Monday, 19 September 2011

ফল ও উপকারী বৃক্ষ সম্প্রসারণে হর্টিকালচার সেন্টারের ভূমিকা

ফল ও উপকারী বৃক্ষ সম্প্রসারণে হর্টিকালচার সেন্টারের ভূমিকা

খাদ্য-পুষ্টির অভাব দূরীকরণ ও পরিবেশের উন্নয়নে ফল ও উপকারী বৃক্ষের অবদান অপরিসীম। দেশ খাদ্য উৎপাদনে অনেকটা স্বনির্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতার কবল থেকে এখনও রক্ষা পায়নি। দরিদ্র জনগোষ্ঠী শুধু যে পুষ্টি হীনতার শিকার তা নয়, পুষ্টি জ্ঞানের অভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরাও পুষ্টিহীনতায় জর্জরিত। এ অবস্থার উন্নয়নে পুষ্টি জ্ঞানে গণসচেতনতা আনয়ন ও বেশি করে ফল সবজি আবাদ ও আহারে সর্বস্তরের মানুষকে উৎসাহিত করা একান্ত প্রয়োজন।

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ফলমূলে রয়েছে হরেক রকম ভিটামিন, মিনারেলস্ ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান। অপর পক্ষে ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে আবাদি জমির পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য হলেও বাড়ির আনাচে-কানাচে, ছাদে, রাস্তার ধারে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যতটুকু জায়গা অব্যবহৃত আছে, সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টির অভাব দূরীকরণ অতি সহজ। এছাড়াও পরিবেশ দূষণে দেশের অবস্থা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে বেশি করে ফল-ফলাদি ও উপকারী বৃক্ষ (মাল্টিপারপাস ট্রি) ব্যাপক হারে রোপণের মাধ্যমেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের আবহাওয়া, মাটি ও পানি সম্পদ অন্তত ৫০ প্রকারের প্রচলিত ও অপ্রচলিত অর্থকরী ফল আবাদ করার জন্য অতি উপযোগী যা পৃথিবীর অন্যত্র বিরল। এ ছাড়াও কতগুলো বিদেশি জাতের ফল (মিঠা তেঁতুল, জামরুল, ড্রাগন ফল, স্ট্রবেরি, কমলা, খেজুর ইত্যাদি) খুব সফলভাবে আবাদ সম্প্রসারণ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কাজেই বিভিন্ন রকমের ফল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ফলের বীজ, চারা, কলমের সহজ প্রাপ্যতা ও আবাদে জনসাধারণের দক্ষতা বৃদ্ধি করার দায়িত্ব কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর। এ লক্ষ্য সফল বাস্তবায়নে হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর প্রধান করণীয় দিকগুলোর কিয়দাংশ আলোকপাত করা গেলঃ

হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিকরণ ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিকরণ
বেড়া ব্যবস্থা
হর্টিকালচার সেন্টারের আওতাধীন সব ফসলই পশুপক্ষী ও মানুষ সবারই অতি আকর্ষণীয়। তাই এগুলো চাষের সঙ্গে সঙ্গে তা রক্ষা করার জন্য বাউন্ডারি/ফেনসিং বা বেড়ার ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। অনেক সফল ও উৎসাহী অফিসার কেন্দ্রের অপর্যাপ্ত ও অপরিকল্পিত বিদ্যমান বাউন্ডারির কারণে সুন্দর ও মানসম্পন্নভাবে হর্টিকালচার কার্যক্রম সফল বাস্তবায়ন করতে সামর্থ্য নয়। অনেকেই পাকা বাউন্ডারি প্রত্যাশা করে। আর্থিক ব্যবস্থা বিবেচনায় এনে কিছুটা ফাউন্ডেশন, পিলার ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বর্ডারে লাইফ ফেনসিং (বেল, কথবেল, বগুন ভিলা, করমচা, লেবু, বাবলা, শিমুল) দিয়েও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া ও কেন্দ্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা মোটেও কঠিন নয়,  অভাব রয়েছে  রুচি, পরিকল্পনা ও  বাস্তবায়ন দক্ষতা।

