Pages

Monday, 19 September 2011

ধাপ তৈরি ও চাষাবাদ কৌশল

ধাপ তৈরি ও চাষাবাদ কৌশল

প্রাকৃতিক লীলা বৈচিত্র্যে ভরা আমাদের এই বাংলাদেশ। হাওর, বাঁওড়, বিল, ঝিল এলাকার জমি বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে ডুবে থাকে। এসব নিচু/অতি নিচু এলাকায় পানির ওপরে ভাসমান অবস্থায় কচুরিপানা, খড় বা অন্য কোন উপাদান পচা বা আধাপচা অবস্থায় জড় করে আয়তাকার/চতুর্ভূজাকার/গোলাকার সূপ তৈরি করা হয়। আর এই সূপই ‘ধাপ’ নামে পরিচিত।

প্রেক্ষাপট
হাওর, বাঁওড়সহ অন্যান্য নিচু/অতি নিচু এলাকার জমি বছরের প্রায় অধিকাংশ সময়ই পানিতে ডুবে থাকে। এসব এলাকাগুলোতে বড়জোর রবি শস্য/বোরো ধান চাষাবাদ করা যায়। রবি শস্য/বোরো ধান সংগ্রহ করার পর পরই জমিগুলো পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়। আর এই সময় কৃষক তার অলস সময় কাটায় ঘরে বসে। এই পরিস্তিতিতে কৃষক তার খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারে ধাপে সবজি চাষ করে। অবশ্য ধাপে সবজি চাষ নতুন কিছু নয়। আবহমান কাল থেকেই প্রগতিশীল কৃষকরা সফলতার সাথে ধাপে সবজি চাষ করে আসছে।

ধাপ তৈরির সময়
পানিতে ভাসমান কচুরিপান ও জলজ উদ্ভিদ দিয়ে ধাপ তৈরির সময় হল মধ্য জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত। কোন কোন সময় ওই রকম ধাপ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসেও তৈরি করা হয়। নাড়া ও খড় দিয়ে ধাপ তৈরি করা হয় সাধারণত বোনা আমন আবাদের এলাকায় আমন আবাদের এলাকায় বোনা আমন ধান কাটার পরে।

ধাপ তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ
কচুরিপানা, বিভিন্ন ভাসমান পচা ও আধাপচা জলজ উদ্ভিদ, খড়, নাড়া, ফসলের আগাছা ও আবর্জনা, আখের ছোবড়া, কাঠি, নৌকা, ২/৩টি বাঁশের টুকরা (৩-৪ হাত) অথবা ২/৩টি লম্বাডাল, ঝুড়ি, দড়ি প্রভৃতি।

ধাপের আকার আকৃতি
ধাপ তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণের প্রাপ্তি ধাপে ফসল আবাদের শ্রেণী, ধাপ রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরবর্তীতে অবশিষ্ট পচনকৃত কম্পোস্ট/ জৈব সারের ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে ধাপ সাধারণত গোলাকার, চতুর্ভূজাকার ও আয়তকার হয়ে থাকে। যেহেতু এটি বৈজ্ঞানিক উপায়ে গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি না সেহেতু এর কোন আদর্শ পরিমাপ নেই। তবে স্বাভাবিকভাবে-

(ক)    কচুরিপানা ও অন্যান্য পচা ও আধাপচা জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি ধাপের ক্ষেত্রে :
(১)     চতুর্ভূজাকার ধাপ : দৈর্ঘ্য ৫-১০ মিটার, প্রস্থ ২-৩ মিটর, উচ্চতা ১ মিটার।
(২)     আয়তাকার ধাপ : দৈর্ঘ্য ১০-২০  মিটার, প্রস্থ ২-৩ মিটার, উচ্চতা ১ মিটার।
(৩)     গোলাকার ধাপ : ব্যাসার্ধ ২-৫ মিটার, উচ্চতা ১ মিটার।
(খ)     নাড়া ও খড় দিয়ে তৈরি ধাপের ক্ষেত্রে :

