কৃষি উন্নয়নে নারীর ভূমিকা
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি কৃষি। কৃষিক্ষেত্রে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। পৃথিবীর উষালগ্ন থেকেই নারী মানবসম্পদ উন্নয়নসহ সমাজ ও পারিবারিক কর্মকা-ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বিশেষ করে শস্য কর্তনোত্তর ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরৰণ, বীজ উৎপাদন, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন, বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সবজি ও ফল উৎপাদন, সামাজিক বনায়ন ইত্যাদিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে, যা প্রত্যৰভাবে গোচরিভূত হয় না বলে যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। বিশ্বের অর্ধেক নারী উন্নয়নশীল দেশে বাস করে। কৃষি উৎপাদনে ৪০-৮০% (দেশ অনুসারে ভিন্ন) দায়িত্ব নারী পালন করে। এশিয়া মহাদেশের চাল উৎপাদনের ৰেত্রে শতকরা ৫০ থেকে ৯০ ভাগ শ্রম নারীরা দিয়ে থাকেন।
কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়া বিশেৱষণ করলে দেখা যায়, প্রাক বপন প্রক্রিয়ার মধ্যে বীজ সংগ্রহ, সংরৰণ এবং বীজ প্রস্তুতি এই কাজগুলো মূলত নারীরাই করে থাকেন। বীজ ধান নির্বাচনের পর ঝাড়া, শুকানো, মাটির ড্রাম, টিন বা চটের বস্তায় সংরৰণ করতে হয় এবং নির্দিষ্ট ব্যবধানে পুনঃ পুনঃ শুকাতে হয়। বীজ শুকানোর কাজ সঠিকভাবে করতে হয়, এর ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ আলো/বাতাস লাগাতে হয়। তাহলেই ভালো অঙ্কুরোদগম ৰমতাসম্পন্ন বীজ পাওয়া যায়। একজন অভিজ্ঞ নারীই বীজ সংরৰণের এ কাজটি সঠিকভাবে করতে পারেন। আদিবাসী ছাড়াও এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন অঞ্চলে মাঠ ফসল উৎপাদনে চারা রোপণ ও তোলার কাজ নারীরা করে থাকেন। শস্য কর্তনোত্তর ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রতিটি কাজে নারীর ভূমিকা স্বীকৃত। এমন কি উদ্ভিদ সংরৰণসহ ভেষজ ওষুধ ব্যবহারে নারীরা প্রধান ভূমিকা রাখছে, যা প্রত্যৰভাবে দৃষ্টিগোচর হয় না। এ ছাড়া বাংলাদেশের বসতবাড়ির সবজি/ফল উৎপাদন ও পশুসম্পদ যেমন- হাঁস-মুরগি, গর্ব-ছাগল প্রভৃতি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় নারীর অংশগ্রহণ শতকরা ৪৫ থেকে ৮৫ ভাগ। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে নারীদের ভূমিকাই প্রধান এবং সবজি বাগান ও পশুসম্পদ থেকে আয়ের ৰেত্রে ২০-৪০ ভাগ অবদান রাখছে নারীরা। মাছ চাষে জেলে পরিবারের নারীরা মাছ ধরার পর মাছ বাছাই/কাটা, বাছা, শুকানো ও বাজারজাতকরণের উপযোগী করার দায়িত্ব পালন করে এবং শুঁটকি?তৈরিতে অবদান রাখছে। বর্তমানে মিঠা পানির মাছ চাষের ৰেত্রে নারীরা বাণিজ্যিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের দায়িত্ব পালন করে। এ ছাড়া নারীরা বর্তমানে?জৈব সার বা কম্পোস্ট ব্যবহারের মাধ্যমে জমির স্বাস্থ্য রৰা করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রত্যৰ অবদান রাখছে।
বর্তমানে আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেৰিতে নারী-পুর্বষের শ্রমে পরিবর্তন আসছে। সচ্ছল খামারি স্থানান্তর হয়ে মুজুরিভিত্তিক খামারির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুর্বষরা কাজের খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে চলে যাচ্ছে। মহিলাদের ওপর কৃষি কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব চলে আসছে। এ ছাড়া কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের ফলে পুর্বষ অর্থকরী ফসল উৎপাদনে নিয়োজিত হওয়ায় জীবনধারণের জন্য নারীকে উৎপাদন করতে হয়। ফলে নারীর কাজের বোঝা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৯ ভাগ নারী যার শতকরা ৮৬ ভাগ বাস করে গ্রামে। মোট নারী শ্রমশক্তির ৭১.