ভূমি ও নিকাশ ব্যবস্থার উন্নয়ন
উদ্যান ফসল আবাদ ও চারা কলম তৈরি ও সংরক্ষণে ভূমির উন্নয়ন, পানির প্রাপ্যতা ও নিকাশ ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। এ কাজের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মাটি এনে বেশি ভরাটের প্রয়োজন নেই। একটা সুন্দর পরিকল্পনার মাধ্যমে কেন্দ্রকে বিভিন্ন বস্নকে ভাগ করে ড্রেন তৈরি করার মাধ্যমে ভূমি উঁচু ও পানি নিকাশ ব্যবস্থা করে বেশি জমি কাজের ব্যবহার উপযোগী করা যায়। এর পরেও স্থানভেদে প্রয়োজনমাফিক বেলে দো-আঁশ মাটির প্রয়োজন হলে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুকনো মৌসুমে সংগ্রহ করে পরিকল্পিত উপায়ে ভূমি উন্নয়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়।

চারা কলম তৈরি ও সংরক্ষণে অনুকূল ব্যবস্থা
চারা কলম তৈরি স্থানটি খামারের এক পার্শ্বে সুন্দর করে গড়ে তোলা দরকার। তাতে কর্মীদের জন্য অনুকূল পরিবেশে কর্মদক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ হয়, কাজের মান ও পরিমাণ বাড়ে। এখানে হালকা টিনশেড (ট্রান্সপারেন্ট টিন বা পস্নাসটিক সিট দিয়ে তৈরি আলো বাতাস প্রাপ্তি সহায়ক) ও তার সঙ্গে পস্নাসটিকের রঙিন নেট দিয়ে আধা ছাঁয়ার ব্যবস্থা রাখা দরকার। অনেক কেন্দ্রে এ ব্যবস্থা কিছুটা থাকলেও তার স্থায়িত্ব ও সুচারু ব্যবহার অপ্রতুল।

পটিং মিডিয়া সংরক্ষণ ও তার সুষ্ঠু ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন হলেও তা ঠিকমতো অনুসরণ হয় কি না তা পরীক্ষা করা দরকার। মৌসুমের শুরুতেই সারা বছরের জন্য কত ট্রাক ভিটেবালু দরকার এবং তার সাথে কি পরিমাণ বা রেসিওতে গোবর, হাড়ের গুঁড়া, খৈল ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে তা ঠিক ও কার্যকর করা দরকার।

সদ্য পটিং করা চারা কলম রাখার জন্য পটিং শেডের পাশেই ৭৫-৮০% ছায়া প্রদানযোগ্য কালো নেট দ্বারা চারা বেয়ারিং শেড তৈরি করা দরকার।

কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও চাহিদা
গার্ডেনার/মালী/সুপারভাইজারদের ব্যবহারের জন্য কি কি খামার যন্ত্রপাতি (বাডিং নাইফ, সিকেচার, খুরপি, নিড়ানি ও বিভিন্ন সাইজের ধারালো কোদাল/খোন্তা, পলিথিন টেপ, কভার, উপযুক্ত মাপের পলি ব্যাগ,পট ইত্যাদি), আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি (গামবুট, ছাতা, রেনকোট ইত্যাদি) আছে কি না তা ঠিকমতো পরীক্ষা করে সব কিছু সময়মতো সরবরাহ ও তাঁর ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এতে করে কাজের মান ও পরিমাণ বাড়বে অন্য দিকে কর্র্মীদের কাজের দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে।

বার্ষিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন
বছরের শুরুতেই হর্টিকালচার কেন্দ্রের কী কী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে এবং কখন কোন কোন কী পরিমাণ কাজ কার দ্বারা সম্পাদন হবে তার একটা “গাইড লাইন” পরিকল্পনা থাকা দরকার। কেন্দ্রের কিছু কাজ এত মৌসুমভিত্তিক যে তা “সময়ের এক ফোঁড়” পদ্ধতি অবলম্বন করা না হলে সে কাজ এক বছর পিছিয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয়ভাবেও ইহা অনুসরণ করা যেতে পারে। এ কাজ বাস্তবায়নে যেন সবাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ওয়ার্কপস্ন্যান তৈরিতে সমর্থ হয় এ জন্য ৫/৭টি কেন্দ্রের উদ্যোগী কর্মকর্তার কাছ থেকে “ফরমেট” সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয়ভাবে তা কমপাইল করে একটা “কমন” পস্ন্যানিং ফরমেট সব সেন্টারে বাস্তবায়নের জন্য বিতরণ করা যেতে পারে। ওয়ার্ক পস্ন্যান বা ওয়ার্ক ক্যালেন্ডার হবে পাক্ষিকভিত্তিক।

