খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ ও জনস্বাস্থ্য
সময়ের চাহিদা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ও রঙ আমাদের কাছে তার প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়েছে। আবার আসেত্ম আসেত্ম এসব পদার্থ তাদের গুরম্নত্বও হারিয়েছে এর বিষক্রিয়ার কারণে। বাংলাদেশেও আজ ফল, সবজি ও অন্যান্য খাদ্যে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার বাড়ছে। দিন যতই এগোচ্ছে ততই এ দেশে ফলমূল ও শাকসবজির উৎপাদন বেড়ে যাচ্ছে। এতে ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা ধরনের রোগবালাই এবং অনেক সময় পোকামাকড় দ্বারাও এসব ফসল আক্রানত্ম হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড়ের ব্যাপক আক্রমণ দমনের জন্য আজ বাংলাদেশে রাসায়নিক ব্যবহারের প্রচলন হয়েছে। অপরদিকে স্থানভেদে এ দেশের খাদ্যশস্যের বিরাট একটি অংশ অপচয়ের ফলে নষ্টও হয়ে যায়। ফসলের কার্যকর সংরড়্গণ পদ্ধতির অভাব এবং সংরড়্গণের কাজে রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে দেশের প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজির অপচয় হয়। রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো এ বিষাক্ত ফলমূল, শাকসবজি খেয়ে শুধু মানব সমাজই নয়, এ সাথে পশুপাখি, মৎস্য সম্পদ এবং পরিবেশেও ঘটে বিপর্যয়। ফলমূল ও শাকসবজি পাকানোর জন্য রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর পরে এসবের ভেতরের বিষক্রিয়া বাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে এসব ফল ও সবজির রঙের উজ্জ্বলতা বেশি হয়।এ ছাড়া দেশের সবজি চাষিরা তাদের উৎপাদিত সবজির আকার বড় করা এবং সবজি গাছ দ্রম্নত বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক সার ব্যবহার করে থাকেন। শাকসবজি গাছের পোকা দমনের লড়্গ্যে কৃষক ভায়েরা গাছে কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন। বর্তমানে দেখা যায়, বাজারে অনেক সময় বিক্রয়যোগ্য পটল, করলা বাসি হয়ে পড়ে। এসব সবজির রঙ অটুট রাখার জন্য এগুলোর গায়ে রঙ দেয়ার পদ্ধতি বর্তমানে চালু আছে। সাময়িক এই সুবিধা নেয়ার জন্য আজ এই বিষাক্ত কীটনাশক এবং রঙসহ সবজি খেয়ে সবজি ভোগকারীরা বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রানত্ম হয়ে থাকেন। এসব ছাড়াও পোকামাকড় দমনের জন্য শীতকালীন সবজির জমিতে ডায়থেন এম-৪৫, রিমোডিল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত জমিতে এসব কীটনাশক ব্যবহারের পরে ২-৩ সপ্তাহ পর্যনত্ম জমি থেকে ফসল তোলা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকরা সময়সীমা না মেনে শাকসবজি ড়্গেত থেকে তুলে বাজারজাত করে থাকেন। ওষুধ দেয়া এসব সবজি পানি দিয়ে ধুলেও এ থেকে কীটনাশকের সম্পূর্ণ প্রভাব দূর হয় না। এর ফলে ড়্গতিকর কীটনাশকের বেশ কিছুটা মানুষের দেহে প্রবশে করে থাকে। এতে দেহে দ্রম্নত রোগব্যাধিরও জন্ম দিয়ে থাকে।
অনেক লোভী ব্যবসায়ী ড়্গতিকারক শিল্পের রঙ দিয়েই সবজির বর্ণ পরিবর্তন করে, বাসি সবজিকেই তাজা করে রাখে। ছোট ছোট গোল আলুতে বিষাক্ত লাল রঙ মিশিয়ে তা বগুড়ার আলু হিসেবেও বিক্রি করে থাকে। এভাবে ড়্গতিকর রঙ ও রাসায়নিক মানুষের পেটে গেলে শরীরে রোগব্যাধি হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। ফসল চাষাবাদের জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরিবর্তে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির মাধ্যমে পোকামাকড় দমনের ব্যাপারে সবাইকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা প্রয়োজন।
কলা, পেঁপে বাণিজ্যিক কৌশলের মাধ্যমে পাকানো হয়। এসব ফল আমাদের দেশের একটি অন্যতম প্রধান পুষ্টিকর ফল। বর্তমানে এসবের অপুষ্ট ফলকে বাগান থেকে সংগ্রহ করে ব্যবসার প্রয়োজনে এর সঙ্গে নানারকম রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে দ্রম্নত পাকানো হচ্ছে। এ জন্য ফলের পুষ্টিমান ও স্বাদের তারতম্য হচ্ছে। আমের বেলাতেও ব্যবসায়ীরা রাসায়নিক দিয়ে তা বিক্রি করছে। দেখা যায়, ফজলি, আশ্বিনা এসব আম যেহেতু নাবি জাতের আম তাই আগে বাজারে নেয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা এ আম কৃত্রিম উপায়ে পাকানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। কার্বাইড নামে এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে আম পাকানো হয়। এর ফলে এসব আম খেলে অনেক সময় পেটের পীড়াও দেখা দেয়। এরপরে তরমুজ, বাঙি, ডাব এসব ফলের কথাও বলা যায়। তরমুজের মিষ্টতা ও রঙের জন্য কৃত্রিমভাবে সিরিঞ্জের সাহায্যে এসব ফলকে লার রঙ করা ও স্যাকারিন পানিতে মিশিয়ে একে মিষ্টি করা হয়। একইভাবে আজকাল ডাবের ভেতরের পানি ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে বের করে। এরপরে এতে স্যাকারিন মেশানো পানি দিয়ে দেয়া হয়। এ ছাড়া আজকাল আনারস পাকানোর কাজেও বিষাক্ত ‘ইথোপেন’ ব্যবহার করা হয়।