৫ শতাংশ নারী কৃষি কাজে নিয়োজিত আর্থসামাজিক অবস্থায় পুর্বষের তুলনায় নারী দারিদ্র্যসীমার প্রায় ৪৩ শতাংশ নিচে বাস করে। এর পেছনে রয়েছে নারী অশিৰা অপুষ্টি,?বৈষম্যমূলক মজুরি, অদৰতা ও মৃত্যুর উচ্চহার, প্রযুক্তির অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক বৃত্তিমূলক ও ব্যবস্থাপনা, প্রশিৰণের অভাব ইত্যাদি এসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তাদের শ্রম-শক্তি কাজে লাগাতে নারীর ৰমতায়ন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অত্যন্ত গুর্বত্বপূর্ণ বিষয়।
বাংলাদেশের পুর্বষ শাসিত সমাজে নারীর অবস্থান সব দিকে দিয়েই অসম/অবহেলিত। বাস্তবে নারী-পুর্বষ একে অন্যের পরিপূরক হয়েও সমপর্যায়ে যেতে পারছে না। মনে রাখতে হবে এ দেশের মানবসম্পদের অর্ধেক নারী। নারী উন্নয়ন ব্যতীত জাতীয় অর্থনীতিতে অর্থবহ উন্নয়ন সম্ভব নয়। তেমনি গ্রামীণ নারীর কৃষি কর্মকা-ের আর্থিক মূল্যায়ন না করলে কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নও সম্ভব নয়।
অতীতে কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতি ছিল না। ১৯৯৮ সনে কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল ‘অন্ন জোগায় নারী’ এ সেৱাগানটি। বর্তমানে কৃষিতে নারীর অধিকতর সম্পৃক্ততার উপযোগী ও প্রতিবন্ধকতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে কৃষি কাজে নারীদের জন্য বাংলাদেশ সরকার জাতীয় পরিকল্পনায় নীতিমালা ও কৃষিনীতি প্রণয়ন করে (১৯৯৯)।
জাতীয় কৃষিনীতি
কৃষি ৰেত্রে নারীদের সম্পৃক্ত করার বিষয়টি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেৰাপটে খুবই গুর্বত্বপূর্ণ। কৃষিতে নারীদের অধিকহারে সম্পৃক্ত করে শহরমুখী জনস্রোত রোধ করা সহজ হবে। জাতীয় কৃষিনীতির আওতায় কৃষি ৰেত্রে নারীর ভূমিকা যথাযথ মূল্যায়নপূর্বক তা বিকাশের জন্য নিম্নোক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
-ফসল তোলার পরবর্তী কর্মকাণ্ড, বীজ সংরৰণ, নার্সারি ব্যবসা, পাটের আঁশ ছাড়ানো, সবজি উৎপাদন, গৃহাঙ্গনে ফুলের চাষ, ফল-ফুল ও সবজি বীজ উৎপাদন, স্থানীয় কৃষি পণ্যভিত্তিক কুটির শিল্প স্থাপন ও পরিচালনা প্রভৃতি কাজ নারীদের জন্য খুবই উপযোগী। - মাঠ ফসল উৎপাদন কর্মকা-ে মহিলারা অংশগ্রহণ করে থাকে বিধায় বাস্তবায়নাধীন নতুন কৃষি সমপ্রসারণ নীতির আলোকে মহিলা কৃষকদের জন্য পৃথক সমপ্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। - কৃষি কর্মকা-ে মহিলারা অবদান রাখার ৰেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণের যথাযথ গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে এবং চিহ্নিত অসুবিধাসমূহ দূরীকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নতুন কৃষি সমপ্রসারণ নীতি কৃষিৰেত্রে সমপ্রসারণ সেবা প্রদানকারী সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে দৰ, কার্যকর ও পরস্পরের সহযোগিতা ও সম্পূরকমূলক সেবা প্রদানে উৎসাহিত করা যাতে কৃষি ৰেত্রে উন্নতি ও সমৃদ্ধি আনয়ন করা যায়। কৃষি তথা কৃষকদের উন্নয়নে নতুন কৃষি সমপ্রসারণনীতির আলোকে সমন্বিত উপায়ে কৃষি সমপ্রসারণ সেবা প্রদান স্থানীয়ভাবে কৃষি ৰেত্রে মহিলাদের সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমস্যা সমাধানের কার্যকর ব্যবস্থাকরণ। সমপ্রসারণ কর্মসূচিতে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা হয়।
