Pages

Sunday, 15 May 2011

ধান সংরক্ষণ কলাকৌশল

ধান সংরক্ষণ কলাকৌশল

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা/ স্বয়ম্ভরতা অর্জন বর্তমানে আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে বর্তমান সরকার প্রায় সতের কোটি মানুষের মুখে এক মুঠো খাবার দেয়ার জন্য কৃষি বিভাগের এক ঝাঁক উদ্যমী, পরিশ্রমী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। দেশের এক কোটি ৮২ লাখ কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডসহ কৃষি উপকরণের ওপর (সার, বীজ) ভর্তুকি, সময়মতো কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া, কৃষকের প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা, সময় উপযোগী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি। এসব কিছুর মূলেই হলো দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে মেহনতি মানুষের মুখে আহার নামক দুর্লভ বস্তুটি উঠিয়ে দেয়া। যার ফলে আজ সারা দেশে আমনের পর বোরোর বাম্বার ফলন এবং কৃষকের মুখে হাসি কিন্তু আমাদের কৃষকের পরিশ্রমের উৎপাদিত ফসল ধানের প্রায় ১৫.৮ শতাংশ গুদামে সংরক্ষণের সময় নষ্ট হয়ে যায় শুধু আমাদের অসাবধানতাবশত। প্রতি বছর হাজার হাজর টন ধান নষ্ট হয় সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাবে। তাই সঠিকভাবে সময়মতো ধান সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি। গুদামজাত ধানের পোকামাকড়ের ক্ষয়ক্ষতি কম রাখতে বা বন্ধ করতে হলে ধানে পোকামাকড়ের উৎস ও তা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে সর্বদা সচেষ্ট হতে হবে। আবার পোকার আক্রমণ কম থাকা অবস্থায় প্রতিকারমূলক দমনব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য মাঠ থেকে গুদামজাত করা পর্যন্ত পোকার আক্রমণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ পোকা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ধান গুদামজাত করা উচিত নয়। আবার ধান গুদামে রাখার পর এক মাস অন্তর অন্তর পোকার আক্রমণ হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। পোকার সংখ্যা কম থাকা অবস্থায় দমনব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজতর। এতে ধানে পোকার ক্ষতি কম হয় এবং দমন খরচ কম লাগে।

দুটি উদ্দেশ্যে গুদামে ধান রাখা হয়- ১. বীজ ও ২. পরবর্তী সময়ে খাওয়ার অথবা বিক্রির জন্য। যেটুকু ধান বীজ হিসেবে রাখা হবে তার জন্য অধিক যত্নবান হওয়া দরকার কারণ বীজ এমন একটি জীবন্ত বস্তু, যা সঠিকভাবে সময়মতো সংরক্ষণ করতে না পারলে এক দিকে কীটপতঙ্গ নষ্ট করে অপর দিকে গজানোর ক্ষমতাও কমে যায়। ফলে বীজ ধান থেকে আশানুরূপ সংখ্যক চারা পাওয়া সম্ভব হয় না। তাই বীজ ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পর ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এজন্য-

ক. ধান কাটার আগে মাঠেই পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য পোকার আক্রমণ বন্ধ করার জন্য ধান বেশি সময় ধরে মাঠে ফেলে রাখা যাবে না। অনেক প্রজাতির পোকা ফসল কাটার আগে মাঠেই ধানকে আক্রমণ করে অথবা ধানের গায়ে ডিম পাড়ে।

খ. রোদে শুকানোর সময় আশপাশের গুদাম থেকে পোকা এসে যাতে আক্রমণ করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বীজ সংরক্ষণের আগে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। সব সময় খেয়াল রাখতে হবে সংরক্ষিত বীজ ধানের আর্দ্রতা ১২ শতাংশের কম থাকে। এর বেশি থাকলে পোকার আক্রমণ বেশি হয় কিন্তু কম বা এ রকম থাকলে পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমে যায় বা অনেক সময় আক্রমণ করে না। অর্থাৎ সঠিকভাবে শুকাতে হবে। পরীক্ষা হিসেবে দাঁত দিয়ে বীজ ধান কাটলে যদি কট্ কট্ শব্দ করে তাহলে বুঝতে হবে বীজ ঠিকমতো শুকিয়েছে। একটি ধানের দানাও যাতে পোকায় নষ্ট না করতে পারে তার জন্য ১৫ দিন অন্তর অন্তর বীজধান পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

গ. বড় বড় পুষ্ট ধান বাছাই করে নিতে হবে। ১.৭৫-২.৫০ মিলিমিটার ছিদ্র বিশিষ্ট (জাতভেদে) তারের তৈরি ছাকনি দ্বারা বীজধান বাছাই করা যেতে পারে। তবে কুলা দ্বারা ঝেড়েও বাছাই করা যায়।

ঘ. যে পাত্রে বীজধান রাখা হবে তা যেন কোনো প্রকার ছিদ্রযুক্ত না হয় এ দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বীজধান রাখার জন্য তেলের ড্রাম কিংবা বিস্কুট বা কেরোসিনের টিন প্রভৃতি ধাতবপাত্র ব্যবহার করা উত্তম। পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিতে হবে।

ঙ. ধাতবপাত্র ব্যবহার করা সম্ভব না হলে মাটির মটকা, কলস বা মোটা পলিথিনের থলি ব্যবহার করা যেতে পারে। মাটির পাত্র হলে পাত্রের বাইরের গায়ে আলকাতরা দিয়ে দুবার প্রলেপ দিতে হবে।