কচুরিপানা ও জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি ধাপের মতোই তবে উচ্চতা বেশি। উচ্চতা সাধারণত ১.৫-২.০ মিটার।
বি: দ্র: ধাপ তৈরি উপাদানের প্রাপ্তি বেশি হলে এর প্রস্থ ঠিক রেখে দৈর্ঘ্য প্রয়োজন মতো বাড়ানো যেতে পারে।।

ধাপ তৈরির পদ্ধতি :
(ক) কচুরিপানা ও অন্যান্য পচা ও আধাপচা জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি ধাপ

(১) বর্ষার পানিতে যখন কচুরিপানাগুলো দ্রম্নত বংশ বিসৱার শুরম্ন করে তখন, অর্থাৎ জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয় কচুরিপান সংগ্রহের কাজ।
(২) প্রয়োজনীয় শ্রমিক কাঙ্ক্ষিত উপকরণ নিয়ে পানিতে ভাসমান কচুরিপানার কাছে যেতে হবে।
(৩) পানির গভীরতার ওপর নির্ভর করে প্রয়োজন হলে নৌকায় করে নির্বাচিত জায়গার ওপর ২/৩ খণ্ড বাঁশের মাঝারি (৩-৪ হাত) টুকরা আড়াআড়ি করে অথবা ২/৩ খানা লম্বা ডাল ফেলতে হবে।
(৪) প্রথমে নিচের দিকে বড় আকারের কচুরিপানা এবং পরে উপরের দিকে ছোট আকারের কচুরিপানা জড় করে স্তূপ তৈরি করতে হবে।
(৫) প্রাথমিকভাবে এক বর্গমিটারের একটি ছোট ধাপ তৈরি করতে হবে। ধাপটির চারপাশে আরো কচুরিপানা দিয়ে স্তূপ করতে হবে যাতে স্তূপের  ওপরে অন্তত ১ জন কৃষক উঠে দাঁড়াতে পারে। পরে চারপাশ থেকে আরো কচুরিপানা লাঠি/কাঠি দিয়ে টেনে টেনে ওই স্তুপের ওপর এবং পাশে ফেলতে হবে।
(৬) এভাবে স্তূপ একটু বড় হলে, ধাপ দ্রুত প্রস্তুত করতে হলে আরো ২/৩ জন কৃষক তার ওপর উঠে কমপক্ষে ২-৩ মিটার চওড়া করে যতদূর সম্ভব ৫-২০ মিটার লম্বা ও ১-১.৫ মিটার উঁচু করে ধাপ তৈরি করতে হবে।
(৭) ধাপ তৈরি শেষের দিকে কচুরিপানাগুলোর শিকড় উপরের দিকে এবং কাণ্ডগুলো নিচের দিকে করে আস্তে আস্তে প্রস্ত থেকে দৈর্ঘ্যের বরাবরে সাজাতে হবে এবং লক্ষ রাখতে হবে উত্তোলিত কচুরিপানার ভেতরে যেন কোন কলমি, মালঞ্চ ও দুর্বা না থাকে।
(৮) প্রস্তুতকৃত ধাপের উপরিভাগ হাত বা কোন কাঠি দিযে সমতল করে দিতে হবে।

(খ) নাড়া ও খড় দিয়ে তৈরি ধাপ
১) প্রয়োজনীয় উপকরণ ও শ্রমিক নিয়ে জমিতে যেতে হবে।
২) যে জায়গায় ধাপ বানাতে হবে সেই জায়গা নির্বাচন করতে হবে।
৩) তারপর থোড়া ও ঝুড়ির সাহায্যে “ক” এর অনুরূপভবে সুন্দর করে সাজিয়ে সাজিয়ে পা দিয়ে পাড়িয়ে ধাপ তৈরি করতে হবে।