কৃষিতে নারীর বর্তমান অবস্থা
সভ্যতার জন্মলগ্ন হতেই কৃষিতে নারীর অবদান রাখছে। বর্তমানে স্থানভেদে বাংলাদেশের নারীরাও কৃষি কর্মকাণ্ডে ঘরে বাইরে কাজ করছে। বিশেষ করে ভূমিহীন, প্রান্তিক কৃষাণীরা আর্থিক প্রয়োজনে মাঠে ও গৃহে কৃষিকাজে সক্রিয়। তাছাড়া পাহাড়ি মহিলারা কৃষি উৎপাদনে প্রধান ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের প্রথম প্রচলিত প্রথা এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক নিয়মাচারে, ধর্মীয় বিশ্বাসে, শিৰায়, দৰতা, প্রশিৰণ, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থানে নারীদের প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত করে। বাংলাদেশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুর্বষরাই নারীর কৃষি কর্মকাণ্ডকে চালিত করে। কৃষি কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ উলেৱখযোগ্য নয়। বাংলাদেশের মহিলারা হয় মজুরিবিহীন অথবা স্বল্প মজুরিতে ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ করে থাকেন। এখনো কৃষি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে মহিলার সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে তা নিম্নরূপ: - নারীর প্রতি পুর্বষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব। - জমি/সম্পদের মালিকানার অভাব। - পর্যাপ্ত প্রশিৰণের অভাব। - পর্যাপ্ত ঋণের অভাব। - পর্যাপ্ত কৃষি সম্পর্কিত তথ্যের অভাব। - লাগসই প্রযুক্তির অভাব। - ফসল বাজারজাত করার জন্য অপর্যাপ্ত বিপণনের ব্যবস্থা। - মহিলা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার সীমিত সুযোগ। -সরকারি/বেসরকারি সংস্থার মাঝে যোগাযোগের/সমন্বয়ের অভাব।
কৃষিতে নারী উন্নয়নের সম্ভাবনা
কৃষি কর্মকাণ্ডে গ্রামীণ নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই নারীর প্রধান সম্ভাবনা। সরকারি-বেসরকারি ও প্রাইভেট সংস্থার সহায়তায় কৃষি উন্নয়নে নারী গুর্বত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
প্রচলিত জ্ঞান ও অনুশীলন
গ্রামীণ নারীর প্রচলিত জ্ঞান ও অনুশীলনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে কৃষি ব্যবস্থাপনা। পরিবেশবান্ধব কৃষি অনুশীলনের মাধ্যমে নারী নিম্নলিখিত ৰেত্রে অবদান রাখতে পারবে - জৈব সারের ব্যবহার - স্থানীয় পদ্ধতিতে বীজ সংরৰণ, গুদামজাতকরণ কৌশল - পরিবেশবান্ধব?জৈব সার প্রস্তুত - স্থানীয় কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার - পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে বীজ আদান প্রদান - স্থানীয়ভাবে বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। গত কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষি উন্নয়নে নারীর উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনের গবেষণায় নিয়োজিত। গবেষণায় উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বাস্তবায়নে নারীরা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে সৰম। আমরা আশা করি কৃষিতে নারী উন্নয়নের ৰেত্রে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সংগঠন/প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার মাধ্যমে নারী উন্নয়নের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও কৃষি উন্নয়নের ৰেত্রে অনেক দূর এগিয়ে যাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।ঙ কৃষি অর্থনীতিবিদ পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন উইং, কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
মহিলা মহান
ReplyDelete