হর্টিকালচার সেন্টার বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রতিটি অংশের উপযোগী ব্যবহার

হর্টিকালচার সেন্টারগুলোকে জনসাধারণের জন্য আকর্ষণীয় করে প্রতিটি স্থানের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিটি সেন্টারকে পরিকল্পিত উপায়ে সাজাতে হবে। হর্টিকালচার একটি সুন্দর, মার্জিত, মনোরম কালচার। এখানে  এলে যে কোনো ভিজিটর আকর্ষিত হয় ও ফল ফলাদি আবাদে অনুপ্রেরণা পায় সে ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।

কেন্দ্রে প্রবেশ গেটটিকে আকর্ষণীয় লতানো ফুল (বাসর, গোল্ডেন সাওয়ার, ক্রিপার আলামন্ডা, যুঁই, লতা বেলী, অনন্তলতা, বগুন ভিলা, লাল রঙের প্যাশন ফ্লাওয়ার ইত্যাদি) দিয়ে আকর্ষণীয় করা দরকার।

প্রবেশ গেট থেকে বিক্রয় কেন্দ্র, নার্সারি এলাকা ও অফিসের আশপাশ এলাকাগুলোকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, সুদৃশ্য গাছপালা (করমচা, কামরাঙা, বারমাসী আমড়া, খাট জাতের নারিকেল, ডালিম, অরবরই, চেরী ফল, বিলম্ব, আলু বোখারা, পিচ, ড্রাগন ফল, একজোরা, আলামন্ডা, বগুন ভিলা (বিদেশি) বেলী, চেরী, খাট জাতের জামরুল, মন্দির ঝাউ, চাইনিজ পাম, বিস্নডিং হাট, র্যাবিশ পামপ ইত্যাদি) দিয়ে কেন্দ্রকে সুন্দর করে গড়ে তুলে ভিজিটরকে আকর্ষিত করতে হবে।

আকারের প্রকৃত অবস্থা বিবেচনায় এনে সেন্টারকে চার থেকে আরম্ভ করে ৬ বা ৮ বস্নকে ভাগ করে চলাচল ব্যবস্থা সুন্দর করা এবং প্রতি ব্লককে বিভিন্ন কাজে বা বাগান সৃষ্টি করা, মৌসুমি সবজি, ফুল, মসলা চাষ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী স্থাপন, লতানো  সবজি (পটোল, সিম, বরবটি) আলাদাভাবে আবাদ ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
অফিস সংলগ্ন প্রবেশ পথ, বিক্রয় কেন্দ্র ও নার্সারি এলাকায় ফল/ফুলের টব ও মৌসুমি ফুল দিয়ে সুদৃশ্য করা যায়। এ ছাড়াও গাজর, পেঁয়াজ, ধনে, রেড ক্যাবেজ, লেটুস জাতীয় সুদৃশ্য সবজি দিয়েও ডেকোরেশন করা উত্তম।

১৪-১৬ ইঞ্চি মাটির টবে কথবেল, কামরাঙা, ডালিম ও খাট জাতের আম (লতা-বম্বে), জামরুল (থাই), চেরী ফল, করমচা, পেয়ারা, কমলা, লেবু, জাম্বুরা ইত্যাদি ফলগাছ সংরক্ষণ করে প্রদর্শনী আকারে ব্যবহার করা যায়।

মৌসুমে সবজি (বেগুন, মরিচ, ক্যাপসিকাম, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি), মসলা, ফলের চারা (পেঁপে, আমড়া ইত্যাদি), কাটিং তৈরি ইত্যাদি কাজে ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট বস্নকে ইট (সিরামিক) দিয়ে সেমি পারমানেন্ট বেড তৈরি করে নেয়া ভালো হবে।

লেবু, গোলাপ জাতীয় বাগান যা সুন্দর রাখা যায় না সেগুলোকে দূর প্রান্তে রাখা ভালো। তবে যে সবগাছ দেখতে সুন্দর (কথবেল, কামরাঙা, থাই জামরুল, ড্রাগন ফ্রুট ইত্যাদি) সে সব গাছের বাগান অফিসের কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকা দরকার।

মাতৃগাছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
কেন্দ্রে যতদূর সম্ভব বিভিন্ন ফলের এবং বিভিন্ন জাতের মাতৃগাছ থাকা দরকার। জানাশুনা নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে তা সংগ্রহ করা উচিত হবে। এগুলোর জাতের বৈশিষ্ট্য, উৎস ইত্যাদি বিস্তারিত সংশিস্নষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মাতৃগাছ রেজিস্টারে সংরক্ষণ করতে হবে। গাছে ফুল, ফল ধরা অবস্থা, স্বাদ, সাইজ ইত্যাদি গুণাবলি যাচাই না করে মাতৃগাছকে কখনো চারা কলম তৈরির কাজে ব্যবহার করা উচিত হবে না।

মাতৃগাছ সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ, ফল ধরা ও অন্যান্য গুণাগুণ বিশিষ্ট তথ্য কিভাবে সংরক্ষণ করা হবে তার একটা “কমন” ফরমেট কেন্দ্রীয়ভাবে সরবরাহ করা প্রয়োজন। মাতৃগাছসহ সব ধরনের গাছকে ট্রেনিং, প্রুনিং করে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা এবং নিয়মিত খাবার দেয়া, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনব্যবস্থা নিতে হবে। রুগ্ণ, আধামরা, বাঁকা ত্যাড়া, দেখতে অসুন্দর গাছকে শুরুতেই অপসারণ করা উচিত।

নারিকেল গাছের মাতৃ গাছ নির্বাচন ও বীজ নাট সংগ্রহ
জাতীয় পর্যায়ে নারিকেল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রায় সব হর্টিকালচার সেন্টারেই প্রতি বছর প্রচুর সংখ্যক নারিকেল চারা উৎপাদন ও বিক্রয় করা হয়ে থাকে। উন্নত মানের নারিকেল চারা উৎপাদনের জন্য সময়মতো বীজ সংগ্রহ, গজানো-চারা রোপণ এবং গজানো-চারা কালিস্নং এর মাধ্যমে গুণগত চারা বিক্রির নিশ্চয়তা প্রদান করা। জাতীয় পর্যায় থেকে ভালো নারিকেল উৎপাদন এলাকা (যেমন- বরিশাল, খুলনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ইত্যাদি) থেকে মাতৃগাছ নির্বাচন করে তাতে ‘নম্বরসহ ট্যাগ’ দিয়ে রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করতে হবে। হর্টিকালচার সেন্টারের ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবস্থিত নারিকেল গাছের মধ্যে থেকেও মাতৃগাছ নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে হবে। মাতৃগাছগুলোর যথাযথ যত্ন নিতে হবে এবং নির্বাচিত মাতৃগাছ থেকে যথাসময়ে ‘বীজ’ নারিকেল সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে।

চারা-কলম তৈরিতে লক্ষণীয়
সুন্দর, সুস্থ, সবল সুনির্দিষ্ট জাতের চারা-কলম আলাদাভাবে লেবেল দিয়ে সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থা নিতে হবে।
এলাকায় বেশি চাহিদা, স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ ও অন্যান্য সংস্থাসহ বিশেষ প্রকল্প চাহিদা ও অন্য অঞ্চলের চাহিদা যেসব চারা কলমের বেশি সেগুলো বেশি করে উৎপাদন করতে হবে।

কিছু কিছু নূতন ফল ও জাত যা জনপ্রিয়তা আনা দরকার সেগুলো উৎপাদনে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে এবং তা সম্প্রসারণ ব্যবস্থা (কথবেল, সজিনা) জোরদার করতে হবে।

