সবজি উৎপাদনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা
এস. এম. আহসান হাবিব*
এস. এম. আহসান হাবিব*
০ বালাইয়ের আক্রমণ থেকে ফসলের ক্ষতি কমানো এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
০ ফসল চাষে কৃষকের আর্থিক উপার্জন বৃদ্ধি করা।
০ বিভিন্ন ধরনের ফসলে বিষাক্ত বালাইনাশকের অহেতুক ব্যবহার কমানো বা রোধ করা।
০ ফসল, মাছ ও হাঁস-মুরগিসহ বিভিন্ন রপ্তানিযোগ্য কৃষি ফসল ও পণ্যের ওপর বালাইনাশকের সম্ভাব্য বিষাক্ততা রোধ করা।
০ কৃষি ক্ষেত্রে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার (আইপিএম) গবেষণা, উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি সমপ্রসারণের ব্যবস্থা করা।
০ সামগ্রি জীব বৈচিত্র্য এবং মানব সংরক্ষণ করা।
০ সমন্বিতবালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ এবং সিদ্ধানত্ম প্রদানে উৎসাহ প্রদান করা।
সবজি চাষের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দেশ। গত এক দশকে সবজি চাষের জমির পরিমাণ এবং উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু পোকামাকড় ও রোগবালাই থেকে ফসলকে রক্ষার জন্য সবজি চাষিরা জেনে বা না জেনে যত্রতত্র কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন। যশোর জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, বেগুনের পোকা বা অন্যান্য বালাই দমনের জন্য বেগুন চাষিরা প্রতি মৌসুমে প্রায় ১৫০ বার বা প্রতিদিন কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। অন্যান্য সবজি ফসলেও তাঁরা প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন। এর ফলে, পোকার মধ্যে কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠেছে, যে কারণে বারবার কীটনাশক ব্যবহার করেও পোকা দমন হচ্ছে না এবং সবজি চাষের খরচ উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলে সবজি চাষিদের আয় কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া কীটনাশকের বিষাক্ততার জন্য চাষির স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে এবং যারা এসব কীটনাশক প্রয়োজনকৃত সবজি খাচ্ছেন তাদের দেহের মধ্যে কীটনাশকের বিষক্রিয়া প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া আরো গুরুত্বপূর্ণ এই যে, প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করার দরুন বাংলাদেশ থেকে বিদেশে সবজি রপ্তানি করার ‡ÿত্রে সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে সবজির বিভিন্ন গবেষণার জন্য বারি হচ্ছে একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান যেখানে একটি হর্টিকালচার গবেষণা কেন্দ্র আছে এবং এ কারণে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আইপিএম এর কার্যক্রমের সঙ্গে বারি’র সর্বাধিক বিজ্ঞানী জড়িত। এ যাবৎ যে সব সবজি ফসলের জন্য আইপিএমের মাধ্যমে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনার কর্মসূচি পরিচালিত
হচ্ছে সেগুলো হচ্ছে- বেগুন, টমেটো, বাঁধাকপি, ঢেঁড়স, শিম ও বিভিন্ন কুমড়া জাতীয় সবজি। বর্তমানে যেসব জেলায় আইপিএমর কার্যক্রম চলছে সেগুলো হচ্ছে- গাজীপুর, কুমিলস্না, লালমনিরহাট এবং যশোর। গত তিন-চার বছরে আইপিএমের কার্যক্রমের মাধ্যমে সবজি ফসলে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব প্রযুক্তি সফলতা অর্জন করেছে এবং বিভিন্ন এলাকার চাষিরা সেসব প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তা নিম্নে দেয়া হলো-
১। কলম-চারা ব্যবহারের মাধ্যমে বেগুন ও টমেটোর ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট রোগ দমন
ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট, বেগুন ও টমেটোর একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর রোগ, যা সহজে দমন করা যায় না। ফলে চাষিদের বেগুন ও টমেটো ক্ষেতের প্রায় ৫০ ভাগ গাছ এ রোগের আক্রমণে মারা যায় এবং চাষিরা আর্থিকভাবে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ রোগ প্রতিরোধী বেগুন ও টমেটোর কলমের চারা ব্যবহার করলে বেগুন ও টমেটোর গাছ এ রোগে খুব কম আক্রান্ত হয় বা মোটেই আক্রান্ত হয় না। গাজীপুর ও যশোর এলাকায় কৃষকের মাঠে বেগুনের কলম-চারা ব্যবহার করে চাষিরা প্রায় ২ থেকে ৪ গুণ বেশি ফলন পেয়েছেন এবং প্রায় ৩ গুণ বেশি অর্থ আয় করেছেন। টমেটোর কলম- চারা ব্যবহার করে গাজীপুর এলাকার চাষিরা প্রায় দেড় গুণ বেশি ফলন ও অর্থ আয় করেছেন।
