Monday, 19 September 2011

সাম্প্রতিক কৃষি এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত সংবাদ পর্যালোচনা যথেচ্ছা ব্যবহার ও চোরাচালান বন্ধে ইউরিয়ার মূল্য বৃদ্ধি

সাম্প্রতিক কৃষি এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত সংবাদ পর্যালোচনাযথেচ্ছা ব্যবহার ও চোরাচালান বন্ধে ইউরিয়ার মূল্য বৃদ্ধি : কৃষিমন্ত্রী
বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে ইউরিয়া সারের মূল্য অত্যন্ত কম। অর্থাৎ কেজিপ্রতি ১২ টাকার স্থলে বর্তমান ২০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। এরপরও সরকারকে ৩ হাজার ৩২০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। যা দেশের জন্য অশনি সংকেত। সারের দাম কম হওয়ায় কৃষক একচেটিয়া ইউরিয়া ব্যবহার করে থাকে। অন্যান্য অতীব প্রয়োজনীয় সার বিশেষ করে টিএসপি, এমপি, জিপসাম, গন্ধক সার, দস্তা সার খুবই কম ব্যবহারের ফলে জমির ঊর্ধ্বরতা শক্তি হ্রাস এবং ফলন কম হচ্ছে। এছাড়া অকৃষি খাত যেমন মুড়িভাজা, প্লাস্টিক কারখানা, পারটেক্স তৈরিতে যথেচ্ছ ইউরিয়া ব্যবহার করে একদিকে যেমন অপচয় হচ্ছে অপর দিকে সীমান্ত পথে চোরাচালান হচ্ছে। যা দেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয়। তাই নন ইউরিয়া সারের প্রতি কৃষকদের আকৃষ্ট করার জন্য ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধি যুক্তিসঙ্গত। একই সাথে গুটি ইউরিয়া ১ বার ব্যবহার করে ২০% ইউরিয়া সাশ্রয়সহ অপচয় রোধ হবে।

বান্দরবানে ও কক্সবাজারে উৎপাদিত হচ্ছে বিশ্বমানের কফি যা দেশের জন্য আশার বাণী পরীক্ষামূলকভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বান্দরবান এবং কক্সবাজারে কফি চাষ শুরু হয়েছে। যা সত্যি খুবই আশাব্যঞ্জক এবং দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে ভূমিকা রাখবে। উঁচু জমি, যেখানে বৃষ্টির পানি জমে না তেমন মাটিতে কফি জন্মানো খুবই সহজ। বাড়ির আঙিনায়, বাড়ির উঠানে, এমনকি গাছের ছায়ায় শুধু ঘেরা দিয়ে এবং বছরে ২ বার পরিচর্যা ও সুষম সার প্রয়োগে লাগানোর ২ বছর পর হতে কপি ধরা শুরু হয়। চা, কফি সারাবিশ্বে এমনকি বাংলাদেশের পানীয় হিসেবে এর কোনো বিকল্প নেই। এক কাপ চা সাধারণত ৫-১০ টাকা কিন্তু ১ কাপ কফি ২০-৩০ টাকা। এর চাহিদাও প্রচুর এমনকি বিদেশ রফতানির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ১৯৮৭ সনে হর্টিকালচার সেন্টার, গৌরীপুর, ময়মনসিংহের টিন শেড অফিসের সামনে আধা ছায়ায় সমতল ভূমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ৮-১০টি কফি চারা লাগানোর ব্যবস্থা করি। বৃষ্টির সময় টিনের চালার পানি গোড়ায় পড়তো। তাতেও মাত্র ১ বছর পর হতে কফি ধরা শুরু হয়। ২ বছরে গাছের উচ্চতা ২.৫০-র্৩ ফুট লম্বা হয়ে গাছ ভর্তি কফি ফল ধরে। এতে বুঝা যায় একটু যত্ন নিলে বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায় কফি চাষ সম্ভব। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে বিদেশেও রফতানি করা যাবে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনেক আগেই এ নিয়ে কাজ করলে দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব হতো। এ ব্যাপারে সরকারের বিশেষ নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে। অন্তত দেশের চাহিদা মেটাতে পারলেও কয়েকশ’ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

বাংলাদেশে পাম চাষ : উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ও লাভজনক
বাংলাদেশে যে পরিমাণ ভোজ্যতেল উৎপাদিত হয় তা চাহিদার মাত্র ২২%। বাকি তেল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় এবং এতে প্রায় খরচ হয় ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে কেবলমাত্র সরিষার ভোজ্যতেল হিসেবে অধিকহারে উৎপাদিত হয়। তাও সব জেলায় সম্ভব নয়। তারপর রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পোকার আক্রমণ, সময়মতো বৃষ্টি, সেচের অভাব। এ ক্ষেত্রে পাম গাছ লাগিয়ে অন্তত ৫০% ভাগ তেল আমদানি কমানো যেতে পারে। মালয়েশিয়া পামগাছের আদি নিবাস সুদূর আফ্রিকা থেকে শোভাবর্ধনের জন্য ১৯১১ সনে নিয়ে আসে। ১৯১৭ সনে একে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে বর্তমানে ৬.৫০ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। সাড়ে ৩ লাখ শ্রমিক তাতে নিয়োজিত। বাংলাদেশের ব্যক্তি উদ্যোগে মালয়েশিয়া থেকে পাম চারা এনে ১৯৯৭ সনে ঘাটাইল, টাঙ্গাইলের ওসমান গণী পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করে সফলতা অর্জন করে ‘হেলেন কেলার ও মাদার তেরেসাঁ পদক’ অর্জন করে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বা বাড়ির আঙিনায় কমপক্ষে ৫টি এবং এর অধিক নারিকেল গাছ রয়েছে। তেমনি প্রতি বাড়িতে কমপক্ষ যদি ২ থেকে ৫টি পাম গাছ লাগানো হয় তাতে প্রতি পরিবারের বার্ষিক চাহিদা পূরণ সম্ভব। এর জন্য তেমন কোনো বড় কারখানা বা ঘানির প্রয়োজন হয় না। এর চেয়ে সহজ পদ্ধতি হতে পারে না। নারিকেল থেকে নারিকেল তেল আহরণের যত কঠিন ও সময় সাপেক্ষ তার অর্ধেক সময় প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশেষভাবে ফল থেকে মাংস আলাদা করে সিদ্ধ করতে হয়। যা ঠাণ্ডা করে  হাত দিয়ে কচলিয়ে নিংড়িয়ে কাপড়ে দিয়ে ছেঁকে পাতিলে জাল দিয়ে পানি বাষ্পিভূত করলেই তেল পাওয়া যাবে। তাই আপার সম্ভাবনাময় ও এ শিল্পকে অতি দ্রুত প্রকল্প প্রণয়ন করে প্রতিটি উপজেলায় কৃষকের বাড়িতে ৫টি করে চারা সরবরাহ করা হলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে কোনো কৃষক পরিবার বাজার থেকে তেল না কিলে পারিবারিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে। একইভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং সয়াবিন তেলের মূল্য বৃদ্ধির যাঁতাকল থেকে সাধারণ মানুষ রেহাই পাবে।

দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে চাষযোগ্য ২১ প্রজাতির ফসলের বীজ উদ্ভাবন
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর জমি লবণাক্ততা ও লবণাধিক্যের কারণে পতিত পড়ে থাকতো। শস্য বহুমুখীকরণের আওতায় নানাবিধ ফসলের চাষ ছিল অসম্ভব। ওই সকল জমিতে ৬-২০ ডিএস পর্যন্ত লবণাক্ততা বিদ্যমান। সাধারণত ১০ ডিএসএর উপরে লবণ মাত্রা থাকলে কোনো ফসল ফলানো সম্ভব হতো না। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাতক্ষীরার বিনেরপেতা গবেষণা উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিকরা দীর্ঘদিন গবেষণা করে দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা সহনশীল ২১ ধরনের ফসলের চাষ উপযোগ্য জাত উদ্ভাবন করেছেন। যা দেশের খাদ্য শস্য উৎপাদনে নতুন এলাকা সংযোজন হলো। ২০১৫ সনের মধ্যে কৃষকদের জন্য সরবরাহযোগ্য ২১টি ফসলের সব কটি জাত সরবরাহ করতে পারবে। আশার কথা হলো, এ বছরই মুগডাল, আলু, মাসকলাই, বারি টমেটো ৫ এবং ৬ বীজ সরবরাহের ব্যবস্থা করছে। গবেষণালব্ধ ফসলের মধ্যে বর্তমান পরীক্ষাধীন রয়েছে সয়াবিন, সরিষা, গোলআলু, মিষ্টিআলু, কুমড়া, বাঁধাকপি, ওলকপি, টমেটো, ভুট্টা, বার্লি, গম, বাদাম, তিল, মুগডাল, কউপি (ফেলন ডাল), খেসারি, তরমুজ, বাঙ্গি, ঢেঁড়স, করলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব ফসলের জাত নির্ধারণসহ বীজ সরবরাহ দেয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে খুলনা, সাতৰীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, নোয়াখালী চরাঞ্চলসহ হাজার হাজার হেক্টর জমি লবণাক্ততা কারণে পতিত না থেকে চাষ আবাদযোগ্য হলে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে এবং তাদের পরিবারে জীবনমান উন্নয়ন ও আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে।

সুগারবিট আবাদ : শতকরা ১৪-২০ ভাগ হারে চিনি উৎপাদন সম্ভব
দেশের আখের বিকল্প হিসেবে সুগারবিট আবাদ পরীক্ষামূলকভাবে ফলপ্রসূ হওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে চিনি উৎপাদনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব হবে। সারা বিশ্বে ৩০-৩৫ ভাগ চিনি উৎপাদিত হয় সুগারবিট থেকে। বাংলাদেশের মাটিতে ও সুগারবিট চাষ করে অল্প সময়ের ফসল হিসেবে সুগারবিট থেকে ১৪%-২০% চিনি আহরণ সম্ভব। যা আখের চেয়ে (৮%-১০%) ডবল। সুগার বিটের উৎপাদন ও আখের চেয়ে বেশি অর্থাৎ হেক্টরপ্রতি ৩৫-৬৩ টন পর্যন্ত পাওয়া যায়। আখ চাষে সময় লাগে ১২-১৫ মাস সুগারবিটে সময় লাগে মাত্র ৫-৬ মাস। অর্থাৎ বাকি ৬ মাস অন্য ফসল আবাদ করা যাবে। এর চাষ পদ্ধতিও সহজ। মুলা, শালগম, ওলকপির মতো চাষ করতে হবে। দেখাতে অনেকটা শালগমের মতো। আখের জন্য যেমন ট্রেইলর বা ট্রলিতে অনেক জায়গায় প্রয়োগ হয়। সুগারবিট পরিবহনেও জায়গা লাগে অনেক কম। অর্থাৎ শালগম বা বড় গোল আলুর মতো সাইজ (ওজন) হয় সুগার বিট। তাই পরিবহন ও সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ খুবই সহজ। তাই সুগারবিট থেকে চিনি উৎপাদনে শুধু সরকারি উদ্যোগ নয় পাশাপাশি বেসরকারি ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তারা উদ্যোগ নিয়ে প্রয়োজনে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় এনে এ শিল্প বিকশিত করা এখন কেবলমাত্র সময়ের দাবি।

কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে প্রায় ১ কোটি কৃষকের ১০ টাকার ব্যাংক হিসেবে খোলা : কৃষি ঋণ বিতরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে ১২ মে ২০১১ পর্যন্ত ৯৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৪২ জন কৃষক ব্যাংক হিসাব খুলেছেন। যা দেশের কৃষি উন্নয়ন তথা কৃষি উপকরণ সহায়তা প্রাপ্তি, কৃষি ঋণ গ্রহণ ইত্যাদি কাজে কৃষক উপকৃত হবে এবং তাদের মধ্যে সঞ্চয় করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। কোনো কৃষকের যদি কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড থেকে থাকে তাহলে ওই কৃষককে কোনো ফর্ম পূরণ করতে হবে না। মাত্র ১০ টাকা জমা দিয়ে আমানত হিসাব খুলতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত বছর ১৭ জানুয়ারি সার্কুলার বলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন যে কোনো ব্যাংকের এ হিসাব খোলা যাবে। এ হিসাবে (একাউন্ট) ন্যূনতম স্থিতি রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। ব্যাংকগুলো কোনো চার্জ বা কোনো ফি এ হিসাব থেকে নিতে/কর্তন করতে পারবে না। এমনকি চেক বই এর অপ্রতুলতা থাকলে সে ৰেত্রে তার পরিবর্তে ভাউচারের মাধ্যমেও হিসেবের লেনদেন করতে পারবে। কৃষকের পাশাপাশি সম্প্রতি সমাজের অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দেয়া হয়েছে। যা দেশের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বর্তমান অর্থবছরে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের লৰ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১২ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ৮০% এর বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। পূর্বের বছর এ সময়ে মাত্র ৭১% ঋণ বিতরণ করা হয়। বর্তমান বছর শতভাগ কৃষি ঋণ বিতরণ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো নীতিমালার অভাবে এর আগে কোনো বর্গাচাষি ঋণ পেত না। এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ২শ’ কোটি টাকা বর্গাচাষিদের মাঝে বিতরণ করা হয়। ১০% সুদে প্রতি কৃষক ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন। যা কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তন এবং কৃষি কাজে আগ্রহ বাড়াতে সুবিধা হবে।

নতুন অর্থবছরে ৩০ লাখ টন ইউরিয়া সারের চাহিদা নির্ধারণ
চলতি ২০১১-২০১২ অর্থবছরের জন্য ইউরিয়া সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। জানা গেছে, নতুন অর্থবছরে যাতে সারের কোনো ঘাটতি না হয় সেজন্য এখন থেকেই চাহিদা পূরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তাই ৩০ লাখ মে. টন ইউরিয়া সারের চাহিদার আলোকে ১০ লাখ মে. টন দেশের সার কারখানা থেকে প্রাপ্তিসহ বাকি ২০ লাখ মে. টন আমদানির ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চুক্তি আওতায় ৮ লাখ মে. টন। আনৱর্জাতিক দরপতের মাধ্যমে ৮ লাখ মে. টন এবং কাফকো (কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি, চট্টগ্রাম) থেকে নেয়া হবে বাকি ৪ লাখ মে. টন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ইউরিয়া সার ব্যবহার হয় ২৪ লাখ মে. টন। বিদায়ী অর্থবছরে (২০১০-২০১১) ইউরিয়া সার ব্যবহারের লৰ্যমাত্রা ছিল ২৭ লাখ মে. টন। এতে বুঝা যায় দিন দিন ইউরিয়া সারের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তাই আমাদের ডিএপি সার গুটি ইউরিয়াসহ নন ইউরিয়া সার ব্যবহারে দিকে নজর দিতে হবে।

ইঁদুর নিধন : শত কোটি টাকা খরচ করে ১২ হাজার কোটি টাকার ফসল রক্ষা

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর এক প্রশ্ন উত্তরে জানা যায়, ইঁদুরের আক্রমণে গত অর্থবছরে ৪৮১ কোটি ৫০ লাখ টাকার কৃষিপণ্য নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ধান ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা, গম ৪৪ লাখ টাকা।

এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, ইঁদুরের আক্রমণে শুধু ধানগমই নষ্ট হচ্ছে না অন্যান্য কৃষি পণ্য যেমন আখ, ডাল, সরিষা, ভুট্টা, নারিকেল, সুপারি, গুদামজাত ও গোলায় সংরক্ষিত শস্যসহ অন্যান্য শস্য নিয়ে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। যা দেশের খাদ্য ঘাটতি এবং খাদ্য নিরাপত্তায় বিশেষ হুমকি স্বরূপ। তাই ইঁদুর নিধনে বা নিয়ন্ত্রণে আলাদা বাজেট রাখতে হবে। এতে ১০০ কোটি টাকা খরচ হলেও ১ হাজার কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ ফসল রক্ষা করতে পারবে। যা জাতীয় উন্নয়নে বিরাট মাইল ফলক স্থাপনসহ ইঁদুর কর্তৃক পেস্নগসহ অন্যান্য মারাত্মক সংক্রমণ জীবাণু বহনে ব্যবহার করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। শুধু তাই নয় দরিদ্র পরিবারে ঘরের ভিটায়, মাটি খুঁড়ে বাসা বেঁধে, লেপ, তোষক, কাঁথা, বালিশ, বিছানা, কাপড় চোপড় কেটে টুকরা করে আরো কয়েক কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করে থাকে। তাই এ ব্যাপারে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহায়তা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা রয়েছে।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্মশালা : কৃষক ৬০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষি যন্ত্র পাবেন
দেশের কৃষকদের মধ্যে ৬০% ভর্তুকি মূল্যে কৃষিযন্ত্র বিক্রির সফল উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আপাতত ১০ জেলার ২০ উপজেলা বাছাই করা কৃষকরা ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই, সার প্রয়োগ ও নিড়ানি যন্ত্রসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্র কেনার জন্য এ সুযোগ পাবেন। প্রাথমিক পর্যায়ে গাজীপুর, গাটবান্ধা, জয়পুরহাট, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, চাঁদপুর ও নোয়াখালী জেলার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। ব্রি-ছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পৃথক পৃথকভাবে এ ধরনের কৃষি যন্ত্র বিতরণ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
ড. হাসানুজ্জামান : প্রথিতযশা ধান বিজ্ঞানী বার্ধক্যজনিত রোগে শয্যাশায়ী

এদেশের ইতিহাসে ধান গবেষণা ও উফশী জাত উদ্ভাবনের পথ প্রদর্শক হিসেবে অন্তত সর্বাগ্রে স্মরণ করতে হলে একটি নাম উচ্চারণ করতে হবে তিনি ড. হাসানুজ্জামাস। আন্তর্জাতিক বিশ্বে ‘ব্রি’ কে পরিচিতি করা, ইরি’র (ইন্টারন্যানাল রাইস রিচার্চ ইনস্টিটিউট) এর সান্বিদ্ধে এসে তার নিজের হাতে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে উফশী ২৪টি জাতের ফসল উদ্ভাবন ও ড. হাসানুজ্জামান এর অবদান অনম্বিকার্য। যা দেশের জন্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। অনেকেরই জানা নেই কী বিশাল অবদান তার এ দেশের ধান গবেষণায়। ১৯৬৯ সন থেকে ধান বিশেষজ্ঞ (ইকোনমিক বোটানিস্ট) হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠালগ্নে সহকারী পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের প্রথম মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৮৪ সনে অবসরগ্রহণ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বেই বহাল থেকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে নিয়ে গেছেন কৃতিত্বপূর্ণ অবস্থানে। বাংলাদেশের প্রথম রাইস ব্রিডার হিসেবে ধান গবেষণায় তার নেতৃত্বেই আসে যুগান্তকারী সাফল্য।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে নব্বই-এর দশক পর্যন্ত উফশী জাতের যে ধানগুলোর আবাদ শুরু করে, তার সবই ড. হাসানুজ্জামানের উদ্ভাবিত। তার হাত ধরেই ব্রি সাফল্যের শিখরে পৌঁছে এ পর্যন্ত ৫৪টি জাত উদ্ভাবন করে। তার পথ ধরে এদেশের অনেক বিজ্ঞানী তৈরি হয়েছেন, দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন শত শত বিজ্ঞানী। ৮৬ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত নানা রোগ নিয়ে তিনি আজ শয্যাশায়ী। হাসপাতালে চিকিৎসা করার মতো আর্থিক সঙ্গতিও তার পরিবারের নেই। তাই সরকারসহ সচেতন নাগরিক, কৃষিবিদ এ বরণ্যে ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

ধাপ তৈরি ও চাষাবাদ কৌশল

ধাপ তৈরি ও চাষাবাদ কৌশল

প্রাকৃতিক লীলা বৈচিত্র্যে ভরা আমাদের এই বাংলাদেশ। হাওর, বাঁওড়, বিল, ঝিল এলাকার জমি বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে ডুবে থাকে। এসব নিচু/অতি নিচু এলাকায় পানির ওপরে ভাসমান অবস্থায় কচুরিপানা, খড় বা অন্য কোন উপাদান পচা বা আধাপচা অবস্থায় জড় করে আয়তাকার/চতুর্ভূজাকার/গোলাকার সূপ তৈরি করা হয়। আর এই সূপই ‘ধাপ’ নামে পরিচিত।

প্রেক্ষাপট
হাওর, বাঁওড়সহ অন্যান্য নিচু/অতি নিচু এলাকার জমি বছরের প্রায় অধিকাংশ সময়ই পানিতে ডুবে থাকে। এসব এলাকাগুলোতে বড়জোর রবি শস্য/বোরো ধান চাষাবাদ করা যায়। রবি শস্য/বোরো ধান সংগ্রহ করার পর পরই জমিগুলো পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়। আর এই সময় কৃষক তার অলস সময় কাটায় ঘরে বসে। এই পরিস্তিতিতে কৃষক তার খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারে ধাপে সবজি চাষ করে। অবশ্য ধাপে সবজি চাষ নতুন কিছু নয়। আবহমান কাল থেকেই প্রগতিশীল কৃষকরা সফলতার সাথে ধাপে সবজি চাষ করে আসছে।

ধাপ তৈরির সময়
পানিতে ভাসমান কচুরিপান ও জলজ উদ্ভিদ দিয়ে ধাপ তৈরির সময় হল মধ্য জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত। কোন কোন সময় ওই রকম ধাপ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসেও তৈরি করা হয়। নাড়া ও খড় দিয়ে ধাপ তৈরি করা হয় সাধারণত বোনা আমন আবাদের এলাকায় আমন আবাদের এলাকায় বোনা আমন ধান কাটার পরে।

ধাপ তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ
কচুরিপানা, বিভিন্ন ভাসমান পচা ও আধাপচা জলজ উদ্ভিদ, খড়, নাড়া, ফসলের আগাছা ও আবর্জনা, আখের ছোবড়া, কাঠি, নৌকা, ২/৩টি বাঁশের টুকরা (৩-৪ হাত) অথবা ২/৩টি লম্বাডাল, ঝুড়ি, দড়ি প্রভৃতি।

ধাপের আকার আকৃতি
ধাপ তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণের প্রাপ্তি ধাপে ফসল আবাদের শ্রেণী, ধাপ রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরবর্তীতে অবশিষ্ট পচনকৃত কম্পোস্ট/ জৈব সারের ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে ধাপ সাধারণত গোলাকার, চতুর্ভূজাকার ও আয়তকার হয়ে থাকে। যেহেতু এটি বৈজ্ঞানিক উপায়ে গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি না সেহেতু এর কোন আদর্শ পরিমাপ নেই। তবে স্বাভাবিকভাবে-

(ক)    কচুরিপানা ও অন্যান্য পচা ও আধাপচা জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি ধাপের ক্ষেত্রে :
(১)     চতুর্ভূজাকার ধাপ : দৈর্ঘ্য ৫-১০ মিটার, প্রস্থ ২-৩ মিটর, উচ্চতা ১ মিটার।
(২)     আয়তাকার ধাপ : দৈর্ঘ্য ১০-২০  মিটার, প্রস্থ ২-৩ মিটার, উচ্চতা ১ মিটার।
(৩)     গোলাকার ধাপ : ব্যাসার্ধ ২-৫ মিটার, উচ্চতা ১ মিটার।
(খ)     নাড়া ও খড় দিয়ে তৈরি ধাপের ক্ষেত্রে :

কচুরিপানা ও জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি ধাপের মতোই তবে উচ্চতা বেশি। উচ্চতা সাধারণত ১.৫-২.০ মিটার।
বি: দ্র: ধাপ তৈরি উপাদানের প্রাপ্তি বেশি হলে এর প্রস্থ ঠিক রেখে দৈর্ঘ্য প্রয়োজন মতো বাড়ানো যেতে পারে।।

ধাপ তৈরির পদ্ধতি :
(ক) কচুরিপানা ও অন্যান্য পচা ও আধাপচা জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি ধাপ

(১) বর্ষার পানিতে যখন কচুরিপানাগুলো দ্রম্নত বংশ বিসৱার শুরম্ন করে তখন, অর্থাৎ জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয় কচুরিপান সংগ্রহের কাজ।
(২) প্রয়োজনীয় শ্রমিক কাঙ্ক্ষিত উপকরণ নিয়ে পানিতে ভাসমান কচুরিপানার কাছে যেতে হবে।
(৩) পানির গভীরতার ওপর নির্ভর করে প্রয়োজন হলে নৌকায় করে নির্বাচিত জায়গার ওপর ২/৩ খণ্ড বাঁশের মাঝারি (৩-৪ হাত) টুকরা আড়াআড়ি করে অথবা ২/৩ খানা লম্বা ডাল ফেলতে হবে।
(৪) প্রথমে নিচের দিকে বড় আকারের কচুরিপানা এবং পরে উপরের দিকে ছোট আকারের কচুরিপানা জড় করে স্তূপ তৈরি করতে হবে।
(৫) প্রাথমিকভাবে এক বর্গমিটারের একটি ছোট ধাপ তৈরি করতে হবে। ধাপটির চারপাশে আরো কচুরিপানা দিয়ে স্তূপ করতে হবে যাতে স্তূপের  ওপরে অন্তত ১ জন কৃষক উঠে দাঁড়াতে পারে। পরে চারপাশ থেকে আরো কচুরিপানা লাঠি/কাঠি দিয়ে টেনে টেনে ওই স্তুপের ওপর এবং পাশে ফেলতে হবে।
(৬) এভাবে স্তূপ একটু বড় হলে, ধাপ দ্রুত প্রস্তুত করতে হলে আরো ২/৩ জন কৃষক তার ওপর উঠে কমপক্ষে ২-৩ মিটার চওড়া করে যতদূর সম্ভব ৫-২০ মিটার লম্বা ও ১-১.৫ মিটার উঁচু করে ধাপ তৈরি করতে হবে।
(৭) ধাপ তৈরি শেষের দিকে কচুরিপানাগুলোর শিকড় উপরের দিকে এবং কাণ্ডগুলো নিচের দিকে করে আস্তে আস্তে প্রস্ত থেকে দৈর্ঘ্যের বরাবরে সাজাতে হবে এবং লক্ষ রাখতে হবে উত্তোলিত কচুরিপানার ভেতরে যেন কোন কলমি, মালঞ্চ ও দুর্বা না থাকে।
(৮) প্রস্তুতকৃত ধাপের উপরিভাগ হাত বা কোন কাঠি দিযে সমতল করে দিতে হবে।

(খ) নাড়া ও খড় দিয়ে তৈরি ধাপ
১) প্রয়োজনীয় উপকরণ ও শ্রমিক নিয়ে জমিতে যেতে হবে।
২) যে জায়গায় ধাপ বানাতে হবে সেই জায়গা নির্বাচন করতে হবে।
৩) তারপর থোড়া ও ঝুড়ির সাহায্যে “ক” এর অনুরূপভবে সুন্দর করে সাজিয়ে সাজিয়ে পা দিয়ে পাড়িয়ে ধাপ তৈরি করতে হবে।

আবাদযোগ্য শাক সবজি
একক ফসল হিসেবে হলুদ, লাল শাক, পালং শাক, ঢেঁড়স, শসা, পানিকচু, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, বরবটি, ঝিঙা, মরিচ, করলা, চিচিঙা, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, ফুট ইত্যাদি।

আন্ত:ফসল হিসেবে
১)     মাঝে হলুদ+চারপাশে লাউকুমড়া/শসা
২)     মাঝে (হলুদ+ঢেঁড়স)+তার চারিপার্শ্বে পানিকচু
৩)     হলুদ+ ডাঁটাশাক
৪)     মাঝে ঢেঁড়স+চারপাশে লাউকুমড়া
৫)     মাঝে (পানিকচু+ঢেঁড়স)+ চারপাশে ঝিঙা/ফুট
৬)     মাঝে হলুদ+চারপাশে পানিকচু

বীজ বপনের উপযোগীকরণ ও বীজ বপন
প্রস্তুতকৃত ধাপটি প্রথমে সুবিধাজনক স্থানে রাস্তা বাড়ির কাছে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বীজ বপনের জন্য ধাপ তৈরি শেষে কচুরিপানার শিকড়ের ওপর গোবর ও কাদা মিশিয়ে ২-৩ ইঞ্চি পুরু প্রলেপ দিতে হবে। উল্লেখ, এর সাথে সামান্য ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে কচুরিপানা দ্রুত পচে চাষাযোগ্য হয়। এভাবে ১০-১২ দিন পচানোর পর বীজ বপন করা যায়। গোবার, কাদার পরিবর্তে গত বছরের পুরনো পচা ধাপ কম্পোস্ট স্তূপ ৬-৮ ইঞ্চি পুরু করে দিলে তখনই শাকসবজির বীজ বপন করা যায়। ধাপে জমির তুলনায় ঘনভাবে বীজ বপন করা যায়।

পরিচর্যা
সার : ধাপে সারের তেমন প্রয়োজন হয় না। কারণ ধাপটি একটি উন্নতমানের কম্পোস্টে পরিণত হয়। ফলে শাকসবজি তার প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান ধাপ থেকে গ্রহণ করতে পারে। গোবর গোলা প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। তবে কোনো কারণে গাছের বাড় বাড়তি কম পরিলক্ষিত হলে রোপণের ৪০-৫০ দিন পরে সামান্য ইউরিয়া প্রয়োগ করা যেতে পারে।

পানি : ধাপ পানির উপরে থাকে বলে পানি দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
রোগ : ধাপের রোগবালাই এর আক্রমণ সাধারণত হয় না, হলে একটি পাত্রে ১-২ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম তুঁতে, অন্য একটি পাত্রে ১-২ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম চুন মিশাতে হবে। পরে অন্য একটি পাত্রে চুন ও তুঁতের মিশ্রণ এক সাথে করে (বোর্দোমিক্সার) সঙ্গে সঙ্গে স্প্রে করতে হবে।

পোকামাকড় : পোকামাকড়ের আক্রমণ হয় না বললেই চলে। যদি হয় তাহলে আইপিএম পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
অন্যান্য : ধাপটাকে একটি বড় দড়ি দিয়ে বা কাঠি দিয়ে বেঁধে রাস্তার ধারে বা বাড়ির কাছে রাখতে হবে যাতে বন্যার পানি এটাকে ভাসিয়ে নিতে না পারে। রাস্তার ধারে বা বাড়ির কাছে লাউকুমড়া জাতীয় ফসল আবাদের ক্ষেত্রে মাচা তৈরি করে দিতে হবে। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে উক্ত কোম্পাস্ট ধাপটি সুবিধামতো নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে শীতকালীন শাকসবজি চাষাবাদ করা যায়।
ফসল সংগ্রহ : বীজ বপনের নির্দিষ্ট সময় পর ফসল সংগ্রহ করতে হবে। আন্ত:ফসল ক্ষেত্রে যে ফসল আগে পরিপক্ব বা সংগ্রহ উপযোগী হবে তা আগে সংগ্রহ করতে হবে।