কিছু কিছু গাছ দীর্ঘ দিন (এক বছরের ওপর) সংরক্ষণ করা দরকার। বিশেষ করে রাস্তার ধারে বা কোন অফিস, স্কুল, কলেজ ও প্রতিষ্ঠানে বড় লম্বা গাছ গরু ছাগলের হাত থেকে রক্ষার জন্য বড় গাছ লাগাতে ক্রেতারা পছন্দ করে থাকে। এ চাহিদা পূরণে আম, কাঁঠাল, আমড়া, জাম, জলপাই, ডেউয়া, চালতা, ডুুমুর এগুলোর চারা বড় করে বিতরণ ব্যবস্থা করা দরকার। এগুলোকে পস্নাস্টিক সিমেন্টের ছোট ব্যাগে (দামে সস্তা প্রায় প্রতিটি ২/-) এক বছরের অধিককাল সংরক্ষণ করাও যায় এবং এতে গাছকে, ৫-৭ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট অবস্থায় সংরক্ষণ করে সুনির্দিষ্ট ক্রেতাকে আকর্ষিত করার জন্য। এ ধরনের লম্বা গাছের জন্য আলাদা মূল্য নির্ধারণ প্রয়োজন।

যেসব গাছের চাহিদা কম সেগুলো সীমিতসংখ্যক সংরক্ষণ করা উচিত। আকাশিয়া, ইউকেলিপটাস, মিনজিয়াম, সেগুন, মেহগিনি, ইপিল-ইপিল জাতীয় অত্যন্ত সীমিত আকারে চারা উৎপাদন করতে হবে।
তবে সীমিত আকারে নিম, স্বর্ণচাঁপা, হরিতকি, বহেড়া, ক্যসয়ো-জাভানিকা, এ জাতীয় গাছের চারা সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থা নেয়া যায়।
গতানুগতিক শুধু চারা তৈরি ও বিতরণ প্রবণতা কমিয়ে কাঁঠাল, জাম, তেঁতুল, বেল, জলপাই ইত্যাদি ফল গাছের একই সঙ্গে কলম তৈরি করা ও সম্প্রসারণ ব্যবস্থা নেয়ার গুরুত্ব দেয়া দরকার।

চারা কলম তৈরি ও সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ায় যেসব গাছের গুরুত্ব বেশি দেয়া উচিত তাদের মধ্যে কথবেল কলম, বরিশালী আমড়া, থাই জামরুল, উন্নত জাতের জাম, বেল, তেঁতুল, লটকোন, উন্নত জাতের আম, লিচু, জাম্বুরা, লেবু, কমলার কলম এবং সজিনার চারা/কাটিং সেগুলোর অন্যতম।

উদ্যান ফসল সম্প্রসারণ
প্রত্যেক সেন্টারের আওতায় কমপক্ষে নিকটস্থ একটা রাস্তা, ঈদগাহ/গোরস্থান, স্কুল/কলেজ/ এতিমখানা/মাদ্রাসা, একটি গ্রামের কমপক্ষে ৭টি বাড়িকে মডেল আকারে ফল ও উপকারী বৃক্ষ দিয়ে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।  একটি বাড়ি একটি খামার মডেলে ও কিছু বাড়িকে প্রদর্শনী আকারে সাজানো যায়। প্রয়োজনে স্থানীয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সহায়তায় যৌথ উদ্যোগে এ ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।

কর্মশক্তি উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ
গার্ডেনার থেকে আরম্ভ করে কেন্দ্রে কর্মরত সর্বস্তরের অফিসিয়ালদের উদ্যানতত্ত্ব, কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা চারা কলম তৈরি, সংরক্ষণ, বিতরণ এবং উদ্যান ফসল সম্প্রসারণে করণীয় বিষয়ে নিয়মিত অরিয়েন্টেশন ট্রেনিং দরকার। এমন কি নতুন যোগদানকৃত স্টেশন ইনচার্জকে কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারের মতো স্থানে অন্তত ১ মাসের জন্য শিক্ষানবিস হিসাবে অবস্থান ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিশেষে এ কর্মকর্তা উৎসাহজনক কি শিখলো এবং বাস্তবে পরবর্তীতে লব্ধজ্ঞান কর্মক্ষেত্রে কিভাবে প্রয়োগ করা হবে সে বিষয়ে অন্তত ১৫ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট প্রশিক্ষণ সমাপনী রিপোর্ট হেড কোয়ার্টারে তাকে জমা দিতে হবে।

কোন স্তরের স্টাফদের কি ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে তার একটা ট্রেনিং সিডিউল তৈরির দায়িত্ব তিন সদস্যবিশিষ্ট অভিজ্ঞ হর্টিকালচারিস্টকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। অর্থায়নে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পকের দায়িত্ব হবে।

