কৃষক পর্যায়ে ভেজাল রাসায়নিক সার শনাক্তকরণের সহজ উপায়
ফসলের ভালো ফলন পাওয়া ও জমির উৎপাদনশীলতা ধরে রাখার জন্য সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজন। সুষম মাত্রায় সার ফসলের শুধু অধিক ফলনই নিশ্চিত করে না, জমির স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্যও এর গুর্বত্ব অপরিসীম। কিন্তু এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় বিভিন্নভাবে সারে ভেজাল দিয়ে থাকে। ভেজাল সার ব্যবহার করে কৃষকরা জমিতে সার দেয়ার আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারলেও ফসলের কাঙিৰত ফলন পান না। শুধু তাই নয়, ভেজাল সার জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে, কৃষকরা আর্থিক ও মানসিকভাবে ৰতিগ্রস্ত হন, ভেঙে পড়ে মনোবল ও স্বাস্থ্য, অনীহা আসে কৃষি পেশায়। কিন্তু কৃষকরা একটু সচেতন হলেই মাঠ পর্যায়ে দোকানে সার কেনার সময়ই অনায়াসে ভেজাল বা নিম্নমানের সার কেনা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন। নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বা সামান্য পরীৰার মাধ্যমে ভেজাল রাসায়নিক সার সহজেই শনাক্ত করা যায়। এখানে মাঠ পর্যায়ে যেসব সার পাওয়া যায় সেগুলোর ভেজালের প্রকৃতি ও শনাক্তকরণের সহজ উপায় বর্ণনা করা হলো।
ভেজাল সার বলতে কি বুঝায় : ভেজাল সার বলতে বুঝায় যে, সারের মধ্যে যে পরিমাণ পুষ্টি থাকার কথা সে পরিমাণ না থাকা, সারের মধ্যে অন্য কোনো অপদ্রব্য মেশানো এবং সারের মতো অপদ্রব্যকে সার হিসেবে বিক্রি করা বা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে দোকানে রাখা। ইউরিয়া সার ইউরিয়া সারে ভেজালের প্রকৃতি : ইউরিয়া সারে যেসব ভেজাল দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে মিস ব্রান্ডিং অর্থাৎ এক প্রকার সারের প্যাকেটের মধ্যে অন্য এক প্রকার সার পাওয়া যায়। কোনো কোনো সময় সারের গুঁড়ায় চুন ও লবণের মিশ্রণ দেখা যায়।
ভেজাল ইউরিয়া শনাক্তকরণ পদ্ধতি : একই উৎপাদনকারী কোম্পানির ইউরিয়া সারের দানাগুলোর আকার সাধারণত সমআকৃতির। পরিবহনজনিত কারণে সামান্য উনিশ-বিশ হতে পারে কিন্তু দশ-বিশ হবে না। যদি অনেক ছোট ও বড় আকারের দানা দেখা যায়, তাহলে সামান্য পরিমাণ ছোট ও বড় দানাগুলোকে আলাদা করে নিন। ছোট দানাগুলো জিহ্বার আগায় লাগান। লবণ মিশ্রিত থাকলে লবণের স্বাদ পাওয়া যাবে। এক চা চামচ ইউরিয়ার সাথে দুই চা চামচ পানি মেশালে খুব দ্র্বত সার গলে দ্রবণ তৈরি করবে। এ দ্রবণে হাত দিলে ঠাণ্ডা অনুভূত হবে। সারে চুনের গুঁড়োর মিশ্রণ থাকলে পানি কিছুটা গরম অনুভূত হবে এবং ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হবে। একটি চা চামচে সামান্য পরিমাণ (বড় দানা ৪-৫টি) ইউরিয়া নিয়ে মোমবাতির আগুনে গরম করলে ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাস (আগের রাতে মাংস, মাছ, ডিম খেয়ে সকালে প্রশ্রাবে যে গন্ধ পাওয়া যায়) উৎপন্ন হবে অর্থাৎ সারে যে নাইট্রোজেন আছে তা নিশ্চিত হলো। ছোট দানার ইউরিয়া সারও এভাবে পরীৰা করে নিশ্চিত হবে যে সেটি ইউরিয়া সার। টিএসপি সার টিএসপি সারে ভেজালের