সুবিধা
১।    মাটির লবণাক্ততা ও পানি নিষ্কাশন সমস্যা দূর করা যায়।
২।    বিভিন্ন বালাইয়ের (পোকা, রোগ জীবাণু, আগাছা) জীবনচক্র ব্যাহত হয়। ফলে এসব বালাইয়ের আক্রমণ কম হয়।
৩।    ধাপে জমির তুলনায় ঘনভাবে বীজ বপন করা যায়।
৪।    যেখানে চাষাবাদের জন্য পর্যাপ্ত জমি নেই সেখানে ধাপে চাষ করা যায়।
৫।    সেচ, সার, বালাইদমন বাবদ খরচ একেবারেই লাগে না।
৬।    তেমন পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না।
৭।    অবসর সময়কে কাজে লাগানো যায়।
৮।    জলজ উদ্ভিদকে কাজে লাগিয়ে নতুন ফসলী জমি সৃষ্টি করা সম্ভব।
৯।    মশা মাছির বৃদ্ধি বিঘ্ন ঘটায়।
১০।   পতিত নিচু জলাশয়ের সদ্ব্যবহার করা যায়।
১১।    ধাপের উপরে ফসল চাষ এবং নিচে মাছ চাষ করার ৰেত্রে কোনো সমস্যা থাকে না উপরন্তু মাছের খাবার হয়।
১২।    উৎপাদিত ফসলের ফলন স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি এবং মান কোন অবস্থাতেই কম নয়।
১৩।   এক বছরের ধাপ আগামী বছরের ফসলী জমির জন্য বিশেষ কম্পোস্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহারের ফলে মাটির বুনটের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন হয়।
১৪।    হাওড়, বাওড় ইত্যাদি নিচু ও জলাবদ্ধ এলাকায় শতভাগ লাভ হয়।
১৫।   বন্যার সময় বাড়ি নিমজ্জিত হয়ে গেলে ধাপ তৈরি করে তার ওপর হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল এমনকি কি মানুষ বাসা বেঁধে বসবাস করতে পারে। পরবর্তীতে ফসল আবাদ করা যায়।
১৬।   ধাপ সুবিধা মতো জায়গায় সময় মতো স্থানান্তর করা যায়।

অসুবিধা
১।    ধাপে শাকসবজি চাষের মানসিকতা ও অজ্ঞতার অভাব।
২।    ধাপ পাতলা হলে ফলন কম হয় এবং ধাপের ওপর উঠা যায় না।
৩।    ভালো জাতের বীজের অভাব।
৪।    পরিবহনের অভাবজনিত কারণে বাজারজাতকরণের সমস্যা।
৫।    কৃষকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব।
৬।    কৃষকের আর্থিক সমস্যা।
৭।    ব্যাপক সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কচুরিপানাসহ অন্যান্য উপকরণের অভাব।

সম্ভাবনা
প্রাকৃতিক এই রঙ্গমঞ্চে কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ পচা ও আধাপচা উদ্ভিদ, নাড়া, খড়কে কাজে লাগিয়ে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব তেমনি পানিতে কম্পোস্ট সার তৈরির মাধ্যমে শূন্য বা এক ফসলি জমিতে দুই বা বহু ফসলি জমিতে রূপান্তর করা সম্ভব। এতে করে দেশের মোট ফসলি জমি বাড়ানো সম্ভব। এভাবে ফসল ফলানো সম্ভব ফলে দেশে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানোর মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও পুষ্টির চাহিদা মিটানো সম্ভব।
হলুদ চাষ (প্রতি শতকে)

লাভ : ধাপে=৭০০০ টাকা-৪৫০ টাকা=৬৫৫০ টাকা
জমিতে= ৫৬০০ টাকা-৫৫০=৫০৫০ টাকা
(বিঃ দ্রঃ যদি আগাম/বিলম্বে আবাদ করা যায় তাহলে লাভ দ্বিগুণ হতে পারে।)

পাটের পচন ও মান উন্নয়ন

পাটের পচন ও মান উন্নয়ন

পাট বাংলাদেশের একটি অর্থকরী ফসল। আঁশের গুণাগুণের ওপর পাটের মূল্য নির্ভর করে। ভালোমানের আঁশের দাম বেশি এবং নিম্নমানের আঁশের দাম কম। কি কারণে পাট আঁশের  গুণাগুণ খারাপ হয় এ ব্যাপারে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। দেখা যায়, বিশেষ করে পাট পচন পদ্ধতির তারতম্যের জন্যই পাট আঁশের গুণাগুণের তারতম্য হয়। যদি উন্নত ও উৎকৃষ্ট শ্রেণীর আঁশ উৎপন্ন করা যায় তবে পাট রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ৩০-৪০ কোটি টাকারও বেশি আয় করতে পারবে।

পাটের পচন
পানি এবং পানিতে বসবাসকারী অসংখ্য জীবাণুর মিলিত প্রচেষ্টায় পাট গাছের বাকল থেকে আঁশ  পৃথক হওয়ার প্রক্রিয়াকে পচন প্রক্রিয়া বলা হয়।

ভালো বীজ যেমন- ভালো গাছের পূর্বশর্ত; তেমনি পাট আঁশের গুণাগুণ অনেকাংশে পাট পচনের পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে। পাট আঁশের গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে পাটের গ্রেডিং করা হয়। পাট আঁশের গ্রেডিং সাধারণত পাট আঁশের শক্তি মসৃণতা, ঔজ্জ্বলতা, রঙ, পরিচ্ছন্নতা এবং দৈর্ঘ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়। পাট পচন পদ্ধতি যদি সঠিকভাবে না হয় তবে পাট আঁশের শক্তি, রঙ ও ঔজ্জ্বলতার পরিমাণ কমে যাবে। আবার পাটের জাগ যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি দিন পানিতে থাকে তবে পাট আঁশ তার শক্তি তথা রঙ ঔজ্জ্বলতা হারাবে।

আবার পাটের জাগ যদি প্রয়োজনের তুলনায় কম দিন পানিতে পচে তা হলে পাটের আঁশ পাটকাঠি থেকে আলাদা করতে কষ্ট হবে এবং পাটের আঁশগুলো সঠিকমতো আলাদা না হলে এই দ্বারা সুতা পাকানোর বিভিন্ন মেশিনারি দ্বারা প্রসেসিংয়ের আগে আঁশগুলো আলাদা করার জন্য বেশি পরিমাণ তৈলাক্ত পদার্থ প্রয়োগ করতে হবে; যার ফলে একদিকে যেমন- খরচ বেশি হবে অন্যদিকে সুতার মানও তেমন ভালো হবে না। কাজেই অধিক সময় জাগ দেয়া এবং প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় জাগ দেয়া উভয়ই বর্জনীয়। যেসব জমির কাছে পাট পচানোর জন্য পানি পাওয়া যাবে, পাট চাষের জন্য যেসব জমি নির্বাচন করা উচিত যাতে করে পরে পাট পচাবার জন্য পানির সমস্যা দেখা না দেয় ও পরিবহন খরচ কমানো যায়। সঠিক সময় পাট কাটার সঙ্গে আঁশের গুণাগুণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। দেখা গেছে যে, গাছে ফুল আসার আগে পাট কাটলে আঁশের মান খুব ভালো হয় কিন্তু ফলন কিছু কমে যায়। আবার ফল ধরার সময় পাট কাটলে আঁশের গোড়ার শক্ত ছাল বা কাটিংসের পরিমাণ বেশি হয় এবং আঁশের মানও খারাপ হয়। কাজেই অন্য কোনো অসুবিধা না থাকলে গাছে যখন কেবল ফুলের  কুঁড়ি আসতে শুরু করে তখন পাট কাটলে আঁশের মান ভালো হয় এবং ফলনও তেমন কমে না।

পাট পচনের শেষ সময় ঠিক করা অর্থাৎ পচন সমাপ্তি নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাট খুব বেশি পচলে আঁশ নরম হয় আবার খুব কম পচলে আঁশের গায়ে ছাল লেগে থাকে। কাজেই এমন সময়ে পচন থামাতে হবে যখন আঁশগুলো একটার সাথে আরেকটা লেগে না থাকে কিন্তু শক্ত থাকে। জাগ দেয়ার ৮-১০ দিন পর থেকেই জাগ পরীৰা করা উচিত। এ জন্য পাট জাগ দেয়ার ১০-১২ দিন পর থেকেই জাগ পরীক্ষা করা উচিত। ২-৩টা পাট জাগ থেকে বের করে ধুয়ে যদি দেখা যায় যে, আঁশগুলো পরস্পর পৃথক হয়ে গেছে, তখন বুঝতে হবে যে পচন সম্পন্ন হয়েছে। তবে পাট বেশি পচানোর চেয়ে একটু কম পচানো ভালো।

বদ্ধ পানিতে অর্থাৎ ছোট পুকুর বা ডোবায় পাট পচালে ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে পাট তাড়াতাড়ি পচে এবং আঁশের রঙও ভালো হয়। প্রতি ১০০ আঁটি কাঁচা পাটের জন্য প্রায় ১ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হবে। ইউরিয়া সার কোনো পাত্রে গুলে পচনের পানিতে মিশিয়ে দিতে হবে অথবা সরাসরি জাগের আঁটির সারিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।

বাংলাদেশের ব্যাপক এলাকায় পাট চাষ করা হয়। এর মধ্যে কোথাও কোথাও পাট গাছ কাটার  সময় পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না আবার কোথাও কোথাও পাট পচানোর সময় পানি থাকে না বা থাকলেও খুবই অপর্যাপ্ত এবং ঘোলা থাকে। এসব স্থানের জন্য বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট দুটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। যথা- রিবন বা ছাল ছাড়ানো পদ্ধতি এবং পলিথিন ট্যাংক পদ্ধতি।

রিবন রেটিং পদ্ধতি
রিবন পদ্ধতি হলো কাঁচা থাকাবস্থায় পাটগাছ  থেকে ছাল পৃথক করে নেয়া। এই ছালগুলোকে তিনভাবে পচানো যায়-
ক. বড় মাটির চাড়িতে ছালগুলোকে গোলাকার মোড়া বেঁধে সাজিয়ে রেখে পরিষ্কার পানি দিয়ে চাড়িটি ভরে দিতে হবে। একটি বড় চাড়িতে প্রায় ৩০ কেজি ছাল পচানো যায়।

খ. যদি আশপাশে ছোট ডোবা বা পুকুর বা কম গভীরতা সম্পন্ন জলাশয় থাকে তবে ছালগুলোকে গোলাকৃতি মোড়া বেঁধে একটি লম্বা বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে পানির মধ্যে ডুবিয়ে পচানো যাবে।

গ. বাড়ির আশপাশে অথবা ক্ষেতের পাশে ১৫-১৬ ফুট লম্বা, ৬-৮ ফুট প্রস্থ এবং ২ ফুট গভীর (পলিথিনের মাপ অনুসারে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা কম বেশি করা যেতে পারে) গর্ত খুঁড়ে গর্তের তলা ও কিনারা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিয়ে যে কোনো স্থান থেকে পরিষ্কার পানি দিয়ে গর্তটি ভরে সেখানে ছালগুলো পচানো যায়। সম্ভব হলে কচুরিপানা দিয়ে ছালের মোড়াগুলো ঢেকে দেয়া যেতে পারে। এ পদ্ধতিকে পলিথিন ট্যাংক পদ্ধতি বলা হয়। এ গর্তে কিছু পচন ইনোকুলাম অর্থাৎ পাট পচানো পানি দিলে পচন দ্রম্নত এবং নিশ্চিত হয়। এ ছাড়া পচন কাজ ত্বরান্বিত করতে প্রতি ১ হাজার কেজি ছালের জন্য ১০০ গ্রাম ইউরিয়া গর্তের পানিতে ছিটিয়ে দিলে সুফল পাওয়া যায়। কাজেই পাট ক্ষেতের ধারে কাছে পচানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি না থাকলেও রিবন রেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে সহজেই পাট পচানো সম্ভব।

আঁশের শ্যামল রঙ দূরীকরণ
অপরিষ্কার বা অনুপযুক্ত পানিতে আঁশ ধোয়ার পর যদি দেখা যায় আশের রঙ কালো বা শ্যামলা হয়ে গেছে তবে এক মণ পানিতে প্রায় ১ কেজি তেঁতুল গুলে সেই তেঁতুল গোলা পানির মধ্যে আঁশগুলোকে ৪-৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখলেই আশের রঙ উজ্জ্বল হয়ে যাবে। তবে তেঁতল এক প্রকার অ্যাসিড, তাই আঁশগুলোকে সাথে সাথে খুব ভালো করে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে যাতে তেঁতুলের রস আঁশের সাথে লেগে না থাকে।

পাটের কাটিংস
পাটের নিচে শক্ত, কালো ছালযুক্ত এবং অনমনীয় অংশ থাকে, এই অংশকে নরম করার জন্য অতিরিক্ত বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়। পাট শিল্পে এই অংশকে কাটিংস নামে অভিহিত করা হয়।

দুই উপায়ে এই কাটিংস সমস্যা দূর করা সম্ভব-
১. পাতা ঝরানোর পর পাটগাছের গোড়ার দিকে প্রায় ৪৫ সেন্টিমিটার বা দেড় ফুট পরিমাণ অংশ ২-৩ দিন পানির নিচে ডুবিয়ে রাখতে হবে। এতে গোড়ার অংশ অনেক নরম হয়ে যাবে। অথবা,
 
২. পাটগাছের গোড়ার প্রায় ৪৫ সেন্টিমিটার বা দেড় ফুট পরিমাণ অংশ একটি কাঠের হাতুড়ির সাহায্যে সামান্য থেঁতলানোর পর আঁটিগুলোকে পানির নিচে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পাটের আঁশ ধোয়ার পর খুব ভালো করে শুকানো উচিত। আঁশ কখনো মাটির ওপর ছড়িয়ে শুকানো উচিত নয়। কারণ তাতে আঁশে ময়লা, ধুলা-বালু, কাদা ইত্যাদি লেগে যায়। বাঁশের আড়ায়, ঘরের চালে, ব্রিজের রেলিং বা অন্য কোনো উপায়ে ঝুলিয়ে শুকানো উচিত। এ শুকানো আশ ভেজা অবস্থায় কখনোই গুদামজাত করা উচিত নয়, কারণ এতে আঁশের মান নিম্নমানের হয়ে যায়। পাট আঁশের পচন ঠিকমতো না হলে নিম্নমানের আঁশ নিম্নমানের গ্রেডিং হিসেবে বাজারে কম দামে বিক্রি হয়। কাজেই পাটের কাটিংস একটি বড় সমস্যা। আমাদের দেশে বছরে প্রায় ৫০ লাখ বেল (১ বেল=১৮০ কেজি) পাট আঁশ উৎপাদিত হয়, তার প্রায় ২০-৪০ শতাংশ পরিমাণ কাটিংস হিসেবে নষ্ট হয়। অর্থাৎ প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ কাটিংস পাট আঁশের চেয়ে কাটিংসের মূল্য অনেক কম। কাটিংসের পরিমাণ কমিয়ে ভালো মানের আঁশ উৎপাদন করতে পারলে পাট রপ্তানির আয় অনেকাংশে বাড়ানো সম্ভব হবে।

পাট আঁশের শক্তি, রঙ, ঔজ্জ্বলতা ও দৈর্ঘ্য  আঁশের শক্তির ওপর ভিত্তি করে গ্রেডিং করা হয়। আঁশ কত শক্ত বা কতটুকু টান সহ্য করতে পারে তা হাত দ্বারা টেনে বা মেশিনের সাহায্যে নির্ণয় করা যায়। গ্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে রঙ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তোষা ও দেশী পাটের একটি নির্দিষ্ট রঙ আছে। যেমন- তোষার জন্য সোনালি এবং দেশী পাটের জন্য মাখন সাদা। তবে রঙের তারতম্য নির্ভর করে কী প্রকার এবং কী ধরনের পানিতে পাট পচানো হয় তার ওপর। ঔজ্জ্বলতার পরিমাপ করা হয় আঁশ কতটা আলো প্রতিফলন করতে পারে তার ওপর। ঔজ্জ্বলতা সাধারণত মেশিন দ্বারা পরিমাপ করা হয়। সাধারণত সাদা পাটের ঔজ্জ্বলতা তোষা পাটের থেকে বেশি হয়ে থাকে। আঁশের দৈর্ঘ্য নির্ভর করে আঁশের গোড়া থেকে কতটা কাটিংস বাদ দেয়া যেতে পারে তার ওপর। সাধারণত কাটিংস বাদে আঁশ ৪ থেকে ১০ ফুট দৈর্ঘ্য বা তারও বেশি হতে পারে। আঁশের  দৈর্ঘ্য, পাটের জাত, জমির প্রকৃতি, স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। (সংকলিত)।