হর্টিকালচার সেন্টারে কর্মরত স্টাফ ভিজিট
যেসব কেন্দ্রে উদ্যান উন্নয়নে বিভিন্ন উৎসাহজনক অনুকরণীয় কর্মকাণ্ড চলছে সেসব হর্টিকালচার সেন্টারগুলোসহ সংশিস্নষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠান (জিও, এনজিও) এবং সফল চাষির বাগান ভিজিটব্যবস্থা নিয়ে কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। ভিজিটকালে কি ধরনের জ্ঞান আহরণ হলো সে শিক্ষার আলোকে কি ব্যবস্থা কেন্দ্রে ফিরে গিয়ে প্রয়োগ করা হবে তার প্রতিবেদন সুনির্দিষ্ট ফরমেটে/ কমিটমেন্ট পরিদর্শনকারী কেন্দ্রের সব স্টাফকে লিখিত আকারে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে এবং তার পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে ভিজিটের প্রতিফলন সংশিস্নষ্ট সেন্টারে দেখাতে হবে।

প্রচার ও সম্প্রসারণ
অনেক হর্টিকালচার সেন্টার উদ্যান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে বিশেষ অবদান রাখছে অথচ ডিএই এর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মাস-মিডিয়াকে ব্যবহার করে তেমন প্রচারণা ব্যবস্থা নিয়ে জনগণকে আকৃষ্ট করার প্রবণতা তেমন নেই। খাদ্য পুষ্টি, আয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উদ্যান ফসলের সফল সমপ্রসারণ বাস্তবায়নে বহুল প্রচার কল্পে বিভিন্ন মিডিয়াকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে এবং জনগণের মধ্যে উদ্যান ফসল সম্প্রসারণ ব্যবস্থা জনপ্রিয় করতে হবে।

উদ্যান বিশেষজ্ঞ টিম গঠন ও দায়িত্ব
ডিএইতে কর্মরত উদ্যানতত্ত্বে অভিজ্ঞ সৃজনশীল বেশ কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। তাঁদেরকে নিয়ে একটা বিশেষজ্ঞ টীম গঠন করতে হবে এবং তারা বিভিন্ন কেন্দ্র ভিজিট করে কেন্দ্রের উন্নয়নে লিখিত সাজেশন প্রদান করবেন এবং হেড কোয়ার্টার থেকে এর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করত প্রয়োগ ব্যবস্থা তরান্বিত করবে।
পুরস্কার ব্যবস্থা গ্রহণ
প্রতি বছর শেষে বড়, মাঝারি ও ছোট আকারের তিন ধরনের হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর কর্মতৎপরতা ও সফল অবদানের জন্য তিন জন ইনচার্জকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রত্যেক কেন্দ্রে ভালো কাজ করার প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

অফিস ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা
হর্টিকালচার সেন্টারের কর্মকর্তাগণ বেশিরভাগই কারিগরী কাজে দক্ষ কিন্তু অফিস ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার ততটা দক্ষ নয়। সেন্টার ইনচার্জকে অফিস ও আর্থিক ব্যাবস্থাপনায় সঠিকভাবে দায়িত্ব পলন করা অত্যন্ত জরুরি। তাই সংশিস্নষ্ট সেন্টার ইনচার্জদের অফিস ও আর্থিক ব্যবস্থাপনাসহ চচজ- ২০০৮ এর উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে ডিএই’র অভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালকগণের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।

মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ
সেন্টারের কার্যক্রম পরিকল্পনামাফিক চলছে কিনা তা তদারকি করার জন্য যিনি সার্বিক দায়িত্বে আছেন (ডিডি, ফল ও সবজি), তাকে ঘনঘন সেন্টারগুলো পরিদর্শন করতে হবে। পরিকল্পনামাফিক কাজ হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে এবং কোথায়ও কাজের ঘাটতি থাকলে তা সরেজমিন উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে ডিএই, হেডকোয়ার্টার থেকে উদ্যান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা মনিটরিং টিম ও গঠন করা যায় এবং তাদের মাধ্যমে মনিটরিং কাজ সমাধা করা যায়।

পরিশেষে আগামী দিনের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য, পুষ্টির চাহিদা পূরণ, আয় বৃদ্ধি ও পরিবেশের উন্নয়নে সব স্তরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করুক এটাই একান্তভাবে সবার কামনা।

No comments:

Post a Comment