প্রকৃতি : দেখতে প্রায় একই রকম হওয়ায় টিএসপি সারের বস্তায় এসএসপি বা এফএমপি ভর্তি করে বাজারজাত করা হয়। কখনো কখনো?জৈব পাদার্থের সাথে জিপসাম, ডলোমাইট ও কালো রঙ মিশিয়ে সেন্ট্রিফিউজ মেশিনের সাহায্যে ভেজাল টিএসপি সার?তৈরি করা হয়। ভেজাল টিএসপি শনাক্তকরণ পদ্ধতি : সঠিক টিএসপি সারে ঘ্রাণ নিলে অমৱ স্বাদযুক্ত (পেটে গ্যাস্টিক বা গ্যাস হলে মুখ দিয়ে মাঝে মাঝে টকস্বাদের যে গন্ধ পাওয়া যায়) ঝাঁঝালো গন্ধ থাকবে। দুটি বুড়ো আঙুলের নখের মাঝে রেখে চাপ দিলে সহজে ভাঙবে না কিন্তু নকলটি ভেঙে যাবে। টিএসপি সারের বিভিন্ন ভাঙা অংশের রঙ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এক চা চামচ টিএসপি সার আধা গৱাস ঠাণ্ডা পানিতে মেশালে সার সম্পূর্ণ দ্রবীভূত হয়ে ডাবের পানির মতো পরিষ্কার দ্রবণ?তৈরি করবে। ভেজাল থাকলে ঘোলা দ্রবণ?তৈরি করবে। অধিক ভেজাল থাকলে নিচে তলানি পড়বে।
ডিএপি সার ডিএপি সারে ভেজালের প্রকৃতি : ডিএপি সারের বস্তায় নিম্নমানের মিশ্র সার বা এসএসপি বা টিএসপি সার ভর্তি করে বাজারজাত করতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও মাটি ও রঙ দিয়ে?তৈরি দানাদার দ্রব্যকে ডিএপি সার হিসেবে বাজারজাত করা হয়।
ভেজাল ডিএপি শনাক্তকরণ পদ্ধতি : কিছু ডিএপি সার একটি সাদা কাগজের ওপর খোলা অবস্থায় এক ঘণ্টা রেখে দিলে সারের নমুনাটি ভিজে উঠবে। আবার আধমুঠো ডিএপি সার কিছুৰণ হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে রাখলে হাত ভিজে উঠবে এবং ঘ্রাণ নিলে ইউরিয়া সারের গন্ধ পাওয়া যাবে। হাতের তালুতে সামান্য ডিএপি সার নিয়ে তার মধ্যে সামান্য পান খাওয়া চুন মিশিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকলে অ্যামোনিয়ার গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাবে। আধা চামচ ডিএপি সার একটি জলন্ত মোমবাতির শিখায় গরম করতে থাকলে প্রথমে চট্চট্ করে শব্দ হবে, গরম করা অব্যাহত থাকলে সার আস্তে আস্তে গলে বুদবুদ করে ফুটতে থাকবে এবং বুদবুদ করতে করতে শুকিয়ে যাবে, চামচে সামান্য?সাদা আবরণ দেখা যাবে। বুদবুদ উঠার সময় ঘ্রাণ নিলে তীব্র অ্যামোনিয়া গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাবে।
এমওপি সার এমওপি সারে ভেজালের প্রকৃতি : এমওপি সারের সাথে চিকন বালু বা কাচের গুঁড়া বা খাবার লবণের সাথে লাল রঙ মিশিয়ে ভেজাল দেয়া হয়। কখনো কখনো ইটের ছোট ছোট কণা মিশিয়েও এমওপি সারে ভেজাল দেয়া হয়। ম্যাগনেশিয়াম সালফেট সারে লাল রঙ মিশিয়ে ভেজাল এমওপি সার?তৈরি করা হয়। ভেজাল এমওপি শনাক্তকরণ?পদ্ধতি : এমওপি সারের রঙ লাল হলেও এ রঙ হাতে লাগে না। কোন দ্রব্যে?রঙ মেশালে ভিজা হাতে সে রঙ লাগবে।?হাতের তালুতে সামান্য?এমওপি সার নিয়ে তার মধ্যে সামান্য পানি দিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকলে আসল এমওপি সার সম্পূর্ণভাবে গলে যাবে এবং পানি বেশ ঠাণ্ডা অনুভূত হবে। সার গলে যাওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে আসল এমওপি সার আস্তে আস্তে গলে দানাগুলো ছোট হতে থাকলেও লাল রঙ দেখা যাবে। কিন্তু রঙ মিশ্রিত কোনো জিনিস তার মধ্যে থাকলে প্রথমে লাল রঙ উঠে যাবে, পরে ছোট কণায় আর লাল রঙ দেখা যাবে না। বালু, কাচের গুঁড়া মিশ্রিত থাকলে তা মোটেও গলবে না।
