Monday, 19 September 2011

প্রাকৃতিক উপায়ে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ

প্রাকৃতিক উপায়ে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ
মাটি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি পৃথিবীর অধিকাংশ জীবের খাদ্য উৎপাদন এবং বসবাসের মাধ্যম। মাটিকে কেন্দ্র করে সব কৃষিকাজ আবর্তিত হয়। ফসল উৎপাদনে মাটির উপযুক্ত বিকল্প নেই। কৃষি প্রধান এ বাংলাদেশে প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ খুব একটা বেশি নেই। ফলে এদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা কৃষি, যা মৃত্তিকা সম্পদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ভাগ্যের সাথে জড়িত সোনার চেয়ে দামি এ মৃত্তিকা সম্পদ। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এ মৃত্তিকার উর্বরতা আজ হুমকির সম্মুখীন। এক সমীক্ষায় জানা গেছে বাংলাদেশের ৯০ লাখ হেক্টর কৃষি জমির শতকরা ৭৫  ভাগ তার উর্বরতা হারিয়েছে। অধিকমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারই এর প্রধান কারণ বলে ওই সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এর বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গত ঠিক এক দশকে বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির মাটির উর্বরতার মাত্রা শতকরা ২.৫ থেকে নেমে শতকরা ১.৫ এসে দাঁড়িয়েছে। এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর আবাদযোগ্য জমির শতকরা অর্ধেকই তার উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছে। এর ফলে প্রতি বছর প্রায় এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি যৌথভাবে এই সমীক্ষা চালায়। দৰিণ এশীয় অপরাপর দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে জমির উর্বরতা হ্রাস পরিস্থিতি আশংকাজনক। জমিতে অধিক মাত্রায় ও নির্বিচারে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলেই মাটির উর্বরতা শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে একই জমিতে  এভাবে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মাটির অম্লত্ব পরিবর্তিত হচ্ছে, পানি ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে ও অনুজীবের কার্যাবলী ব্যাহত হচ্ছে। এতে মাটির উৎপাদনশীলতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।

ফসল উৎপাদনের সঙ্গে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদিকা ক্ষমতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। মাটির উর্বরতা বলতে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমূহ সরবরাহের ৰমতাকে বুঝায়। অর্থাৎ মাটিকে তখনই উর্বর বলা হবে যখন তাতে কোন উদ্ভিদের পরিপূর্ণ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সব খাদ্য উপাদান সঠিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি, পুষ্টি ও ফলনের জন্য ১৬ টি খাদ্য উপাদন অত্যাবশ্যক। সাধারণভাবে এগুলোকে অপরিহার্য খাদ্য উপাদান বলা হয়। উদ্ভিদ পুষ্টি বিজ্ঞানী ডি আই আরননের মতে, অপরিহার্য খাদ্য উপাদান হচ্ছে ১৬টি, যথা- কার্বন, হাইড্রোজেন, অঙিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, গন্ধক, ম্যাঙ্গানিজ, লৌহ, মলিবডেনাম, দসৱা, বোরন, ক্লোরিন ও তামা। এ উপাদানগুলোর মধ্যে তিনটি উপাদান যেমন- কার্বন, হাইড্রোজেন ও অঙিজেন, উদ্ভিদ, পানি ও বায়ু থেকে গ্রহণ করে এবং বাকি তেরটি খাদ্য উপাদান মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। অনুর্বর মাটিতে ফসলের ফলন হয় কম, আর উর্বর মাটিতে ফলন হয় আশাব্যঞ্জক। সুতরাং অধিক উৎপাদন পেতে হলে মাটির উর্বরতা শক্তি বজায় রাখতে হবে। উদ্ভিদের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানগুলোর মধ্যে নাইট্রোজেন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। এর অভাব হলে গাছ বাড়তে পারে না, নিচের পাতাগুলো হলুদ হয়ে যায়, প্রোটিন সংশ্লেষণ কমে যাওয়ায় কোষ বিভাজন তথা কোষের বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে। এতে ফসলের নানারূপ লক্ষণ ও প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এবং ফলন কমে যায়। উদ্ভিদ নাইট্রোজেন গ্রহণ করে প্রধানত মাটি অথবা সার থেকে। পৃথিবীর প্রায় সব মাটিতে নাইট্রোজেনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের মাটিতে এই নাইট্রোজেনের অভাব  প্রকট। মাটির এ ঘাটতি পূরণে ইউরিয়া (বা এ্যামোনিয়াম সালফেট) সার ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, শ্রমিক মজুরি, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থার অভাব ইত্যাদির ফলে রাসায়নিক সারের মূল্য উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে এই সারের মূল্য স্বাধীনতা উত্তর দামের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি, ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের ক্রয় ক্ষমতার প্রায় বাইরে চলে গেছে।

অপরদিকে একই জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার বিশেষত ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে মৃত্তিকা ও পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। মাটির অমস্নত্ব পরিবর্তিত হচ্ছে, পানি ধারণৰমতা কমে যাচ্ছে ও অনুজীবের কার্যাবলী ব্যাহত হচ্ছে। এতে মাটির উৎপাদনশীলতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে এবং অন্যান্য খাদ্যোপাদানের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