আবাদযোগ্য শাক সবজি
একক ফসল হিসেবে হলুদ, লাল শাক, পালং শাক, ঢেঁড়স, শসা, পানিকচু, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, বরবটি, ঝিঙা, মরিচ, করলা, চিচিঙা, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, ফুট ইত্যাদি।

আন্ত:ফসল হিসেবে
১)     মাঝে হলুদ+চারপাশে লাউকুমড়া/শসা
২)     মাঝে (হলুদ+ঢেঁড়স)+তার চারিপার্শ্বে পানিকচু
৩)     হলুদ+ ডাঁটাশাক
৪)     মাঝে ঢেঁড়স+চারপাশে লাউকুমড়া
৫)     মাঝে (পানিকচু+ঢেঁড়স)+ চারপাশে ঝিঙা/ফুট
৬)     মাঝে হলুদ+চারপাশে পানিকচু

বীজ বপনের উপযোগীকরণ ও বীজ বপন
প্রস্তুতকৃত ধাপটি প্রথমে সুবিধাজনক স্থানে রাস্তা বাড়ির কাছে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বীজ বপনের জন্য ধাপ তৈরি শেষে কচুরিপানার শিকড়ের ওপর গোবর ও কাদা মিশিয়ে ২-৩ ইঞ্চি পুরু প্রলেপ দিতে হবে। উল্লেখ, এর সাথে সামান্য ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে কচুরিপানা দ্রুত পচে চাষাযোগ্য হয়। এভাবে ১০-১২ দিন পচানোর পর বীজ বপন করা যায়। গোবার, কাদার পরিবর্তে গত বছরের পুরনো পচা ধাপ কম্পোস্ট স্তূপ ৬-৮ ইঞ্চি পুরু করে দিলে তখনই শাকসবজির বীজ বপন করা যায়। ধাপে জমির তুলনায় ঘনভাবে বীজ বপন করা যায়।

পরিচর্যা
সার : ধাপে সারের তেমন প্রয়োজন হয় না। কারণ ধাপটি একটি উন্নতমানের কম্পোস্টে পরিণত হয়। ফলে শাকসবজি তার প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান ধাপ থেকে গ্রহণ করতে পারে। গোবর গোলা প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। তবে কোনো কারণে গাছের বাড় বাড়তি কম পরিলক্ষিত হলে রোপণের ৪০-৫০ দিন পরে সামান্য ইউরিয়া প্রয়োগ করা যেতে পারে।

পানি : ধাপ পানির উপরে থাকে বলে পানি দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
রোগ : ধাপের রোগবালাই এর আক্রমণ সাধারণত হয় না, হলে একটি পাত্রে ১-২ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম তুঁতে, অন্য একটি পাত্রে ১-২ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম চুন মিশাতে হবে। পরে অন্য একটি পাত্রে চুন ও তুঁতের মিশ্রণ এক সাথে করে (বোর্দোমিক্সার) সঙ্গে সঙ্গে স্প্রে করতে হবে।

পোকামাকড় : পোকামাকড়ের আক্রমণ হয় না বললেই চলে। যদি হয় তাহলে আইপিএম পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
অন্যান্য : ধাপটাকে একটি বড় দড়ি দিয়ে বা কাঠি দিয়ে বেঁধে রাস্তার ধারে বা বাড়ির কাছে রাখতে হবে যাতে বন্যার পানি এটাকে ভাসিয়ে নিতে না পারে। রাস্তার ধারে বা বাড়ির কাছে লাউকুমড়া জাতীয় ফসল আবাদের ক্ষেত্রে মাচা তৈরি করে দিতে হবে। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে উক্ত কোম্পাস্ট ধাপটি সুবিধামতো নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে শীতকালীন শাকসবজি চাষাবাদ করা যায়।
ফসল সংগ্রহ : বীজ বপনের নির্দিষ্ট সময় পর ফসল সংগ্রহ করতে হবে। আন্ত:ফসল ক্ষেত্রে যে ফসল আগে পরিপক্ব বা সংগ্রহ উপযোগী হবে তা আগে সংগ্রহ করতে হবে।