প্রাকৃতিক উপায়ে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ

প্রাকৃতিক উপায়ে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ
মাটি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি পৃথিবীর অধিকাংশ জীবের খাদ্য উৎপাদন এবং বসবাসের মাধ্যম। মাটিকে কেন্দ্র করে সব কৃষিকাজ আবর্তিত হয়। ফসল উৎপাদনে মাটির উপযুক্ত বিকল্প নেই। কৃষি প্রধান এ বাংলাদেশে প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ খুব একটা বেশি নেই। ফলে এদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা কৃষি, যা মৃত্তিকা সম্পদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ভাগ্যের সাথে জড়িত সোনার চেয়ে দামি এ মৃত্তিকা সম্পদ। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এ মৃত্তিকার উর্বরতা আজ হুমকির সম্মুখীন। এক সমীক্ষায় জানা গেছে বাংলাদেশের ৯০ লাখ হেক্টর কৃষি জমির শতকরা ৭৫  ভাগ তার উর্বরতা হারিয়েছে। অধিকমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারই এর প্রধান কারণ বলে ওই সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এর বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গত ঠিক এক দশকে বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির মাটির উর্বরতার মাত্রা শতকরা ২.৫ থেকে নেমে শতকরা ১.৫ এসে দাঁড়িয়েছে। এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর আবাদযোগ্য জমির শতকরা অর্ধেকই তার উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছে। এর ফলে প্রতি বছর প্রায় এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি যৌথভাবে এই সমীক্ষা চালায়। দৰিণ এশীয় অপরাপর দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে জমির উর্বরতা হ্রাস পরিস্থিতি আশংকাজনক। জমিতে অধিক মাত্রায় ও নির্বিচারে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলেই মাটির উর্বরতা শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে একই জমিতে  এভাবে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মাটির অম্লত্ব পরিবর্তিত হচ্ছে, পানি ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে ও অনুজীবের কার্যাবলী ব্যাহত হচ্ছে। এতে মাটির উৎপাদনশীলতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।

ফসল উৎপাদনের সঙ্গে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদিকা ক্ষমতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। মাটির উর্বরতা বলতে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমূহ সরবরাহের ৰমতাকে বুঝায়। অর্থাৎ মাটিকে তখনই উর্বর বলা হবে যখন তাতে কোন উদ্ভিদের পরিপূর্ণ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সব খাদ্য উপাদান সঠিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি, পুষ্টি ও ফলনের জন্য ১৬ টি খাদ্য উপাদন অত্যাবশ্যক। সাধারণভাবে এগুলোকে অপরিহার্য খাদ্য উপাদান বলা হয়। উদ্ভিদ পুষ্টি বিজ্ঞানী ডি আই আরননের মতে, অপরিহার্য খাদ্য উপাদান হচ্ছে ১৬টি, যথা- কার্বন, হাইড্রোজেন, অঙিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, গন্ধক, ম্যাঙ্গানিজ, লৌহ, মলিবডেনাম, দসৱা, বোরন, ক্লোরিন ও তামা। এ উপাদানগুলোর মধ্যে তিনটি উপাদান যেমন- কার্বন, হাইড্রোজেন ও অঙিজেন, উদ্ভিদ, পানি ও বায়ু থেকে গ্রহণ করে এবং বাকি তেরটি খাদ্য উপাদান মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। অনুর্বর মাটিতে ফসলের ফলন হয় কম, আর উর্বর মাটিতে ফলন হয় আশাব্যঞ্জক। সুতরাং অধিক উৎপাদন পেতে হলে মাটির উর্বরতা শক্তি বজায় রাখতে হবে। উদ্ভিদের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানগুলোর মধ্যে নাইট্রোজেন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। এর অভাব হলে গাছ বাড়তে পারে না, নিচের পাতাগুলো হলুদ হয়ে যায়, প্রোটিন সংশ্লেষণ কমে যাওয়ায় কোষ বিভাজন তথা কোষের বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে। এতে ফসলের নানারূপ লক্ষণ ও প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এবং ফলন কমে যায়। উদ্ভিদ নাইট্রোজেন গ্রহণ করে প্রধানত মাটি অথবা সার থেকে। পৃথিবীর প্রায় সব মাটিতে নাইট্রোজেনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের মাটিতে এই নাইট্রোজেনের অভাব  প্রকট। মাটির এ ঘাটতি পূরণে ইউরিয়া (বা এ্যামোনিয়াম সালফেট) সার ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, শ্রমিক মজুরি, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থার অভাব ইত্যাদির ফলে রাসায়নিক সারের মূল্য উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে এই সারের মূল্য স্বাধীনতা উত্তর দামের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি, ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের ক্রয় ক্ষমতার প্রায় বাইরে চলে গেছে।

অপরদিকে একই জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার বিশেষত ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে মৃত্তিকা ও পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। মাটির অমস্নত্ব পরিবর্তিত হচ্ছে, পানি ধারণৰমতা কমে যাচ্ছে ও অনুজীবের কার্যাবলী ব্যাহত হচ্ছে। এতে মাটির উৎপাদনশীলতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে এবং অন্যান্য খাদ্যোপাদানের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

এছাড়া রাসায়নিক সারের মধ্যে ইউরিয়া সারের অপচয় সবচেয়ে বেশি। প্রয়োগকৃত ইউরিয়ার কার্যক্ষমতা প্রায় শতকরা ৩০-৪০ ভাগ। এর মধ্যে শতকরা ২০-৪০ ভাগ নাইট্রোজেন জাতীয় গ্যাস উদ্বায়নের দ্বারা অপচয় হয়। চুনযুক্তক্ষারীয় ও জলাবদ্ধ মাটিতে এ অপচয় বেশি। এ ছাড়া শতকরা ২০-২৫ ভাগ নাইট্রোজেন চুয়ানির মাধ্যমে নাইট্রেট ও নাইট্রাইট আকারে অপচয় হয়। বেলে প্রধান বৃষ্টি বহুল এলাকায় এ অপচয় বেশি। কাজেই মাটিতে  নাইট্রোজেনের অভাব পূরণের ব্যবস্থা নেয়া একান্ত প্রয়োজন।

নাইট্রোজেনের প্রধান ও মৌলিক উৎস হল বায়ুমণ্ডল। বায়ুমণ্ডলে শতকরা ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন রয়েছে। এই নাইট্রোজেন উদ্ভিদ বা প্রাণী কেউ সংবন্ধন করতে পারে না। বেশ কয়েক প্রকার ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন সংবন্ধন করার ৰমতা রয়েছে। তার মধ্যে রাইজোরিয়ামের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এদের বলা হয় নাইট্রোজেন সংবন্ধকীকরণ (Nitrogen fixing) ব্যাকটেরিয়া।

এসব ব্যাকটেরিয়া শুঁটি জাতীয় (Leguminoseae) উদ্ভিদ যথা-মসুর, মুগ, ছোলা, মটর, খেসারি, মাসকলাই, চীনাবাদাম, সয়াবিন, শিম, বরবটি, ধৈঞ্চা, শন, প্রভৃতির শিকড়ে প্রবেশ করে গুটি বা অর্বুদ (Nodul) তৈরি করে। এরা বায়বীয় নাইট্রোজেনকে আহরণ করে যৌগিক পদার্থে পরিণত করে শিকড়ের গুটিতে জমা রাখে। আশ্রয়দাতা উদ্ভিদ আত্তীকৃত নাইট্রোজেন প্রয়োজনে ব্যবহার করে। এর পরিবর্তে ব্যাকটেরিয়া  আশ্রয়দাতা উদ্ভিদ থেকে খাদ্য নিয়ে থাকে। দুটি জীবের মধ্যে পরস্পরের জন্য উপকারী এ ধরনের সহযোগিতাকে বলা হয় ঝুসনরড়ংরং এ বৈশিষ্ট্যের  জন্য শুঁটি জাতীয় ফসলের চাষ করলে জমিতে প্রাকৃতিকভাবে নাইট্রোজেন যোগ হয়। ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এই সঞ্চিত নাইট্রোজেনের পরিমাণ কম নয়। শিকড়ে ভালো গুটি হলে বছরে হেক্টরপ্রতি ৫০-১৫০ কেজি নাইট্রোজেন মাটিতে জমা হতে পারে। যা ১১০-৩৩০ কেজি ইউরিয়া সারের সমান। এর ফলে ইউরিয়া সার ব্যবহারের পরিমাণ কমানো যায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে মৃত্তিকা দূষণ প্রতিরোধে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ক্রপিং প্যাটার্নের পরিবর্তনসহ জীবাণু সার ব্যবহারের দিকে তারা গুরুত্ব আরোপ করছে। আমাদের দেশেও তাই কোন জমিতে প্রথম বছর ধান, গম বা এ জাতীয় দানা শস্য চাষ করার পর দ্বিতীয় বছর ওই জমিতে শুঁটি জাতীয় কোন ফসল চাষের ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য এটি একটি প্রাকৃতিক ও সহজ পদ্ধতি। এতে দেশের দরিদ্র কৃষকগণ যেমন উচ্চ মূল্যে ইউরিয়া সার ক্রয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে, তেমনি আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মৃত্তিকার সহজাত উর্বরতা বজায় থাকবে এবং মৃত্তিকা দূষণ রোধ হবে। 

বাংলাদেশ খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতির দেশ। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ খাদ্যাভাব ও চরম পুষ্টিহীনতার শিকার। দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হচ্ছে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য ও অর্থকরী ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পাশাপাশি আর্থিক কাঠামো মজবুত করা। বর্তমানে দেশে খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। আগামী ২০২০ সন নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটিতে উন্নীত হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এর  দরুন খাদ্য ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, হাটবাজার, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি তৈরির জন্য কৃষি জমির পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে কমে যাবে। তখন খাব কি? অথচ বাঁচতে আমাদের হবেই। আর বাঁচতে হলে সীমিত জমি থেকেই অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু মাটি তার উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেললে খাদ্য উৎপাদনে ভাটা পড়বে এবং বর্ধিত খাদ্য উৎপাদনে দারুণ সংকট দেখা দেবে।

মাটি আসলে মায়ের মতো, ফসল যেন তার সনৱান। আমরা যদি মাটিকে মায়ের মতো যত্ন করি, তাহলে এ সমস্যার দ্রুত উন্নতি হতে পারে। মায়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকলেই কেবল শিশুরূপ ফসলের স্বাস্থ্য ভালো হতে পারে অর্থাৎ ফলন বেশি হতে পারে। এদিকে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশের সবাইকে আরো বেশি দৃষ্টি রাখত হবে।

ফল ও উপকারী বৃক্ষ সম্প্রসারণে হর্টিকালচার সেন্টারের ভূমিকা

ফল ও উপকারী বৃক্ষ সম্প্রসারণে হর্টিকালচার সেন্টারের ভূমিকা

খাদ্য-পুষ্টির অভাব দূরীকরণ ও পরিবেশের উন্নয়নে ফল ও উপকারী বৃক্ষের অবদান অপরিসীম। দেশ খাদ্য উৎপাদনে অনেকটা স্বনির্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতার কবল থেকে এখনও রক্ষা পায়নি। দরিদ্র জনগোষ্ঠী শুধু যে পুষ্টি হীনতার শিকার তা নয়, পুষ্টি জ্ঞানের অভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরাও পুষ্টিহীনতায় জর্জরিত। এ অবস্থার উন্নয়নে পুষ্টি জ্ঞানে গণসচেতনতা আনয়ন ও বেশি করে ফল সবজি আবাদ ও আহারে সর্বস্তরের মানুষকে উৎসাহিত করা একান্ত প্রয়োজন।

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ফলমূলে রয়েছে হরেক রকম ভিটামিন, মিনারেলস্ ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান। অপর পক্ষে ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে আবাদি জমির পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য হলেও বাড়ির আনাচে-কানাচে, ছাদে, রাস্তার ধারে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যতটুকু জায়গা অব্যবহৃত আছে, সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টির অভাব দূরীকরণ অতি সহজ। এছাড়াও পরিবেশ দূষণে দেশের অবস্থা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে বেশি করে ফল-ফলাদি ও উপকারী বৃক্ষ (মাল্টিপারপাস ট্রি) ব্যাপক হারে রোপণের মাধ্যমেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের আবহাওয়া, মাটি ও পানি সম্পদ অন্তত ৫০ প্রকারের প্রচলিত ও অপ্রচলিত অর্থকরী ফল আবাদ করার জন্য অতি উপযোগী যা পৃথিবীর অন্যত্র বিরল। এ ছাড়াও কতগুলো বিদেশি জাতের ফল (মিঠা তেঁতুল, জামরুল, ড্রাগন ফল, স্ট্রবেরি, কমলা, খেজুর ইত্যাদি) খুব সফলভাবে আবাদ সম্প্রসারণ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কাজেই বিভিন্ন রকমের ফল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ফলের বীজ, চারা, কলমের সহজ প্রাপ্যতা ও আবাদে জনসাধারণের দক্ষতা বৃদ্ধি করার দায়িত্ব কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর। এ লক্ষ্য সফল বাস্তবায়নে হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর প্রধান করণীয় দিকগুলোর কিয়দাংশ আলোকপাত করা গেলঃ

হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিকরণ ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিকরণ
বেড়া ব্যবস্থা
হর্টিকালচার সেন্টারের আওতাধীন সব ফসলই পশুপক্ষী ও মানুষ সবারই অতি আকর্ষণীয়। তাই এগুলো চাষের সঙ্গে সঙ্গে তা রক্ষা করার জন্য বাউন্ডারি/ফেনসিং বা বেড়ার ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। অনেক সফল ও উৎসাহী অফিসার কেন্দ্রের অপর্যাপ্ত ও অপরিকল্পিত বিদ্যমান বাউন্ডারির কারণে সুন্দর ও মানসম্পন্নভাবে হর্টিকালচার কার্যক্রম সফল বাস্তবায়ন করতে সামর্থ্য নয়। অনেকেই পাকা বাউন্ডারি প্রত্যাশা করে। আর্থিক ব্যবস্থা বিবেচনায় এনে কিছুটা ফাউন্ডেশন, পিলার ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বর্ডারে লাইফ ফেনসিং (বেল, কথবেল, বগুন ভিলা, করমচা, লেবু, বাবলা, শিমুল) দিয়েও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া ও কেন্দ্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা মোটেও কঠিন নয়,  অভাব রয়েছে  রুচি, পরিকল্পনা ও  বাস্তবায়ন দক্ষতা।

ভূমি ও নিকাশ ব্যবস্থার উন্নয়ন
উদ্যান ফসল আবাদ ও চারা কলম তৈরি ও সংরক্ষণে ভূমির উন্নয়ন, পানির প্রাপ্যতা ও নিকাশ ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। এ কাজের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মাটি এনে বেশি ভরাটের প্রয়োজন নেই। একটা সুন্দর পরিকল্পনার মাধ্যমে কেন্দ্রকে বিভিন্ন বস্নকে ভাগ করে ড্রেন তৈরি করার মাধ্যমে ভূমি উঁচু ও পানি নিকাশ ব্যবস্থা করে বেশি জমি কাজের ব্যবহার উপযোগী করা যায়। এর পরেও স্থানভেদে প্রয়োজনমাফিক বেলে দো-আঁশ মাটির প্রয়োজন হলে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুকনো মৌসুমে সংগ্রহ করে পরিকল্পিত উপায়ে ভূমি উন্নয়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়।