জিপসাম সার জিপসাম সারে ভেজালের প্রকৃতি : জিপসাম সারের দাম কম হওয়ায় সাধারণত কোনো ভেজাল দেখা যায় না। তবে ওজন বাড়ানোর জন্য পানি মেশানো হয়। কখনো কখনো চুনের গুঁড়া ও মাটির মিশ্রণ দেখা যায়।
ভেজাল জিপসাম শনাক্তকরণ পদ্ধতি : জিপসাম সার সাদাটে পাউডারের মতো। বাতাসের আর্দ্রতায় এটির গায়ে তুলা তুলাভাব দেখা যায়। গায়ে তুলা তুলাভাব না থাকলে বুঝতে হবে পানি মেশানো হয়েছে অথবা ভেজাল সার।
বোরণ সার বোরণ সারে ভেজালের প্রকৃতি : বরিক এসিডের তুলনায় বোরাঙের দাম কম হওয়ায় বরিক এসিডের প্যাকেটে বোরাঙ ভর্তি করে বিক্রি করা হয়। আবার সুলুবর ও বরিক এসিড দেখতে সাদা বিধায় সাদা রঙের অপেৰাকৃত কম দামি রাসায়নিক পদার্থ যেমন- সোডিয়াম সালফেট বা ক্যালসিয়াম সালফেট (জিপসাম) প্যাকেটজাত করে বরিক এসিড বা সলুবর হিসেবে বাজারজাত করা হয়।
ভেজাল বোরণ শনাক্তকরণ পদ্ধতি : বোরণ সার হালকা মিহি পাউডারের মতো আধা গৱাস পানিতে এক চামচ বরিক এসিড বা সলুবর মিশালে সার সম্পূর্ণভাবে গলে যাবে এবং কোনো তলানি পড়বে না। সলুবর ওজনে হালকা বিধায় বরিক এসিড বা বোরাঙের তুলনায় এর প্যাকেট দ্বিগুণ বড় হয়।
দস্তা সার দস্তা সারে ভেজালের প্রকৃতি : দস্তা সারে অনেক ধরনের ভেজাল দেখা যায়। মনোহাইড্রেড জিংক সালফেট লিখিত প্যাকেটে অপেৰাকৃত কম দামের হেপ্টাহাইড্রেট জিং সালফেট ভরে বাজারজাত করা হয়। হেপ্টাহাইড্রেট জিংক সালফেটে জিংক বা দস্তার পরিমাণ কম থাকে। কখনো কখনো ম্যাগনেশিয়াম সালফেট অথবা খাবার লবণ ও জিপসামের মিশ্রণ অথবা খাবার লবণ ও চুনের মিশ্রণকে জিংক সার হিসেবে বাজারে বিক্রয় করা হয়।
ভেজাল দস্তা শনাক্তকরণ পদ্ধতি : মনোহাইড্রেট জিংক সালফেট দেখতে দানাদার কিন্তু হেপ্টাহাইড্রেট জিংক সালফেট স্ফটিকাকার বা আঁকাবাঁকা। হেপ্টাহাইড্রেট জিংক সার সম্পূর্ণভাবে পানিতে গলে যায় এবং কোনো তলানি পড়ে না। কিন্তু মনোহাইড্রেট জিংক সার পানিতে সম্পূর্ণ গলে না এবং দ্রবণ ঘোলাটে হয়। যে কোনো ধরনের সামান্য দস্তা সার হাতের তালুতে নিয়ে তাতে সামান্য পানি দিয়ে হাতের আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকলে সার গলতে থাকবে এবং হাতের তালুর পানি আস্তে আস্তে গরম হতে থাকবে। পানি যত বেশি গরম হবে বুঝতে হবে ওই সারের নমুনায় তত বেশি দস্তা আছে অর্থাৎ সারটি ভালো দস্তা সার।
ঙ আঞ্চলিক পরিচালক, আইএআইএস প্রকল্প, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী অঞ্চল,
ঙ আঞ্চলিক পরিচালক, আইএআইএস প্রকল্প, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী অঞ্চল,
No comments:
Post a Comment