সুবিধা
১।    মাটির লবণাক্ততা ও পানি নিষ্কাশন সমস্যা দূর করা যায়।
২।    বিভিন্ন বালাইয়ের (পোকা, রোগ জীবাণু, আগাছা) জীবনচক্র ব্যাহত হয়। ফলে এসব বালাইয়ের আক্রমণ কম হয়।
৩।    ধাপে জমির তুলনায় ঘনভাবে বীজ বপন করা যায়।
৪।    যেখানে চাষাবাদের জন্য পর্যাপ্ত জমি নেই সেখানে ধাপে চাষ করা যায়।
৫।    সেচ, সার, বালাইদমন বাবদ খরচ একেবারেই লাগে না।
৬।    তেমন পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না।
৭।    অবসর সময়কে কাজে লাগানো যায়।
৮।    জলজ উদ্ভিদকে কাজে লাগিয়ে নতুন ফসলী জমি সৃষ্টি করা সম্ভব।
৯।    মশা মাছির বৃদ্ধি বিঘ্ন ঘটায়।
১০।   পতিত নিচু জলাশয়ের সদ্ব্যবহার করা যায়।
১১।    ধাপের উপরে ফসল চাষ এবং নিচে মাছ চাষ করার ৰেত্রে কোনো সমস্যা থাকে না উপরন্তু মাছের খাবার হয়।
১২।    উৎপাদিত ফসলের ফলন স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি এবং মান কোন অবস্থাতেই কম নয়।
১৩।   এক বছরের ধাপ আগামী বছরের ফসলী জমির জন্য বিশেষ কম্পোস্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহারের ফলে মাটির বুনটের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন হয়।
১৪।    হাওড়, বাওড় ইত্যাদি নিচু ও জলাবদ্ধ এলাকায় শতভাগ লাভ হয়।
১৫।   বন্যার সময় বাড়ি নিমজ্জিত হয়ে গেলে ধাপ তৈরি করে তার ওপর হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল এমনকি কি মানুষ বাসা বেঁধে বসবাস করতে পারে। পরবর্তীতে ফসল আবাদ করা যায়।
১৬।   ধাপ সুবিধা মতো জায়গায় সময় মতো স্থানান্তর করা যায়।

অসুবিধা
১।    ধাপে শাকসবজি চাষের মানসিকতা ও অজ্ঞতার অভাব।
২।    ধাপ পাতলা হলে ফলন কম হয় এবং ধাপের ওপর উঠা যায় না।
৩।    ভালো জাতের বীজের অভাব।
৪।    পরিবহনের অভাবজনিত কারণে বাজারজাতকরণের সমস্যা।
৫।    কৃষকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব।
৬।    কৃষকের আর্থিক সমস্যা।
৭।    ব্যাপক সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কচুরিপানাসহ অন্যান্য উপকরণের অভাব।

সম্ভাবনা
প্রাকৃতিক এই রঙ্গমঞ্চে কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ পচা ও আধাপচা উদ্ভিদ, নাড়া, খড়কে কাজে লাগিয়ে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব তেমনি পানিতে কম্পোস্ট সার তৈরির মাধ্যমে শূন্য বা এক ফসলি জমিতে দুই বা বহু ফসলি জমিতে রূপান্তর করা সম্ভব। এতে করে দেশের মোট ফসলি জমি বাড়ানো সম্ভব। এভাবে ফসল ফলানো সম্ভব ফলে দেশে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানোর মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও পুষ্টির চাহিদা মিটানো সম্ভব।
হলুদ চাষ (প্রতি শতকে)

লাভ : ধাপে=৭০০০ টাকা-৪৫০ টাকা=৬৫৫০ টাকা
জমিতে= ৫৬০০ টাকা-৫৫০=৫০৫০ টাকা
(বিঃ দ্রঃ যদি আগাম/বিলম্বে আবাদ করা যায় তাহলে লাভ দ্বিগুণ হতে পারে।)

No comments:

Post a Comment