চারা কলম তৈরি ও সংরক্ষণে অনুকূল ব্যবস্থা
চারা কলম তৈরি স্থানটি খামারের এক পার্শ্বে সুন্দর করে গড়ে তোলা দরকার। তাতে কর্মীদের জন্য অনুকূল পরিবেশে কর্মদক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ হয়, কাজের মান ও পরিমাণ বাড়ে। এখানে হালকা টিনশেড (ট্রান্সপারেন্ট টিন বা পস্নাসটিক সিট দিয়ে তৈরি আলো বাতাস প্রাপ্তি সহায়ক) ও তার সঙ্গে পস্নাসটিকের রঙিন নেট দিয়ে আধা ছাঁয়ার ব্যবস্থা রাখা দরকার। অনেক কেন্দ্রে এ ব্যবস্থা কিছুটা থাকলেও তার স্থায়িত্ব ও সুচারু ব্যবহার অপ্রতুল।

পটিং মিডিয়া সংরক্ষণ ও তার সুষ্ঠু ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন হলেও তা ঠিকমতো অনুসরণ হয় কি না তা পরীক্ষা করা দরকার। মৌসুমের শুরুতেই সারা বছরের জন্য কত ট্রাক ভিটেবালু দরকার এবং তার সাথে কি পরিমাণ বা রেসিওতে গোবর, হাড়ের গুঁড়া, খৈল ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে তা ঠিক ও কার্যকর করা দরকার।

সদ্য পটিং করা চারা কলম রাখার জন্য পটিং শেডের পাশেই ৭৫-৮০% ছায়া প্রদানযোগ্য কালো নেট দ্বারা চারা বেয়ারিং শেড তৈরি করা দরকার।

কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও চাহিদা
গার্ডেনার/মালী/সুপারভাইজারদের ব্যবহারের জন্য কি কি খামার যন্ত্রপাতি (বাডিং নাইফ, সিকেচার, খুরপি, নিড়ানি ও বিভিন্ন সাইজের ধারালো কোদাল/খোন্তা, পলিথিন টেপ, কভার, উপযুক্ত মাপের পলি ব্যাগ,পট ইত্যাদি), আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি (গামবুট, ছাতা, রেনকোট ইত্যাদি) আছে কি না তা ঠিকমতো পরীক্ষা করে সব কিছু সময়মতো সরবরাহ ও তাঁর ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এতে করে কাজের মান ও পরিমাণ বাড়বে অন্য দিকে কর্র্মীদের কাজের দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে।

বার্ষিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন
বছরের শুরুতেই হর্টিকালচার কেন্দ্রের কী কী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে এবং কখন কোন কোন কী পরিমাণ কাজ কার দ্বারা সম্পাদন হবে তার একটা “গাইড লাইন” পরিকল্পনা থাকা দরকার। কেন্দ্রের কিছু কাজ এত মৌসুমভিত্তিক যে তা “সময়ের এক ফোঁড়” পদ্ধতি অবলম্বন করা না হলে সে কাজ এক বছর পিছিয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয়ভাবেও ইহা অনুসরণ করা যেতে পারে। এ কাজ বাস্তবায়নে যেন সবাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ওয়ার্কপস্ন্যান তৈরিতে সমর্থ হয় এ জন্য ৫/৭টি কেন্দ্রের উদ্যোগী কর্মকর্তার কাছ থেকে “ফরমেট” সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয়ভাবে তা কমপাইল করে একটা “কমন” পস্ন্যানিং ফরমেট সব সেন্টারে বাস্তবায়নের জন্য বিতরণ করা যেতে পারে। ওয়ার্ক পস্ন্যান বা ওয়ার্ক ক্যালেন্ডার হবে পাক্ষিকভিত্তিক।

হর্টিকালচার সেন্টার বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রতিটি অংশের উপযোগী ব্যবহার

হর্টিকালচার সেন্টারগুলোকে জনসাধারণের জন্য আকর্ষণীয় করে প্রতিটি স্থানের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিটি সেন্টারকে পরিকল্পিত উপায়ে সাজাতে হবে। হর্টিকালচার একটি সুন্দর, মার্জিত, মনোরম কালচার। এখানে  এলে যে কোনো ভিজিটর আকর্ষিত হয় ও ফল ফলাদি আবাদে অনুপ্রেরণা পায় সে ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।

কেন্দ্রে প্রবেশ গেটটিকে আকর্ষণীয় লতানো ফুল (বাসর, গোল্ডেন সাওয়ার, ক্রিপার আলামন্ডা, যুঁই, লতা বেলী, অনন্তলতা, বগুন ভিলা, লাল রঙের প্যাশন ফ্লাওয়ার ইত্যাদি) দিয়ে আকর্ষণীয় করা দরকার।

প্রবেশ গেট থেকে বিক্রয় কেন্দ্র, নার্সারি এলাকা ও অফিসের আশপাশ এলাকাগুলোকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, সুদৃশ্য গাছপালা (করমচা, কামরাঙা, বারমাসী আমড়া, খাট জাতের নারিকেল, ডালিম, অরবরই, চেরী ফল, বিলম্ব, আলু বোখারা, পিচ, ড্রাগন ফল, একজোরা, আলামন্ডা, বগুন ভিলা (বিদেশি) বেলী, চেরী, খাট জাতের জামরুল, মন্দির ঝাউ, চাইনিজ পাম, বিস্নডিং হাট, র্যাবিশ পামপ ইত্যাদি) দিয়ে কেন্দ্রকে সুন্দর করে গড়ে তুলে ভিজিটরকে আকর্ষিত করতে হবে।

আকারের প্রকৃত অবস্থা বিবেচনায় এনে সেন্টারকে চার থেকে আরম্ভ করে ৬ বা ৮ বস্নকে ভাগ করে চলাচল ব্যবস্থা সুন্দর করা এবং প্রতি ব্লককে বিভিন্ন কাজে বা বাগান সৃষ্টি করা, মৌসুমি সবজি, ফুল, মসলা চাষ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী স্থাপন, লতানো  সবজি (পটোল, সিম, বরবটি) আলাদাভাবে আবাদ ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
অফিস সংলগ্ন প্রবেশ পথ, বিক্রয় কেন্দ্র ও নার্সারি এলাকায় ফল/ফুলের টব ও মৌসুমি ফুল দিয়ে সুদৃশ্য করা যায়। এ ছাড়াও গাজর, পেঁয়াজ, ধনে, রেড ক্যাবেজ, লেটুস জাতীয় সুদৃশ্য সবজি দিয়েও ডেকোরেশন করা উত্তম।

১৪-১৬ ইঞ্চি মাটির টবে কথবেল, কামরাঙা, ডালিম ও খাট জাতের আম (লতা-বম্বে), জামরুল (থাই), চেরী ফল, করমচা, পেয়ারা, কমলা, লেবু, জাম্বুরা ইত্যাদি ফলগাছ সংরক্ষণ করে প্রদর্শনী আকারে ব্যবহার করা যায়।

মৌসুমে সবজি (বেগুন, মরিচ, ক্যাপসিকাম, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি), মসলা, ফলের চারা (পেঁপে, আমড়া ইত্যাদি), কাটিং তৈরি ইত্যাদি কাজে ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট বস্নকে ইট (সিরামিক) দিয়ে সেমি পারমানেন্ট বেড তৈরি করে নেয়া ভালো হবে।

লেবু, গোলাপ জাতীয় বাগান যা সুন্দর রাখা যায় না সেগুলোকে দূর প্রান্তে রাখা ভালো। তবে যে সবগাছ দেখতে সুন্দর (কথবেল, কামরাঙা, থাই জামরুল, ড্রাগন ফ্রুট ইত্যাদি) সে সব গাছের বাগান অফিসের কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকা দরকার।

মাতৃগাছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
কেন্দ্রে যতদূর সম্ভব বিভিন্ন ফলের এবং বিভিন্ন জাতের মাতৃগাছ থাকা দরকার। জানাশুনা নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে তা সংগ্রহ করা উচিত হবে। এগুলোর জাতের বৈশিষ্ট্য, উৎস ইত্যাদি বিস্তারিত সংশিস্নষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মাতৃগাছ রেজিস্টারে সংরক্ষণ করতে হবে। গাছে ফুল, ফল ধরা অবস্থা, স্বাদ, সাইজ ইত্যাদি গুণাবলি যাচাই না করে মাতৃগাছকে কখনো চারা কলম তৈরির কাজে ব্যবহার করা উচিত হবে না।

মাতৃগাছ সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ, ফল ধরা ও অন্যান্য গুণাগুণ বিশিষ্ট তথ্য কিভাবে সংরক্ষণ করা হবে তার একটা “কমন” ফরমেট কেন্দ্রীয়ভাবে সরবরাহ করা প্রয়োজন। মাতৃগাছসহ সব ধরনের গাছকে ট্রেনিং, প্রুনিং করে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা এবং নিয়মিত খাবার দেয়া, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনব্যবস্থা নিতে হবে। রুগ্ণ, আধামরা, বাঁকা ত্যাড়া, দেখতে অসুন্দর গাছকে শুরুতেই অপসারণ করা উচিত।

নারিকেল গাছের মাতৃ গাছ নির্বাচন ও বীজ নাট সংগ্রহ
জাতীয় পর্যায়ে নারিকেল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রায় সব হর্টিকালচার সেন্টারেই প্রতি বছর প্রচুর সংখ্যক নারিকেল চারা উৎপাদন ও বিক্রয় করা হয়ে থাকে। উন্নত মানের নারিকেল চারা উৎপাদনের জন্য সময়মতো বীজ সংগ্রহ, গজানো-চারা রোপণ এবং গজানো-চারা কালিস্নং এর মাধ্যমে গুণগত চারা বিক্রির নিশ্চয়তা প্রদান করা। জাতীয় পর্যায় থেকে ভালো নারিকেল উৎপাদন এলাকা (যেমন- বরিশাল, খুলনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ইত্যাদি) থেকে মাতৃগাছ নির্বাচন করে তাতে ‘নম্বরসহ ট্যাগ’ দিয়ে রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করতে হবে। হর্টিকালচার সেন্টারের ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবস্থিত নারিকেল গাছের মধ্যে থেকেও মাতৃগাছ নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে হবে। মাতৃগাছগুলোর যথাযথ যত্ন নিতে হবে এবং নির্বাচিত মাতৃগাছ থেকে যথাসময়ে ‘বীজ’ নারিকেল সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে।

চারা-কলম তৈরিতে লক্ষণীয়
সুন্দর, সুস্থ, সবল সুনির্দিষ্ট জাতের চারা-কলম আলাদাভাবে লেবেল দিয়ে সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থা নিতে হবে।
এলাকায় বেশি চাহিদা, স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ ও অন্যান্য সংস্থাসহ বিশেষ প্রকল্প চাহিদা ও অন্য অঞ্চলের চাহিদা যেসব চারা কলমের বেশি সেগুলো বেশি করে উৎপাদন করতে হবে।

কিছু কিছু নূতন ফল ও জাত যা জনপ্রিয়তা আনা দরকার সেগুলো উৎপাদনে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে এবং তা সম্প্রসারণ ব্যবস্থা (কথবেল, সজিনা) জোরদার করতে হবে।

কিছু কিছু গাছ দীর্ঘ দিন (এক বছরের ওপর) সংরক্ষণ করা দরকার। বিশেষ করে রাস্তার ধারে বা কোন অফিস, স্কুল, কলেজ ও প্রতিষ্ঠানে বড় লম্বা গাছ গরু ছাগলের হাত থেকে রক্ষার জন্য বড় গাছ লাগাতে ক্রেতারা পছন্দ করে থাকে। এ চাহিদা পূরণে আম, কাঁঠাল, আমড়া, জাম, জলপাই, ডেউয়া, চালতা, ডুুমুর এগুলোর চারা বড় করে বিতরণ ব্যবস্থা করা দরকার। এগুলোকে পস্নাস্টিক সিমেন্টের ছোট ব্যাগে (দামে সস্তা প্রায় প্রতিটি ২/-) এক বছরের অধিককাল সংরক্ষণ করাও যায় এবং এতে গাছকে, ৫-৭ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট অবস্থায় সংরক্ষণ করে সুনির্দিষ্ট ক্রেতাকে আকর্ষিত করার জন্য। এ ধরনের লম্বা গাছের জন্য আলাদা মূল্য নির্ধারণ প্রয়োজন।

যেসব গাছের চাহিদা কম সেগুলো সীমিতসংখ্যক সংরক্ষণ করা উচিত। আকাশিয়া, ইউকেলিপটাস, মিনজিয়াম, সেগুন, মেহগিনি, ইপিল-ইপিল জাতীয় অত্যন্ত সীমিত আকারে চারা উৎপাদন করতে হবে।
তবে সীমিত আকারে নিম, স্বর্ণচাঁপা, হরিতকি, বহেড়া, ক্যসয়ো-জাভানিকা, এ জাতীয় গাছের চারা সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থা নেয়া যায়।
গতানুগতিক শুধু চারা তৈরি ও বিতরণ প্রবণতা কমিয়ে কাঁঠাল, জাম, তেঁতুল, বেল, জলপাই ইত্যাদি ফল গাছের একই সঙ্গে কলম তৈরি করা ও সম্প্রসারণ ব্যবস্থা নেয়ার গুরুত্ব দেয়া দরকার।

চারা কলম তৈরি ও সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ায় যেসব গাছের গুরুত্ব বেশি দেয়া উচিত তাদের মধ্যে কথবেল কলম, বরিশালী আমড়া, থাই জামরুল, উন্নত জাতের জাম, বেল, তেঁতুল, লটকোন, উন্নত জাতের আম, লিচু, জাম্বুরা, লেবু, কমলার কলম এবং সজিনার চারা/কাটিং সেগুলোর অন্যতম।

উদ্যান ফসল সম্প্রসারণ
প্রত্যেক সেন্টারের আওতায় কমপক্ষে নিকটস্থ একটা রাস্তা, ঈদগাহ/গোরস্থান, স্কুল/কলেজ/ এতিমখানা/মাদ্রাসা, একটি গ্রামের কমপক্ষে ৭টি বাড়িকে মডেল আকারে ফল ও উপকারী বৃক্ষ দিয়ে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।  একটি বাড়ি একটি খামার মডেলে ও কিছু বাড়িকে প্রদর্শনী আকারে সাজানো যায়। প্রয়োজনে স্থানীয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সহায়তায় যৌথ উদ্যোগে এ ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।

কর্মশক্তি উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ
গার্ডেনার থেকে আরম্ভ করে কেন্দ্রে কর্মরত সর্বস্তরের অফিসিয়ালদের উদ্যানতত্ত্ব, কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা চারা কলম তৈরি, সংরক্ষণ, বিতরণ এবং উদ্যান ফসল সম্প্রসারণে করণীয় বিষয়ে নিয়মিত অরিয়েন্টেশন ট্রেনিং দরকার। এমন কি নতুন যোগদানকৃত স্টেশন ইনচার্জকে কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারের মতো স্থানে অন্তত ১ মাসের জন্য শিক্ষানবিস হিসাবে অবস্থান ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিশেষে এ কর্মকর্তা উৎসাহজনক কি শিখলো এবং বাস্তবে পরবর্তীতে লব্ধজ্ঞান কর্মক্ষেত্রে কিভাবে প্রয়োগ করা হবে সে বিষয়ে অন্তত ১৫ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট প্রশিক্ষণ সমাপনী রিপোর্ট হেড কোয়ার্টারে তাকে জমা দিতে হবে।

কোন স্তরের স্টাফদের কি ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে তার একটা ট্রেনিং সিডিউল তৈরির দায়িত্ব তিন সদস্যবিশিষ্ট অভিজ্ঞ হর্টিকালচারিস্টকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। অর্থায়নে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পকের দায়িত্ব হবে।