এছাড়া রাসায়নিক সারের মধ্যে ইউরিয়া সারের অপচয় সবচেয়ে বেশি। প্রয়োগকৃত ইউরিয়ার কার্যক্ষমতা প্রায় শতকরা ৩০-৪০ ভাগ। এর মধ্যে শতকরা ২০-৪০ ভাগ নাইট্রোজেন জাতীয় গ্যাস উদ্বায়নের দ্বারা অপচয় হয়। চুনযুক্তক্ষারীয় ও জলাবদ্ধ মাটিতে এ অপচয় বেশি। এ ছাড়া শতকরা ২০-২৫ ভাগ নাইট্রোজেন চুয়ানির মাধ্যমে নাইট্রেট ও নাইট্রাইট আকারে অপচয় হয়। বেলে প্রধান বৃষ্টি বহুল এলাকায় এ অপচয় বেশি। কাজেই মাটিতে  নাইট্রোজেনের অভাব পূরণের ব্যবস্থা নেয়া একান্ত প্রয়োজন।

নাইট্রোজেনের প্রধান ও মৌলিক উৎস হল বায়ুমণ্ডল। বায়ুমণ্ডলে শতকরা ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন রয়েছে। এই নাইট্রোজেন উদ্ভিদ বা প্রাণী কেউ সংবন্ধন করতে পারে না। বেশ কয়েক প্রকার ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন সংবন্ধন করার ৰমতা রয়েছে। তার মধ্যে রাইজোরিয়ামের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এদের বলা হয় নাইট্রোজেন সংবন্ধকীকরণ (Nitrogen fixing) ব্যাকটেরিয়া।

এসব ব্যাকটেরিয়া শুঁটি জাতীয় (Leguminoseae) উদ্ভিদ যথা-মসুর, মুগ, ছোলা, মটর, খেসারি, মাসকলাই, চীনাবাদাম, সয়াবিন, শিম, বরবটি, ধৈঞ্চা, শন, প্রভৃতির শিকড়ে প্রবেশ করে গুটি বা অর্বুদ (Nodul) তৈরি করে। এরা বায়বীয় নাইট্রোজেনকে আহরণ করে যৌগিক পদার্থে পরিণত করে শিকড়ের গুটিতে জমা রাখে। আশ্রয়দাতা উদ্ভিদ আত্তীকৃত নাইট্রোজেন প্রয়োজনে ব্যবহার করে। এর পরিবর্তে ব্যাকটেরিয়া  আশ্রয়দাতা উদ্ভিদ থেকে খাদ্য নিয়ে থাকে। দুটি জীবের মধ্যে পরস্পরের জন্য উপকারী এ ধরনের সহযোগিতাকে বলা হয় ঝুসনরড়ংরং এ বৈশিষ্ট্যের  জন্য শুঁটি জাতীয় ফসলের চাষ করলে জমিতে প্রাকৃতিকভাবে নাইট্রোজেন যোগ হয়। ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এই সঞ্চিত নাইট্রোজেনের পরিমাণ কম নয়। শিকড়ে ভালো গুটি হলে বছরে হেক্টরপ্রতি ৫০-১৫০ কেজি নাইট্রোজেন মাটিতে জমা হতে পারে। যা ১১০-৩৩০ কেজি ইউরিয়া সারের সমান। এর ফলে ইউরিয়া সার ব্যবহারের পরিমাণ কমানো যায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে মৃত্তিকা দূষণ প্রতিরোধে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ক্রপিং প্যাটার্নের পরিবর্তনসহ জীবাণু সার ব্যবহারের দিকে তারা গুরুত্ব আরোপ করছে। আমাদের দেশেও তাই কোন জমিতে প্রথম বছর ধান, গম বা এ জাতীয় দানা শস্য চাষ করার পর দ্বিতীয় বছর ওই জমিতে শুঁটি জাতীয় কোন ফসল চাষের ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য এটি একটি প্রাকৃতিক ও সহজ পদ্ধতি। এতে দেশের দরিদ্র কৃষকগণ যেমন উচ্চ মূল্যে ইউরিয়া সার ক্রয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে, তেমনি আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মৃত্তিকার সহজাত উর্বরতা বজায় থাকবে এবং মৃত্তিকা দূষণ রোধ হবে। 

বাংলাদেশ খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতির দেশ। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ খাদ্যাভাব ও চরম পুষ্টিহীনতার শিকার। দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হচ্ছে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য ও অর্থকরী ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পাশাপাশি আর্থিক কাঠামো মজবুত করা। বর্তমানে দেশে খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। আগামী ২০২০ সন নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটিতে উন্নীত হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এর  দরুন খাদ্য ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, হাটবাজার, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি তৈরির জন্য কৃষি জমির পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে কমে যাবে। তখন খাব কি? অথচ বাঁচতে আমাদের হবেই। আর বাঁচতে হলে সীমিত জমি থেকেই অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু মাটি তার উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেললে খাদ্য উৎপাদনে ভাটা পড়বে এবং বর্ধিত খাদ্য উৎপাদনে দারুণ সংকট দেখা দেবে।

মাটি আসলে মায়ের মতো, ফসল যেন তার সনৱান। আমরা যদি মাটিকে মায়ের মতো যত্ন করি, তাহলে এ সমস্যার দ্রুত উন্নতি হতে পারে। মায়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকলেই কেবল শিশুরূপ ফসলের স্বাস্থ্য ভালো হতে পারে অর্থাৎ ফলন বেশি হতে পারে। এদিকে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশের সবাইকে আরো বেশি দৃষ্টি রাখত হবে।

No comments:

Post a Comment