বর্তমানে যেভাবে জমিতে নির্বিচারে
রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে দিন দিন জমির ঊর্বরতা শক্তি
হ্রাস পাচ্ছে, মাটির পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
কমে যাচ্ছে এবং পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে?কৃষকের অর্থ ব্যয়
দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে অনেক কৃষক তার দীর্ঘদিনের
কৃষি পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। হোমিপ্যাথি ওষুধ স্বল্প মাত্রায়
ব্যবহারের কারণে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় অনেক কমে যাবে। হোমিওপ্যাথি ওষুধ মানব
বা জীব দেহে শুধু রোগ নিরাময় করে না রোগ প্রতিরোধ ও পুষ্টির জোগান দিয়ে
জীবনী শক্তি বা ভাইটাল ফোর্সকে উজ্জীবিত করে। প্রাণী এবং উদ্ভিদের দৈহিক
গঠন প্রক্রিয়ায় পার্থক্য আছে বটে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিলও আছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রাণী শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অঙিজেন গ্রহণ করে
এবং কার্বন-ডাই-অঙাইড ত্যাগ করে। উদ্ভিদ শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ায়
কার্বন-ডাই-অঙাইড গ্রহণ করে এবং অঙিজেন ত্যাগ করে। তাই প্রাণীর
শ্বাসতন্ত্রের জন্য কার্যকরী ওষুধ উদ্ভিদের ওপর প্রয়োগ করা যায় বলে গবেষণা
দেয়া গেছে। তেমনিভাবে প্রাণী ও উদ্ভিদের মেটাবলিজম প্রক্রিয়া, প্রজনন
প্রক্রিয়া ইত্যাদি অনেক বিষয়ে মিল আছে। এ বাস্তবতা থেকে উদ্ভিদ তথা ফসলের
ওপর হোমিপ্যাথি ওষুধের পরীক্ষা ও প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
এখানে কয়েকটি হোমিপ্যাথিক ওষুধের উদ্ভিদের ওপর ক্রিয়া বর্ণনা করা হল-
১. ফসফরাস : এটি স্বল্প
মাত্রায় শক্তিকৃত অবস্থায় প্রয়োগ করলে মাটির ফসফরাসের অভাব দূর করে। এছাড়া
ফলের দাগ ও পচন, পাতা ঝলসানো রোগ, পাতা শুকিয়ে যাওয়া, জাব পোকার আক্রমণ
ইত্যাদি দূর করে।
২. কার্বোভেজ : চারা
রোপণের পর মরে বা শুকিয়ে যাওয়া, ডালপালা, ভেঙে যাওয়ার পর গাছ শুকিয়ে বা
নষ্ট হয়ে যাওয়ার ত্রুটি নিরাময় করে।?এছাড়া ফাঙ্গাসের আক্রমণ, পাতার কালো
দাগ ও ঝলসানো রোগ দূর করে এবং অপরিপক্ব ফল ঝরে যাওয়া প্রতিরোধ করে।
৩. সাইলিশিয়া : উদ্ভিদের
বৃদ্ধি?কম হলে বা গাছের বৃদ্ধি থেমে গেলে, যথাসময়ে ফুল না এলে, কিংবা কম
এলে, ফুল ঝরে পড়লে এ ওষুধ ব্যবহার করা যায়। গাছের ফুল আসার আগে এটি ব্যবহার
করলে গাছ ফুল ও ফলের পরিমাণ বেড়ে যায়।
৪. সিনা : এটি মানবদেহের
ক্রিমির ওষুধ। উদ্ভিদের বিশেষ করে শিম জাতীয় উদ্ভিদের শিকড়ে ক্রিমির
আক্রমণ হলে এ ওষুধ ব্যবহার করা যায়। এছাড়া এটি উদ্ভিদের ওপর বাংলাদেশ ডিজেল
প্ল্যান্ট (বিডিপি) লি. ব্যাক্টোরিয়া ক্ষতিকর ক্রিয়া নষ্ট করে।
এখানে উদাহরণস্বরূপ মাত্র কয়েকটি
হোমিওপ্যাথিক ওষুধের কার্যকারিতার বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল। এ ধরনের
শতাধিক ওষুধ উদ্ভিদ ও ফসলের ওপর পরীক্ষা করে ইতিবাচক কার্যকারিতা পাওয়া
গেছে এবং পরীক্ষার ফলাফলে ওপর ভিত্তি করে অনেক উন্নত দেশে এর প্রয়োগ ও
গবেষণা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য হোমিওপ্যাথি, এইচপ্যাথি ইত্যাদি
ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ পরিমাণে?খুবই কম প্রয়োগ করতে হয়।
প্রতি লিটার পানিতে ৬ শক্তির মাত্র এক ফোঁটা ওষুধ মিশিয়ে বেশ কিছুক্ষণ
ঝাকিয়ে নিতে হয়। ওষুধ মিশ্রিত পানি ক্ষেত্র মতে ফসলে উপরিপ্রয়োগ বা মাটিতে
প্রয়োগ করা যেতে পারে। এখানে ওষুধ নির্বাচন, ওষুধের শক্তি (পটেন্সি)
নির্বাচন এবং পানির মিশ্রণের ঝাকুনি দেয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি
কৃষি বিজ্ঞানী নই। তাই আমার এ রেখাটি কৃষিবিষয়ক তথ্য সমৃদ্ধ না হওয়াই
স্বাভাবিক। আমার এ লেখার উদ্দেশ্য হল এদেশে কৃষি বিজ্ঞানীদের এ বিষয়ে
গবেষণা ও চিন্তা ভাবনার খোরাক সৃষ্টি করা। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে স্বল্প
ব্যয়ে আমরা যদি মাটির পুষ্টির জোগান দিতে পারি এবং ফসলের রোগ প্রতিরোধ ও
নিরাময় করতে পারি, তাহলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের জন্য অর্থ ব্যয় কমে যাবে
এবং পরিবেশ দূষণ থেকে দেশ রক্ষা পাবে।