হর্টিকালচার সেন্টারে কর্মরত স্টাফ ভিজিট
যেসব কেন্দ্রে উদ্যান উন্নয়নে বিভিন্ন উৎসাহজনক অনুকরণীয় কর্মকাণ্ড চলছে সেসব হর্টিকালচার সেন্টারগুলোসহ সংশিস্নষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠান (জিও, এনজিও) এবং সফল চাষির বাগান ভিজিটব্যবস্থা নিয়ে কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। ভিজিটকালে কি ধরনের জ্ঞান আহরণ হলো সে শিক্ষার আলোকে কি ব্যবস্থা কেন্দ্রে ফিরে গিয়ে প্রয়োগ করা হবে তার প্রতিবেদন সুনির্দিষ্ট ফরমেটে/ কমিটমেন্ট পরিদর্শনকারী কেন্দ্রের সব স্টাফকে লিখিত আকারে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে এবং তার পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে ভিজিটের প্রতিফলন সংশিস্নষ্ট সেন্টারে দেখাতে হবে।

প্রচার ও সম্প্রসারণ
অনেক হর্টিকালচার সেন্টার উদ্যান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে বিশেষ অবদান রাখছে অথচ ডিএই এর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মাস-মিডিয়াকে ব্যবহার করে তেমন প্রচারণা ব্যবস্থা নিয়ে জনগণকে আকৃষ্ট করার প্রবণতা তেমন নেই। খাদ্য পুষ্টি, আয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উদ্যান ফসলের সফল সমপ্রসারণ বাস্তবায়নে বহুল প্রচার কল্পে বিভিন্ন মিডিয়াকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে এবং জনগণের মধ্যে উদ্যান ফসল সম্প্রসারণ ব্যবস্থা জনপ্রিয় করতে হবে।

উদ্যান বিশেষজ্ঞ টিম গঠন ও দায়িত্ব
ডিএইতে কর্মরত উদ্যানতত্ত্বে অভিজ্ঞ সৃজনশীল বেশ কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। তাঁদেরকে নিয়ে একটা বিশেষজ্ঞ টীম গঠন করতে হবে এবং তারা বিভিন্ন কেন্দ্র ভিজিট করে কেন্দ্রের উন্নয়নে লিখিত সাজেশন প্রদান করবেন এবং হেড কোয়ার্টার থেকে এর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করত প্রয়োগ ব্যবস্থা তরান্বিত করবে।
পুরস্কার ব্যবস্থা গ্রহণ
প্রতি বছর শেষে বড়, মাঝারি ও ছোট আকারের তিন ধরনের হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর কর্মতৎপরতা ও সফল অবদানের জন্য তিন জন ইনচার্জকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রত্যেক কেন্দ্রে ভালো কাজ করার প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

অফিস ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা
হর্টিকালচার সেন্টারের কর্মকর্তাগণ বেশিরভাগই কারিগরী কাজে দক্ষ কিন্তু অফিস ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার ততটা দক্ষ নয়। সেন্টার ইনচার্জকে অফিস ও আর্থিক ব্যাবস্থাপনায় সঠিকভাবে দায়িত্ব পলন করা অত্যন্ত জরুরি। তাই সংশিস্নষ্ট সেন্টার ইনচার্জদের অফিস ও আর্থিক ব্যবস্থাপনাসহ চচজ- ২০০৮ এর উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে ডিএই’র অভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালকগণের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।

মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ
সেন্টারের কার্যক্রম পরিকল্পনামাফিক চলছে কিনা তা তদারকি করার জন্য যিনি সার্বিক দায়িত্বে আছেন (ডিডি, ফল ও সবজি), তাকে ঘনঘন সেন্টারগুলো পরিদর্শন করতে হবে। পরিকল্পনামাফিক কাজ হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে এবং কোথায়ও কাজের ঘাটতি থাকলে তা সরেজমিন উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে ডিএই, হেডকোয়ার্টার থেকে উদ্যান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা মনিটরিং টিম ও গঠন করা যায় এবং তাদের মাধ্যমে মনিটরিং কাজ সমাধা করা যায়।

পরিশেষে আগামী দিনের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য, পুষ্টির চাহিদা পূরণ, আয় বৃদ্ধি ও পরিবেশের উন্নয়নে সব স্তরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করুক এটাই একান্তভাবে সবার কামনা।

Monday, 13 June 2011

গবাদিপশুর ফুট রট রোগ নিয়ন্ত্রণ

গবাদিপশুর ফুট রট রোগ নিয়ন্ত্রণ

ফুট রট গবাদিপশুর পায়ের ক্ষুরের চারপাশে ও ক্ষুরের মধ্যবর্তী স্থানের টিস্যুর প্রদাহজনিত একটি সংক্রামক রোগ। সকল শ্রেণীর সব বয়সের পশুই (গাভী, বলদ, ষাঁড়, বকনা ইত্যাদি) এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগকে ইন্টারডিজিটাল নেক্রোব্যাসিলোসিস, ফাউল ইনদি ফুট, ফুট রট বা ইন্টার ডিজিটাল ফ্লেগমন হিসাবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।

কারণতত্ব ও এপিডেমিওলজী
ফুট রট সাধারণত Fusobacterium necrophorum দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে তবে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া যেমন Bacterorides melaninogenicus ও এ রোগের কারণ হতে পারে। পরীক্ষামূলকভাবে F. necrophorum গবাদিপশুর ইন্টারডিজিটাল চামড়ার মাঝে ইনজেকশন দিলে ইন্টারডিজিটাল নেক্রোব্যাসিলোসিস এর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লিশান পরিদৃষ্ট হয়। এই ব্যাকটেরিয়ার অধিকাংশ আইসোলেট পরীক্ষা করে দেখো গেছে এরা অ এবং অই গ্রুপের অর্ন্তভুক্ত। এরা একজাতীয় exotoxin উৎপন্ন করে যা ইনজেকশন করলে গবাদি পশু ও ইঁদুর আক্রান্ত হয়। আবার লিশান থেকে প্রাপ্ত আর একজাতীয় isolotes যারা ইন্টারডিজিটাল নেক্রোব্যাসিলোসিস হিসাবে শ্রেণীভুক্ত নয় এবং সুস্থ গরুর পা থেকে সংগৃহীত হয় এরা বায়োটাইপ ই হিসাবে (F. necrophorum subspecies funduliforme) চিহ্নিত হয়। এরা তেমন ক্ষতিকারক নয়। Bacteroides nodosus এর স্ট্রেইন যা ভেড়ার ফুট রট করে তা গবাদিপশুর ক্ষুর থেকে সংগৃহীত হয়েছে তবে তা অল্প বিস্তর ইন্টারডিজিটাল ডার্মাটাইটিস করে থাকে। কিন্তু এরা আবার মারাত্নক ইন্টারডিজিটাল নেক্রোব্যাসিলোসিস রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়ে থাকে এবং এর ফলে ৫-১০% গবাদিপশু খোঁড়া হয়ে যেতে পারে। সকল বয়সের গরু এবং দুই মাস বয়সের বেশি ভেড়া ও ছাগলে এ রোগ দেখা দিতে পারে। বর্ষা ও স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়ায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়ে থাকে। ডেয়রী খামারের গাভীতে এ রোগ হলে অত্যন্ত ক্ষতি হয়। দেশী জাতের গরু অপেক্ষা বিদেশী জাতের ও সংকর জাতের গাভীতে এ রোগ মারাত্নক হয়ে থাকে। আক্রান্ত গরুর পায়ের ক্ষত হতে নিঃসৃত রস থেকে রোগজীবাণু অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এ রোগ বিচ্ছিন্নভাবে দেখা দেয় তথাপি তা অনুকূল পরিবেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

রোগ বিস্তার
সাধারণত আক্রান্ত গরু থেকে রোগের বিস্তার ঘটে। আক্রান্ত প্রাণীর ক্ষুরের ক্ষত স্থান থেকে নিঃসৃত রস প্রচুর জীবাণু বহন করে যা থেকে সুস্থ প্রাণী আক্রান্ত হয়ে থাকে। গবাদি পশুর পায়ের ক্ষুরের করোনেট বা দুই ক্ষুরের মধ্যবর্তী স্থানের টিসু্যতে কোনো কিছু দ্বারা আঘাতের ফলে ক্ষত হলে ও সর্বদা কাদা-পানি বা গোবরের মাঝে পা রাখলে ক্ষতস্থান দিয়ে রোগজীবাণু সহজেই দেহে প্রবেশ করে এ রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
এছাড়াও শক্ত স্থান, ধারালো পাথরের নুড়ি অথবা চারণক্ষেত্রের শক্ত ধান বা গমের মুড়া থেকে ক্ষুরের নরম টিসু্য আঘাতপ্রাপ্ত হলে সেখান থেকেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। যে কোনো কারণেই হোক না কেন পা যদি সব সময় ভেজা থাকে তাহলে ক্ষুরের মাঝে ক্ষত হবার সম্ভাবনা বেশি দেখা দেয়। অস্বাস্থ্যকর গোয়াল ঘর হলে রোগের সংক্রমণ বেশি হতে পারে।

রোগ লক্ষণ
আক্রান্ত প্রাণীকে আকষ্মিকভাবে খোঁড়াতে দেখা যায়। সাধারণত এক পায়ে ব্যথা হলেও তা প্রায়শ মারাত্নক হয়ে থাকে। দেহের তাপমাত্রা ১০৩-১০৪ ফা লক্ষ্য করা যায়। ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয় ও গাভীর দৈহিক ওজন ও দুধ উৎপাদন হ্রাস পায়। আক্রান্ত ষাঁড় সাময়িকভাবে অনুর্বর (infertile) হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় পায়ের ক্ষতে পুঁজ হয় ও নেক্রসিস হয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। রোগজীবাণুর সংক্রমণের ফলে অস্থিসন্ধি, সাইনোভিয়া ও টেন্ডনের প্রদাহ দেখা দেয়। ফলে আক্রান্ত গরু মাটিতে শুয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত গরুর চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। যথাসময়ে চিকিৎসা না করালে ক্ষুর খসে যেতে পারে ও গরু স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। গরু যদি কয়েক সপ্তাহ যাবৎ খোঁড়াতে থাকে তাহলে দুধ উৎপাদন দারুণভাবে কমে যায় এবং দৈহিক ওজনও হ্রাস পায়। চিকিৎসার অভাবে রোগ যদি খুব জটিল আকার ধারণ করে তাহলে আক্রান্ত প্রাণীকে বাতিল ঘোষণা করতে হয়।

রোগ নির্ণয়
রোগের ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রোগলক্ষণ দেখে এ রোগ নির্ণয় করা যায়। এছাড়া পায়ের করোনেটের ক্ষত পরীক্ষা করে এ রোগ সনাক্ত করা যেতে পারে।
ল্যাবরেটরিতে এ রোগের জীবাণু সনাক্ত করা যায়। রোগজীবাণু সুনির্দিষ্টভাবে সনাক্ত করার জন্য পায়ের ক্ষত থেকে সোয়াব নিয়ে গ্রাম স্টেইন ও ব্লাড আগারে কালচার করে এ রোগের জীবাণু সনাক্ত করা যায়।

রোগ সনাক্তকরণে পার্থক্য
রোগের লিশানের স্থান, রোগের প্রকৃতি, লিশানের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দুর্গন্ধ, পালে রোগের ধরন, ঋতু ও আবহাওয়া পর্যালোচনা করে ফুট রটে আক্রান্ত গরুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায।

ইন্টারডিজিটাল ডার্মাটাইটিস/স্টেবল ফুট রট
গবাদিপশুকে আবদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘ দিন প্রতিপালন করলে সাধারণত এ রোগ দেখা দিয়ে থাকে। তবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পালন করা হলে প্রায়শ এ রোগ দেখা দেয়। আবার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে পালিত গরুতেও এ রোগ দেখা দিতে পারে। এ রোগের কারণ ঠিক জানা না গেলেও আক্রান্ত পশু থেকে Bacteroides সনাক্ত করা গেছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষুরের bulb এলাকা থেকে দুর্গন্ধযুক্ত আঠালো রস নিঃসরণ হতে থাকে। লিশান বেদনাদায়ক হয় কিন্তু অন্য কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না। একাধিক ক্ষুর আক্রান্ত হতে পারে। দীর্ঘ দিন ভুগতে থাকলে ক্ষত মারাত্নক হয় ও সেখানে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে। স্টেবল ফুটরটে ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসায় তেমন উপকার হয় না তবে ক্ষতস্থানে পরিচর্যা করে সেখানে ব্যাকটেরিয়ানাশক ঔষধ ব্যবহার করলে ফল পাওয়া যায়।

ভেরুকোজ ডার্মাটাইটিস
সাধারণত কাদাযুক্ত ভেজা স্থানে গাদাগাদি করে গরু পালিত হলে তাদের এরোগ হয়ে থাকে। ক্ষুরের planter অঞ্চলে প্রদাহ দেখা দেয়। চার পায়ের ক্ষুরই আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত স্থান অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয় ও গরু খোঁড়াতে থাকে। আক্রান্ত স্থান থেকে smear নিয়ে পরীক্ষা করলে পর্যাপ্ত সংখ্যক F. necrophorum ব্যাকটেরিয়া সনাক্ত করা যায়। এ রোগের চিকিৎসা হচ্ছে, আক্রান্ত স্থান জীবাণুনাশক সাবান ও পানি দ্বারা ভালোভাবে ধুয়ে তারপর সেখানে ৫% কপার সালফেট সলিউশন প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে প্রতিদিন চিকিৎসা করতে হবে। যখন অনেক গরু একই সাথে আক্রান্ত হয় তখন কপার সালফেটের সলিউশনের মাঝে প্রতিদিন ফুট ডিপ প্রয়োগ করতে হবে।

আঘাতজনিত ক্ষত
পায়ের ক্ষুরে কোনো ধারালো বস্তু দ্বারা ক্ষত হলে কিংবা ক্ষুর বেড়ে গেলে তা ভালোভাবে পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে। ল্যামিনাইটিস (Laminitis) হলে গরু প্রায়শ খোঁড়া হয়ে যায় কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কোনো লিশান পরিলক্ষিত হয় না।

চিকিৎসা
আক্রান্ত পশুদেরকে শুকনো পরিষ্কার স্থানে রাখতে হবে। এ্যান্টিবায়োটিকস বা সালফোনামাইডস প্রয়োগ করতে হবে এবং ক্ষত স্থান জীবাণুনাশক দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে। চিকিৎসার জন্য প্রোকেইন পেনিসিলিন-জি প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ২২,০০০ ইউনিট হিসাবে দিনে দুইবার মাংসপেশীতে ইনজেকশন দিতে হবে।
অক্সিটেট্রাসাইক্লিন প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ মিগ্রা হিসাবে দৈনিক শিরা বা মাংশপেশীতে ইনজেকশন দিতে হবে। ভেড়া ও ছাগলের জন্য প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৭৫ মিগ্রা স্ট্রেপটোমাইসিন এবং ৭০০০ ইউনিট প্রোকেইন পেনিসিলিন মাংসপেশীতে দিলে উপকার হয়।
সোডিয়াম সালফাডিমিডিন প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১৫০-২০০ মিলিগ্রাম হিসাবে শিরা বা পেরিটোনিয়ামের মধ্যে ইনজেকশন দিলেও কাজ হয়।
ক্ষতস্থান ভালোভাবে জীবাণুনাশক সলিউশন দ্বারা পরিষ্কার করে এন্টিসেপ্টিক ও এসট্রিনজেন্ট ঔষধ প্রয়োগ করে ব্যান্ডেজ করে দেয়া যেতে পারে। এছাড়াও ৫% কপার সালফেট বা ৫% ফরমালিন দ্বারা ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে ১০% জিংক সালফেট ব্রাশের মাধ্যমে প্রয়োগ করলেও উপকার হয়।