২। ফেরোমোন ও মিষ্টি কুমড়ার ফাঁদ ব্যবহারের মাধ্যমে কুমড়া জাতীয় ফসলের মাছি পোকা দমন
কুমড়া জাতীয় বিভিন্ন ফসলের মাছি পোকা একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর পোকা। এ পোকা কুমড়া জাতীয় ফসলের (যেমন-মিষ্টি কুমড়া, করলা, শসা, ইত্যাদি) মধ্যে প্রথমে ডিম পাড়ে এবং ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফসলের ভেতরে খেয়ে ফল নষ্ট করে ফেলে। পোকার আক্রমণের কারণে প্রায় ৫০-৬০ ভাগ ফল নষ্ট হয়ে যায়, যা কীটনাশক ব্যবহার করেও ভালোভাবে দমন করা যায় না এবং এজন্য চাষিরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ফেরোমোন এবং মিষ্টি কুমড়ার ফাঁদ ব্যবহার করলে মাছি পোকা আকৃষ্ট হয়ে ফাঁদের মধ্যে পড়ে এবং মারা যায়। ফলে ফসল এ পোকার আক্রমণ থেকে ব্যাপকভাবে রক্ষা পায়। গাজীপুর, লালমনিরহাট ও যশোর এলাকায় মিষ্টি কুমড়া, শসা ও করলা ফসলে এ ফাঁদ ব্যবহার করে চাষিরা দেড় থেকে ৩ গুণ বেশি ফলন পেয়েছেন। যশোর এলাকার চাষিরা এ পদ্ধতিকে জাদুর ফাঁদ নামে অভিহিত করেছেন।
৩। মুরগির পচনকৃত বিষ্ঠা ও সরিষার খৈল ব্যবহারে মাধ্যমে বিভিন্ন সবজি ফসলের মাটিবাহিত রোগ দমন
সবজি ক্ষেতের মাটিতে বিভিন্ন রোগের জীবাণু ও কৃমি বাস করে, যারা সবজির গাছ নষ্ট করে বা মেরে ফেলে। মুরগির, বিষ্টা ও সরিসার খৈলের মধ্যে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান আছে, যা বিভিন্ন রোগ জীবাণু ও কৃমিকে মেরে ফেলে এবং সাথে সাথে মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। গাজীপুর, লালমনিরহাট ও কুমিল্লা এলাকায় বিভিন্ন সবজি (বাঁধাকপি, শসা, বেগুন, টমেটো) ফসলে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ফসলের ক্ষেতে বিভিন্ন রোগ ও কৃমির আক্রমণ ৫০ থেকে ৯০ ভাগ কমে গেছে এবং ফসলের সার্বিক উন্নতিসহ দেড় থেকে ২ গুণ বেশি ফলন হচ্ছে।
৪। সঠিক সময়ে আগাছা দমন পদ্ধতির মাধ্যমে অধিক লাভ অর্জন
চাষিরা সব সময় তাদের সবজি ক্ষেত আগাছামুক্ত রাখতে গিয়ে ৫-৬ বার আগাছা পরিষ্কার করে থাকেন। এর ফলে সবজি চাষের খরচ অনেক বেড়ে যায়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এতবার আগাছা পরিষ্কার না করে ফসলের বাড়-বাড়তি ও আগাছা জন্মানোর সময় বিবেচনা করে মাত্র দু’বার আগাছা পরিষ্কার করা হলে যেমন সঠিকভাবে আগাছা দমন করা যায় তেমনি ফসলের ফলনও ভালো পাওয়া যায়। গাজীপুর এলাকায় এ পদ্ধতির মাধ্যমে চাষিরা তাদের বাঁধাকপি, বেগুন, ঢেঁড়স ও টমেটো ড়্গেতে আগাছা দমনের খরচ ৩০-৩৫ ভাগ কমাতে পেরেছেন এবং আর্থিকভাবে প্রায় দেড় গুণ বেশি লাভবান হয়েছেন।
৫। আইপিএম পদ্ধতির মাধ্যমে বাঁধাকপির পাতা খেকো পোকা দমন
বিভিন্ন এলাকায় কয়েক প্রজাতির পাতা খেকো পোকা বাঁধাকপি ও ফুলকপি ফসল নষ্ট করে ফেলে। এসব ফসলের ফলন ও গুণগতমান ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং চাষিরা কীটনাশক ব্যবহার করেও ভালো ফল পান না। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এসব পাতা খেকো পোকা আক্রমণের প্রথমাবস্থায় যদি আক্রান্ত পাতার পোকাগুলো হাত দিয়ে ২-৩ বার মেরে ফেলা হয় তাহলে পোকার আক্রমণ কম হয় ও কীটনাশক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না এবং ভালো ফলন পাওয়া যায়। গাজীপুর, যশোর ও কুমিল্লা এলাকায় এ পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষিরা সাফল্যজনক ভাবে বাঁধাকপির পাতা খেকো পোকা দমন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং কীটনাশক ব্যবহার করার তুলনায় বেশি ফসল ও অর্থ লাভ করেছেন।
৬। পোকা প্রতিরোধী জাত ব্যবহারের মাধ্যমে বেগুনের ডগা ও ফলের মাজরা পোকা দমন
পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে এমন জাত ব্যবহার করা একটি অত্যন্ত কার্যকরি ও লাভজনক পদ্ধতি। গত তিন বছর মাঠ পরীক্ষার মাধ্যমে এমন কয়েকটি বেগুনের জাত শনাক্ত করা হয়েছে যারা ডগা ও ফলের মাজরা পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে। □
No comments:
Post a Comment