চ. রোদে শুকানো বীজ ঠান্ডা করে পাত্রে ভরতে হবে। পাত্রটি সম্পূর্ণ বীজ দ্বারা ভর্তি করতে হবে যদি বীজ সঙ্কুলান না হয় তা হলে বীজের ওপর কাগজ বিছিয়ে তার ওপর শুকনো বালু দিয়ে পাত্র পরিপূর্ণ করতে হবে। এরপর পাত্রের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে রাখতে হবে যাতে বাতাস ঢুকতে না পারে। বীজের পাত্র মাচায় রাখা ভালো যাতে পাত্রের তলা মাটির সংস্পর্শে না আসে। বীজধান কখনো স্যাঁতসেঁতে জায়গায় সংরক্ষণ করা ঠিক নয়।

খাওয়া অথবা বিক্রির জন্য ধান সংরক্ষণ : বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পোকার বংশবিস্তারের জন্য খুব উপযোগী  সাধারণত দুটি বড় বর্গের পোকা (লেপিডোপটেরা ও কোরিওপটেরা) গুদামজাত শস্যে আক্রমণ বেশি করে। আমাদের দেশে গুদামজাত ধানে সাধারণত ধানের গুঁড়া পোকা, কেড়ি পোকা, খাপড়া বিটল, ধানের সরুই পোকা ইত্যাদি ক্ষতি করে থাকে। এসব পোকা কর্তৃক কৃষকের উৎপাদিত ফসলের একটি বিরাট অংশ নষ্ট ও ব্যবহার অনুপযোগী করে তোলে। তাই সচেতনতা ও কিছু কৌশল অবলম্বন করা উচিত।

ক. ধান সংরক্ষণের জন্য সাধারণত বাঁশের নির্মিত গোলা বা ডোল, মটকা, টিন বা মাটির পাত্র ব্যবহার করা হয়। বাঁশের নির্মিত এসব পাত্রের ভেতর ও বাইরে ধান রাখার আগে গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে লেপে দিতে হবে। ধান গোলাজাত করার পর এর ওপরের স্তরের শুকনা বালু, তুষ অথবা কুঁড়া, নিমপাতার গুঁড়া দিয়ে ভালোভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। পাত্রগুলো সর্বদা মাটি থেকে ১-১.২৫ মিটার উঁচুতে মাচায় বসিয়ে রাখতে হবে।

খ. পাকা গুদাম ধান সংরক্ষণের জন্য সবচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে গুদামে আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। গুদামের দেয়াল ও ফ্লোর ভালোভাবে মেরামত করতে হবে। কোনো ফাঁটা বা ক্ষত থাকা যাবে না। পাকা গুদামের ভিত মাটি থেকে ৪ ফুট উঁচু এবং বিটুমিনের তৈরি জলীয়বাষ্পবিরোধী স্তর তৈরি করতে হবে। এসব সম্ভব না হলে ধান রাখার আগে কাঠের মাচা তৈরি করে তারপর ধানের বস্তা স্টোক করতে হবে তাহলে মাটি থেকে আর্দ্রতা ধানে উঠবে না এবং ক্ষতির আশঙ্কাও অনেক কম থাকবে। গুদামে ব্যাগগুলো দেয়াল থেকে অন্তত তিন ফুট দূর থেকে সাজাতে হবে এবং প্রতি সারির মাঝে সমান দূরত্ব রাখতে হবে। ফলে  পরে পরিচর্যা করতে সুবিধা হবে।

গুদামজাত ধানে দুই রকমের কীটনাশক স্প্রে করা যায়। ক. স্পর্শ বিষ খ. ফিউমিগেন্টস/ বিষবাষ্প স্পর্শ বিষ ধানকে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে। প্রতি ১০০০  ঘনফুট জায়গায় ম্যালথিয়ন (৫০ পাউডার/ইসি), ডিডিভিপি ১০০ ইসি, ফলিথিয়ন ৫০ ইসি, নগস ১০০ ইসি ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। ফিউমিগেন্টস দ্বারাও ধানের ভেতরে ও বাইরে কীটপতঙ্গ মারা যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে সাধারণত এ পন্থা অবলম্বন করা হয়। প্রতি টনে ৫-৭টি অ্যালুমিনিয়াম ফসফেট ট্যাবলেট ব্যবহার করলে পোকা মারা যায়। ফসটকসিন, ভেসিয়া, কুইক ফস, সেলফস ইত্যাদি নামে এটি বাজারে পাওয়া যায়। ট্যাবলেট ব্যবহারের পর জলীয়বাষ্প প্রতিরোধী পস্নাস্টিক কাগজ দ্বারা ঢেকে ঘর বায়ুরোধী করে কমপৰে ৫-৭ দিন রাখলে পোকা মারা যায়। এ ছাড়া তরল বিষ বাষ্প হিসেবে মিথাইল ব্রোমাইড প্রতি ১০০০ বর্গফুটে ১.৫০ পাউন্ড ২৪ ঘণ্টার জন্য এবং ক্লোরিনেটেড হাইডোকার্বন ব্যবহার করা যায়।
কৃষকদের ফসলের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সময়ের দাবি। তাই উৎপাদিত ফসলের যথাযথ সংরক্ষণ করে আর্থিক সচ্ছলতা আসুক বাংলার প্রতিটি কৃষকের এবং দেশ ও জাতির। এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

* আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খুলনা

No comments:

Post a Comment