প্রতিরোধ ব্যবস্থা
• গরুর ক্ষুরে যেন ক্ষত না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিতে হবে।
• গোয়াল ঘর বা খামারের প্রবেশ পথে ৫% কপার সালফেট সলিউশন ফুট বাথ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। এই সলিউশন দিনে দুইবার নূতন করে প্রস্তুত করে ফুট বাথ হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে। নিয়মিত এই ফুটবাথে গরু পা ডুবালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বহুলাংশে রোধ করা যাবে।
• কেমোপ্রোফাইল্যাক্সিসঃ রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় প্রতিটি গরুকে দৈনিক ৫০০ মিলিগ্রাম হিসাবে ক্লোরটেট্রাসাইক্লিন ২৮ দিন এবং পরে প্রত্যহ ৭৫ মিলিগ্রাম হিসাবে সেবন করানো হলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করা যায়।
• গবাদিপশুর খাদ্যে দৈনিক ২০০-৪০০ মিলিগ্রাম অর্গানিক আয়োডাইড (ethylene diamine dihydriodide) খাওয়ানো হলে এ রোগের প্রতিরোধ হয়।
• ভ্যাকসিন প্রয়োগঃ মিনারেল অয়েল এডজুভ্যান্ট ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
• গবাদিপশুকে কাদা বা ভেজা স্থানে রাখা বা যাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে।
• গোয়াল ঘর সব সময় পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব
ডেয়রী খামারের ক্ষেত্রে ফুট রট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ডেয়রী খামারের গাভী যেহেতু নিবিড়ভাবে পালিত হয় সেহেতু সেখানে রোগের প্রাদুর্ভাব প্রায়শ ব্যাপক আকারে দেখা দিয়ে থাকে। খাঁটি বা সংকর জাতের গাভীতে এ রোগ হলে পায়ের ব্যথায় মাটিতে শুয়ে পড়ে ও খাদ্য কম খায়। ওলান মাটির সাথে দীর্ঘ সময় লেগে থাকায় ওলানফোলা রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে। আক্রান্ত গাভীর দুধ উৎপাদন বহুলাংশে হ্রাস পায়। কোনো কোনো সময় পায়ের সন্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এবং পরবর্তী পর্যায়ে গাভী চলাফেরায় অক্ষম হয়ে যায়। যদিও এ রোগে মৃত্যু ঘটে না কিন্তু বর্ণিত আনুসাঙ্গিক কারণে খামারের উৎপাদন দারুণভাবে হ্রাস পেয়ে থাকে। এর ফলে খামারী অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
মাংসের জন্য পালিত ষাঁড়ের (beef cattle) খামারে এ রোগের প্রাদুর্ভাব হলেও খামারীর প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হয়। আক্রান্ত ষাঁড় ঠিকমতো খাদ্য গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় শুকিয়ে যায় ও মাংস উৎপাদন হ্রাস পায়।

উপসংহার
উপরে আলোচিত নানাবিধ কারণে ফুট রট রোগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং এ কারণে খামারীদেরকে গবাদিপশু পালনের প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে। গোয়াল ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুকনো রাখা এবং নিয়মিত গবাদিপশুর সঠিক পরিচর্যা করা অত্যন্ত জরুরি। এ সমস্ত বিধি-ব্যবস্থা নিয়মিত প্রতিপালিত হলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

অ্যানথ্রাক্স রোগ, লক্ষণ ও প্রতিকার

অ্যানথ্রাক্স রোগ, লক্ষণ ও প্রতিকার

অ্যানথ্রাক্স গবাদিপশুর একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। গবাদিপশু থেকে এ রোগে মানুষেও ছড়ায়। এ রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত খাদ্য খেয়ে বিশেষ করে বর্ষাকালে নদী-নালার পানি ও জলাবদ্ধ জায়গার ঘাস খেয়ে গবাদিপশু অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়।

রাতে গোয়াল ঘরে সুস্খ গরু রেখে এসে সকালে গিয়ে যদি দেখা যায় গরু মরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে তাহলে যেসব রোগে মারা যেতে পারে বলে মনে করা হয় অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ তার মধ্যে অন্যতম। রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গরু মারা যায়। অনেক সময় লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পরপরই গরু মারা যেতে পারে। চিকিৎসার কোনো সুযোগই পাওয়া যায় না। এমনই ঘাতক ব্যাধি অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ এবং পাবনার কয়েকটি থানায় এ রোগটি দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে অনেক গরু, মারাও গেছে বেশ কিছু। সিরাজগঞ্জ বা পাবনায়ই যে এ রোগ প্রথম দেখা দিয়েছে তা নয়। অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগের ইতিহাস অনেক পুরনো। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৯১ সালেও মিসরে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল বলে জানা যায়। শুধু মিসর নয়, গ্রিস, রোম এমনকি ভারতবর্ষেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে এ রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকায় ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ার রেকর্ড রয়েছে। এমনকি মাত্র তিন দশক আগে ১৯৭৮-৮০ সালে জিম্বাবুয়েতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে শুধু পশু নয়, প্রায় দশ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়, মারা যায় প্রায় ১৫১ জন।

যেসব প্রাণীর এ রোগ হয়: মূলত গরু এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, মহিষ, জেব্রা, জিরাফ, হরিণ, শূকর, হাতি এবং বানরও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। প্রাণী থেকে মানুষে এ রোগ ছড়ায় বলে একে জ্যুনোটিক ডিজিজও (zoonotic disease) বলে। তাই ভয়ের কারণ একটু বেশি।

কিভাবে ছড়ায় : মৃত বা আক্রান্ত পশুর লালা বা রক্তের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। তা ছাড়া চুল, উল বা অন্যান্য বর্জের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। মৃত পশু পচে গলে মাটিতে মিশে গেলেও হাড় যদি থাকে তবে তা থেকেও ছড়াতে পারে। এ রোগের জীবাণু প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশেও বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে। কখনো এক দশকও। কোথাও একবার এ রোগ দেখা দিলে তা পরবর্তী সময়ে আবারো দেখা দিতে পারে। ট্যানারি বর্জ্যরে সঠিক ও সুষ্ঠু নিষ্কাশন এ জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। অ্যানথ্রাক্সে মৃত গরুর চামড়া ট্যানারিতে গেলে তা থেকে জীবাণু চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভয়াবহ অবস্খার সৃষ্টি হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়।

রোগটি কেন এত মারাত্মক : এ রোগের জন্য দায়ী ব্যাসিলাস অ্যাথ্রাসিস (Bacillus anthracis) নামের এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া। এই ব্যাক্টেরিয়া বিশেষ ধরনের কিছু টক্সিন বা বিষাণু তৈরি করতে পারে। এ টক্সিন প্রাণীদেহে প্রবেশের দুই থেকে চার ঘন্টার মধ্যে প্রাণীদেহের নিউট্রোফিলকে দুর্বল করে ফেলে। নিউট্রোফিল হচ্ছে এক ধরনের শ্বেতকণিকা যা বাইরের জীবাণুর আক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে। টক্সিন নিউট্রোফিলের ফিলামেন্ট তৈরিতে বাধা দেয়, ফলে নিউট্রোফিল চলৎ-শক্তি হারিয়ে ফেলে। সংক্রমণের স্খানে যেতে পারে না, ব্যাক্টেরিয়াকে ধ্বংসও করতে পারে না।

নিউট্রোফিল নিষ্ক্রিয় হওয়ায় ব্যাক্টেরিয়া বাধাহীনভাবে দ্রুত দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং রোগ তৈরি করে মৃত্যু ঘটায়।
রোগের লক্ষণ : লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগেই সাধারণত গরু মারা যায়। তবে লক্ষণ হিসেবে কখনো কখনো গরুর খিঁচুনি, কাঁপুনি দেখা দেয়। শরীরের তাপমাত্রা খুব বেড়ে যায়। তাপমাত্রা প্রায় ১০৫-১০৭ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। গরু ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গরু মারা যায়। মারা গেলে নাক, মুখ, কান, মলদ্বার দিয়ে কালচে লাল রঙের রক্ত বের হয়। এ রোগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গরু মারা যাওয়ার পরও রক্ত কখনো জমাট বাঁধে না।

লক্ষণসমূহ: ক. অত্যাধিক জ্বর হয় (১০৩-১০৭ ফাঃ);
খ. শ্বাসকষ্ট এবং দাঁত কটকট করে;
গ. শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠে;
ঘ. আক্রান্ত পশু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে;
ঙ. পশুকে কিছুটা উত্তেজিত দেখায়;
চ. পশু নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়ে;
ছ. খিঁচুনি হয় ও অবশেষে পশু মারা যায়;
জ. মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে বা পরে পশুর নাক, মুখ, মলদ্বার ইত্যাদি দিয়ে কালো রক্ত নির্গত হয়;
ঝ. অনেক সময় লক্ষণসমূহ প্রকাশের আগেই পশুর মৃত্যু ঘটে।

রোগ নির্ণয় : রোগের লক্ষণ দেখে সহজেই রোগ নির্ণয় করা যায়। তাছাড়া রক্ত পরীক্ষা করলে ছোট দণ্ডের মতো ব্যাক্টেরিয়া দেখতে পাওয়া যায়। এ রোগে মৃত গরুর ময়নাতদন্ত করা হয় না। তবে ভুলক্রমে ময়নাতদন্ত করে ফেললে দেখা যায় প্লীহা বড় হয়ে গেছে।

চিকিৎসা : সাধারণত চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ পাওয়া যায় না, তার আগেই আক্রান্ত গরু মারা যায়। যদি কখনো আক্রান্ত গরু পাওয়া যায় তবে উচ্চমাত্রার পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা যেতে পারে। ভ্যাকসিন দেয়াই এ রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। লাইভ এবং কিলড উভয় ধরনের ভ্যাকসিনই পাওয়া যায়। চামড়ার নিচে এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। ভ্যাকসিন প্রয়োগের ১০-১৫ দিনের মধ্যেই গরুর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। আক্রান্ত গরুতে আগে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়ে থাকলে নতুন করে ভ্যাকসিন দেয়ার প্রয়োজন হয় না।

প্রতিরোধে যা করণীয় : খুবই ভয়ানক আর ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই এ রোগ প্রতিরোধে বিশেষভাবে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য নিচের নির্দেশনাগুলো মেনে চলা জরুরি।

১. অ্যানথ্রাক্স রোগে মৃত পশুর ময়নাতদন্ত করা একেবারেই অনুচিত। রোগের লক্ষণ এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই এ রোগ সম্বìেধ শতভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। ময়নাতদন্তে কাটাছেঁড়া করার জন্য যে ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্খা গ্রহণ করা প্রয়োজন দেশের কোনো ল্যাবরেটরিতেই সে ধরনের ব্যবস্খা নেই। কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে পশুর রক্ত, বর্জ্য চার দিকে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে যারা কাটাছেঁড়া করবেন তাদেরই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার।

২. পশুর মৃতদেহ ভাগাড়, নদী, জলাশয়, জঙ্গল বা পরিত্যক্ত জায়গায় ফেলা যাবে না। এতে শেয়াল, কুকুর, শকুনসহ মৃতদেহ ভক্ষণকারী অন্যান্য প্রাণী সেগুলো খাবে এবং রোগজীবাণু চার দিকে ছড়িয়ে যাবে। সেই সাথে বাতাস, পানির মাধ্যমেও গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

৩. মৃতদেহ লোকালয় থেকে দূরে জনমানবহীন নির্জন জায়গায় আট-দশ ফুট গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয়ার ব্যবস্খা করতে হবে। প্রথমে গর্তে কিছু চুন ছড়িয়ে দিতে হবে। মৃতদেহ রেখে আবার কিছু চুন প্রয়োগ করে মাটি চাপা দিতে হবে। কুকুর, শেয়াল যেন মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ বের করে নিয়ে যেতে না পারে সে জন্য গর্তের ওপর পাথর দিয়ে রাখা ভালো। গর্তের চার পাশে কাঁটা দিয়ে রাখলে কুকুর, শেয়াল কাছে ঘেঁষতে পারবে না।

৪. বাড়ি থেকে মৃতদেহ বহন করে নেয়ার সময় বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্খা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অ্যানথ্রাক্সে মৃত পশুর নাক, মুখ, কান, মলদ্বার দিয়ে রক্ত বের হয়ে থাকে। এ রক্ত আবার জমাট বাঁধা থাকে না। ফলে আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে পারে। তাতে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই মৃত পশুর নাক, মুখ, কান, মলদ্বারে তুলা বা কাপড় গুঁজে ভ্যান বা বহনকারী বাহনে উঠাতে হবে। ভ্যান বা অন্য কোনো বাহনে পলিথিন বা অন্য কিছু এমনভাবে দিয়ে নিতে হবে যাতে দুর্ঘটনাবশত লালা বা রক্ত পড়লেও যেন ভ্যান বা বাহনে না লাগে। যারা মৃতদেহ বহন করবে তাদের অবশ্যই দস্তানাসহ বিশেষ ধরনের পোশাক পরা প্রয়োজন।

৫. মৃত পশুর চামড়া ছাড়ানো যাবে না।

৬. আক্রান্ত গরু জবাই করা যাবে না। গোশত না খাওয়াই উত্তম।

৭. আক্রান্ত বা মৃত গরুর গোয়ালঘর ব্লিচিং পাউডার, কাপড় কাচার সোডা বা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দিয়ে যত্নের সাথে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। আক্রান্ত গরু সুস্খ গরু থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে হবে। কারণ আক্রান্ত গরু থেকে জীবাণু সুস্খ গরুতে ছড়াতে পারে। এসব নির্দেশনা সঠিকভাবে মেনে চললে রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে।

আশার কথা : আশার কথা হচ্ছে Bacillus anthracis জীবাণু ধ্বংসের খুব কার্যকরী একটি প্রোটিন আলফা ডিফেনসিন (Alpha defensin) শনাক্ত করতে পেরেছেন জার্মানির ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। নিউট্রিফিল যেসব প্রোটিন উৎপন্ন করে Alpha defensin তার মধ্যে একটি। এ নিয়ে গবেষণা চলছে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো অ্যানথ্রাক্সের কার্যকর ওষুধ বাজারে আসবে। গুটিবসন্তের মতো ঘাতক ব্যাধি অ্যানথ্রাক্সও একদিন হারিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে, সে দিন হয়তো খুব কাছেই।

প্রতিকার: ক. গবাদিপশুকে নিয়মিত বছরে একবার অ্যানথ্রাক্স রোগের টিকা দিতে হবে;
খ. পশুর ঘর সবসময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে;
গ. মৃত পশুর দেহ, গোবর, লালা, প্রস্রাব, রক্ত ইত্যাদিসহ গভীর গর্তে পুঁতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে;
ঘ. কোনো পশু আক্রান্ত হলে তাকে পৃথক করে চিকিৎসা দিতে হবে;
ঙ. মৃত পশুর চামড়া ছাড়ানো যাবে না;
চ. নদী-নালার পানি ও নিচু এলাকার ঘাস খাওয়ানো যাবে না।
ছ. অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত পশুর মাংস কোনো অবস্থাতেই খাওয়া যাবে না।

অ্যানথ্রাক্স রোগে মানুষ আক্রান্ত হবার লক্ষণসমূহ : অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত গবাদিপশু যারা জবাই করেন, মাংস কাটেন, মাংস ধোয়ামোছা করেন, চামড়া ছাড়ান এবং খান প্রত্যেকেই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। অ্যানথ্র্যাক্স একটি ব্যাকটেরিয়া (ব্যাসিলাস অ্যানথ্র্যাসিস) জনিত সংক্রামক রোগ। রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দিতে হয়, না হলে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।

কিভাবে ছড়ায় : আক্রান্ত পশুর (গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ) লোম, চামড়া, মাংস রোগ ছড়ানোর উৎস হিসেবে গণ্য করা। এ জন্য রোগে আক্রান্ত পশুর খামারি, লোম উত্তোলনকারী এবং কসাইরা প্রথমে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কখনোই রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় না। তবে আক্রান্ত পশুর মাংস ও রক্তের সংস্পর্শে এ রোগ ছড়াতে পারে। তাই রোগাক্রান্ত পশু জবাই বা খাদ্য হিসেবে গ্রহণের অনুপযোগী।