শাকসবজি, ফলমূলসহ বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে দিনে দিনে যে হারে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার হচ্ছে, তা জনস্বাস্থ্যের এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের দেশের সবজি বাগানে এখন সব সময়ই বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব রাসায়নিকের মধ্যে রিপকর্ড, সিমবুশ, হেপটাকোর, থায়াডিন, ডিডিটি বেশি বিপজ্জনক। এসব কীটনাশকের আবার একটা কার্যকালও থাকে। অর্থাৎ প্রয়োগের পরে কোনো কীটনাশকের অপেড়্গমাণ কাল ৩ দিন। কোনোটির ৭ দিন আবার কোনোটির ২১ দিনও হয়ে থাকে। এসব মেয়াদকাল বিবেচনায় এনে আমাদের অবশ্যই কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। আমাদের আরো মনে রাখতে হবে, রাসায়নিক কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের একটি দীর্ঘমেয়াদি ড়্গতি হয়। কোনো জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হলে এবং পরে এসব জমির কীটনাশক মিশ্রিত শাকসবজি বা ফলমূল খেলে মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের রোগও দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও ফসলে এ অতিরিক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করার ফলে পরিবেশের উপকারী যেমন ব্যাঙ ও সাপসহ অন্যান্য পতঙ্গ ভোজী প্রাণী, সরীসৃপ এসবও ধ্বংস হয়। এ ছাড়া জমিতে বালাইনাশক বা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের ফলে তা বৃষ্টির পানিতে মিশে নদীনালা খাল-বিল ও পুকুরে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ওইসব জলাশয়ের মাছের ড়্গতি হয় এবং মাছের প্রজনন ড়্গমতাও হ্রাস পায় এবং পাশাপাশি পরিবেশও হারিয়ে ফেলে তার ভারসাম্য।
এখানে ফলমূল, শাকসবজিতে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের পাশাপাশি মাছ, মাংস এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যেও বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মাছ, গোশত বেশকিছু দিন তাজা রাখার জন্য এর সঙ্গে মেশানো হয়ে থাকে ‘ফরমালিন’। আবার আখের গুড়কে আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করার জন্য গুড়ে মেশানো হয় বিষাক্ত কেমিক্যাল ‘হাইড্রোজ পাউডার’। এ ছাড়া দুধেও মেশানো হচ্ছে অপরিষ্কার পানি এবং এ সঙ্গে ফরমালিনের মতো বিষাক্ত পদার্থ। সয়াবিন অয়েল বা ফার্নেস অয়েলের সঙ্গে বিষাক্ত ‘এলিল আইসোথিয়া সায়ানাইড’ মেশানো হলে তা খাঁটি সরিষার তেলের মতোই রঙ ও ঝাঁঝালো হয়। এসব ভোজ্য তেল ও খাদ্যদ্রব্য জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ড়্গতিকর।
বর্তমানে এ দেশে এসব ড়্গতিকর অবস্থার আইনানুগ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এ জন্য আমাদের দেশে বিভিন্ন সংস্থাও রয়েছে- এর মধ্যে আছে বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তর এসব উলেস্নখযোগ্য। এসব সংস্থাকে দেশের বিভিন্ন কৃষি পণ্য এবং খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে অনুমোদিত রাসায়নিক দ্রব্য নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহারের একটি যথাযথ ব্যবস্থা এবং এর পরিমাণ নির্ধারণ করে দিতে হবে। কোনো রাসায়নিক দ্রব্য মানুষের শারীরিক নিরাপত্তার ড়্গেত্রে কোনো বিপত্তি সৃষ্টি করে কি না তা পরীড়্গিত না হওয়া পর্যনত্ম ঐ রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের উপযোগী হিসেবে অনুমোদন দেয়া ঠিক হবে না।
এ ছাড়া কোন খাদ্যে কোন রাসায়নিক পদার্থ সংরড়্গণ দ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তা ব্যবহারকারীদের জানতে বা জানাতে হবে। এ জন্য এসব সংশিস্নষ্ট সংস্থা কর্তৃক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ কারণে আমাদের অবশ্যই যথাযথ আইনও প্রয়োগ করা প্রয়োজন। তা না হলে খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সবশেষে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে খাবার ব্যবহারকারীদের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা একানত্ম প্রয়োজন। বাংলাদেশের খাবার ব্যবহারকারী বা ভোক্তারা বর্তমানে অবহেলিত। খাদ্যের মান সঠিক অবস্থানে আনা এবং এজন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ, এ সাথে সংশিস্নষ্ট সংস্থা কর্তৃক এ ব্যাপারে বাজার পরীড়্গা করা প্রভৃতি কাজের জন্য সব ধরনের প্রচার মাধ্যমেরও রয়েছে একটি বড় ভূমিকা। এ কাজে কৃষি তথ্য সার্ভিসও অবশ্যই বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশা রাখি।
No comments:
Post a Comment