লক্ষণ কি : সাধারণত জীবাণু শরীরে প্রবেশের দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। সর্বপ্রথম ত্বকেই এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়, আক্রান্ত স্থান চুলকায় এবং লাল বর্ণের হয়ে থাকে, যা প্রাথমিকভাবে পোকার কামড় মনে হতে পারে। এটি শুকিয়ে লালচে কালো বর্ণের আকার ধারণ করে এবং খসে পড়ে। ক্ষতটির কেন্দ্র শুকনা এবং কালো, তার চারদিকে উঁচু এবং লাল বর্ণের হয়ে থাকে।

লক্ষণসমূহ: ক. আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে জ্বর উঠবে;
খ. চামড়ায় প্রথমে লালচে দাগ হবে এবং আক্রান্ত স্থান চুলকাবে;
গ. পরবর্তীতে আক্রান্ত স্থানে প্রায় দেড় দুই ইঞ্চি পরিমাণে ফোসকা উঠবে, ফোসকার মাঝখানে পচনের মত কালচে হবে;
ঘ. ফোসকার স্থানে পরে ব্যথামুক্ত ঘা হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি সঠিকভাবে চিকিৎসা না নিলে মারা যেতে পারে।

জটিলতা : ত্বকে লক্ষণ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা গ্রহণ করলে এটি সহজে নিরাময়যোগ্য রোগ কিন্তু পরবর্তীতে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়লে এ রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। ব্যাকটেরিয়াজনিত প্রদাহের কারণে, উঁচু মাত্রার জ্বর, ফুসফুসের সংক্রমণের কারণে তীব্র শ্বাসকষ্ট এবং পরিপাকতন্ত্রের জটিলতার কারণে মৃত্যু হয়ে থাকে।

রোগের ধরন : অ্যানথ্রাক্স জীবাণু মানুষের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত করতে পারে এবং আক্রান্ত অঙ্গ অনুযায়ী রোগের ধরনও বিভিন্ন রকম হয়। যেমন :

১। ত্বকের (cuteneous) অ্যানথ্রাক্স : অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশু অথবা এনথ্রাক্স স্পোর দ্বারা দূষিত পশুর পশম, চুল বা চামড়ার সংস্পর্শে এলে অ্যানথ্রাক্স স্পোর মানুষের ত্বকের অতিসূক্ষ্ম ক্ষত দিয়েও প্রবেশ করতে পারে। এ অবস্থায় সাধারণত ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ত্বকের ক্ষত তৈরি হয়। ক্ষত দুই হাতে মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে ঘাড় এবং মাথাও আক্রান্ত হতে পারে। ত্বকে ধীরে ধীরে ঘা তৈরি হয় যা ২-৩ সেমি আয়তনের হয়ে থাকে এবং ঘা এর চারদিকের ত্বক একটু উঁচু হয়ে থাকে। ক্ষতে চুলকানি থাকে তবে ব্যথা থাকে না।

শ্বসনতন্ত্রির (inhalational) অ্যানথ্রাক্স : অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর স্পোর যদি শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। শুরুর দিকে হালকা জ্বর, খুশখুশে কাশি এবং বুকে অল্প ব্যথা হয়। পরবর্তীতে তীব্র জ্বর, শ্বাসকষ্ট, শরীর নীল হয়ে যাওয়া, শরীর বেশি ঘেমে যাওয়া, কাশির সঙ্গে রক্ত বের হওয়া, বুকে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।

মুখবিবরীয় (oropharyngeal) অ্যানথ্রাক্স : অ্যানথ্রাক্স স্পোর খেলে এ অবস্থা দেখা দেয়। গলাব্যথা, খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়া এর লক্ষণ। এক্ষেত্রে মুখের তালু বা মুখবিবরে (pharynx) ক্ষত দেখা দেয়।

পরিপাকতন্ত্রের (Intestinal) অ্যানথ্রাক্স : এটাও অ্যানথ্রাক্স স্পোর খেলে দেখা দেয়। বমি অথবা বমিবমি ভাব, অস্বস্তি, পেটব্যথা, রক্তবমি, বারবার রক্তযুক্ত পায়খানা হওয়ার সঙ্গে জ্বর হয়।

রোগের পরিণতি : বেশির ভাগ এনথ্রাক্স ত্বকের এনথ্রাক্স, যা চিকিৎসা করলে, এমনকি চিকিৎসা না করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভালো হয়ে যায়। অন্যান্য ধরনের এনথ্রাক্সের পরিণতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খারাপ। এর মধ্যে সেপটিসেমিক এনথ্রাক্স এবং অ্যানথ্রাক্স মেনিনজাইটিস এ মৃত্যুহার খুবই বেশি। শ্বসনতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স চিকিৎসা করলেও মৃত্যুহার প্রায় ৪৫%। পরিপাকতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স নির্ণয় করা খুব কঠিন এবং এতে মৃত্যহার ২০-৬০%।

রোগ নির্ণয় : ত্বকের অ্যানথ্রাক্স রোগীর গবাদিপশুর সংস্পর্শে আসার ইতিহাস এবং ক্ষতের ধরন দেখেই বোঝা যায়। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ক্ষত থেকে রস নিয়ে নির্দিষ্ট উপায়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করলে জীবাণু দেখা যায়। শ্বাসতন্ত্রের রোগ সন্দেহ করলে বুকের এক্স-রে, সিটি স্ক্যান করা হয়। সেপটিসেমিক অ্যানথ্রাক্স নির্ণয় করার জন্য ব্লাড কালচার করা হয়। মেইনজাইটিস সন্দেহ হলে লাম্বার পাংকচার করে সেরিব্রোস্পাইনাল রস পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া ELISA নামক পরীক্ষাও এ রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।

চিকিৎসা : ত্বকের সংক্রমণের ক্ষেত্রে রোগীকে বহিঃবিভাগেই চিকিৎসা দেওয়া যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে ভর্তির মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হবে। বিভিন্ন রকমের এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে অ্যানথ্রাক্স রোগের চিকিৎসায় পেনিসিলিনকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। কুইনোলন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক যেমন : সিপ্রোফ্লক্সাসিন, লেভোফ্লক্সাসিন, গ্যাটিফ্লক্সাসিন, ডক্সিসাইক্লিন, এমক্সিসিলিন, এম্পিসিলিন, ক্লোরামফেনিকল ইত্যাদি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

প্রতিরোধ : ১. রোগাক্রান্ত পশুকে প্রথমেই আলাদা জায়গায় রাখতে হবে।
২. রোগাক্রান্ত পশুকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।
৩. মৃত পশুকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
৪. রোগাক্রান্ত পশুকে জবাই করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।
৫. রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে যতদ্রুত সম্ভব চিকিৎসা প্রদান করতে হবে

বাংলাদেশে উট পালন

বাংলাদেশে উট পালন

cambel
ঢাকার দক্ষিণ কমলাপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে দেওয়ানবাগ দরবার শরিফের বাবে মদিনায় আড়াই বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে উটের খামার। দেওয়ানবাগীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০৪ সালে এখানে গড়ে ওঠে এই খামার। ওই বছর ঈদুল আজহার সময় ভারতের রাজস্থান থেকে গাবতলী হাটে আনা উট থেকে একটি পুরুষ ও নয়টি মাদি উট বাবে মদিনায় পালনের উদ্দেশ্যে কিনে আনা হয়। এরপর বিভিন্ন সময় আরো নয়টি উট ক্রয় করা হয়। এসব উট পরবর্তীতে বাচ্চা প্রসব করলে এক বছরের মধ্যে এখানে উটের সংখ্যা দাঁড়ায় পঁয়তালি্লশে। বিভিন্ন সময় ঈদুল আজহায় বাবে মদিনা উট বিক্রি করে থাকে। বর্তমানে এ খামারে ২৯টি উট রয়েছে।

খামারে প্রথম বাচ্চা প্রসব : খামার কর্তৃপক্ষের কথায় এটি ছিল অলৌকিক ঘটনা। ২০০৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। ঢাকা শহরে বন্যা দেখা দিয়েছে। উটের জন্য একেবারেই প্রতিকূল আবহাওয়া। প্রসব বেদনায় কাতর মা উট। কর্তৃপক্ষ হতাশ। এই আবহাওয়ায় বাচ্চা দেওয়া তো দূরের কথা, উটকে বাঁচানোই সম্ভব নয়। কিন্তু না, সব আশঙ্কা পেছনে ফেলে পৃথিবীর ইতিহাসে এই দিন বাংলাদেশের প্রতিকূল আবহাওয়ায় জন্ম নিল প্রথম উট শাবক।

বাংলাদেশে কিভাবে উট পালন : এ দেশে উট পালনের প্রধান শর্ত হলো নিবিড় পরিচর্যা। জানালেন উট খামারের তত্ত্বাবধায়ক মো. তসলিম উদ্দিন। কি ধরনের পরিচর্যা? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কৃত্রিম মরুভূমি তৈরি করতে হবে। ব্যাপকহারে মশা-মাছি নিধনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাতে কোনোভাবে একটি মশা কিংবা মাছিও না থাকে। মলমূত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, নোংরা পরিবেশ উটের প্রধান শত্রু। একটি উটের জন্য কমপক্ষে দশ বর্গফুট জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে।

উট পালন কতটুকু লাভজনক : এ প্রসঙ্গে তসলিম উদ্দিন বলেন, উট পালন অত্যন্ত লাভজনক। কারণ একটি উটের বাচ্চা লালন-পালনে মাসে ব্যয় হয় পাঁচশত টাকা। অথচ দেড় বছরের মাথায় এই উটটির বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায় কমপক্ষে দেড়লাখ টাকা। এ সময়ে এর প্রতিপালন ব্যয় নয় থেকে দশ হাজার টাকার বেশি নয়। অন্যদিকে দেড় বছর পর মা উট আরেকটি বাচ্চা দেয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ কেজি দুধ দেয়। উট প্রথমবার একটি বাচ্চা দেয়। দ্বিতীয়বার থেকে দুই থেকে ৩টি করে বাচ্চা দেয়। একটি উট ৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। এ সময়ে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০টি বাচ্চা দেয়।

উটের বিভিন্ন রোগবালাই : সাধারণত উটের চর্মরোগ ও জ্বর হয়। সাধারণ চিকিৎসায় তা ভালো করা সম্ভব। তসলিম উদ্দিন বলেন, উটের প্রধান শত্রু কৃমি। ছয় মাস পরপর ভ্যাকসিন দিলে কৃমি দমন হয়। তিনি জানান, একটি উট যে কোনো রোগ অথবা বার্ধক্যজনিত কারণে আক্রান্ত হলেও অসুস্থ অবস্থায় কমপক্ষে দু'মাস বেঁচে থেকে। এ সময়ের মধ্যে এটিকে সারিয়ে তোলা বা জবাই করে মাংস বিক্রি করা যায়। ফলে রোগ বালাই সত্ত্বেও উট পালনে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় না।

উটের মাংস ও দুধের গুণাগুণ : জাতিসংঘ, সৌদি আরব ও ভারতের প্রাণিবিজ্ঞানীরা উটের মাংস ও দুধের ওপর গবেষণা চালিয়ে আবিষ্কার করেছেন, এতে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন- ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, নানা সংক্রমণ, পেটের আলসার, হাঁপানি, জন্ডিস, পাইলস, রক্তশূন্যতা, চর্মরোগসহ প্রায় ২০ ধরনের জটিল রোগ নিরাময় সম্ভব।

উটের দুধ : একটি উট দৈনিক ৮-১০ কেজি দুধ দেয়। এখানে বর্তমানে ৯টি উট দুধ দিচ্ছে বলে জানান, তত্ত্বাবধায়ক তসলিম উদ্দিন। প্রতি কেজি দুধের দাম ১৬০ টাকা। বিভিন্ন স্তরের মানুষ দুধের ক্রেতা। তবে ক্রেতাদের বেশির ভাগই দেওয়ানবাগ হুজুরের মুরিদ। তাদের মতে উটের দুধ পান করা সুন্নত।

উটের খাদ্য : বিভিন্ন ধরনের ঘাস, খৈল, ভুসি, খড় ইত্যাদি।

আড়াই বিঘায় উট খামার : বাবে মদিনায় আড়াই বিঘা জায়গার ওপর চতুর্ভুজ আকৃতিতে গড়ে তোলা হয়েছে খামারের মধ্যকার অংশ। বাঁশ ও কাঠ ব্যবহার করে উটের বাস উপযোগী খামার তৈরি করা হয়েছে। ২০ জন লোক সার্বক্ষণিকভাবে উট পরিচর্যায় ব্যস্ত। দু'জন পশু চিকিৎসক ২৯টি উটের চিকিৎসায় নিয়োজিত। খামার রক্ষণাবেক্ষণ করছে ২০টি স্বেচ্ছাসেবক দল। প্রতিটি দলে রয়েছে ১০-১৫ জন করে স্বেচ্ছাসেবক। বাবে মদিনা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হয়ে আসছে খামারটি। তসলিম উদ্দিন জানান, খামারের পরিধি বৃদ্ধি ও উটের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। ঈদুল আজহায় উট বিক্রি ও সারা বছর দুধ বিক্রিই খামারের আয়ের একমাত্র উৎস। প্রতিদিন বাবে মদিনায় বহু দর্শনার্থী উট দেখতে আসেন বলে জানা গেছে।

বাড়ির আঙ্গিঁনায় হরিণ পালন

বাড়ির আঙ্গিঁনায় হরিণ পালন

deer
প্রকৃতির এক সুন্দরতম বন্য প্রাণীর নাম হরিণ। এর রঙ-চঙা শরীর আবাল-বৃদ্ধ বনিতা সকলের নিকট আকর্ষণীয়। দেশের অধিকাংশ মানুষ যদিও হরিণ সচক্ষে দেখার সুযোগ পান না তবুও ছবির হরিণ প্রায় সকলেরই চেনা। যে শিশুটি সদ্য কথা বলতে শিখেছে সেও কিন্তু হরিণ নামের পশুটিকে শব্দে শব্দে চিনে নেয়। আর অর জ্ঞানের প্রারম্ভেই "হ"-তে হরিণ শিখে নেয় এবং রঙিন ছবির পশুটিকে তার আরো কাছে এন দেয়। হরিণ আজ আর দেশের সকল বনে-জঙ্গলে নেই। এদের আবাসমূল এখন চিড়িয়াখানায় আর সুন্দরবনে। অতি কম সংখ্যায় হলেও, তবু কিন্তু কিছু কিছু সৌখিন ব্যক্তি বাড়ির আঙ্গিঁনায় হরিণ পালন করে থাকেন।

বন্য প্রাণী বনাম গৃহপালিত পশুঃ

প্রাচীনকালে মানুষ তাদের ক্ষুধা নিবারনের জন্য বন্য পশু শিকার করত। সে সময় বন্য পশু শিকার নিতান্তই প্রয়োজনের তাগিদে ছিল, শখ বা বিনোদনের জন্য নয়। এক সাথে কয়েকটি প্রাণী ধরতে পারলে, প্রয়োজনমত জবাই করে বাকীগুলো ভবিষ্যতের জন্য গৃহে আবদ্ধ করে রাখতো। সেই ধ্যান-ধারনা থেকেই সম্ভবতঃ বন্য প্রাণী নিজ গৃহে লালন পালনের সূত্রপাত ঘটে। গৃহে আবদ্ধ বন্য প্রাণীদের মধ্যে কিছু প্রজাতি মানুষের বশ্যতা স্বীকার করে নেয় এবং মানুষের কাছে থেকেই বংশবিস্তার করতে থাকে। এ প্রসংঙ্গে পবিত্র আল কুরআনের সুরা ইয়াছিনে আলাহ পাক এরশাদ করেছেন।
"আমি চতুম্পদ জন্তুগুলোকে ওদের বশীভূত করে দিয়েছি; কতক তাদের খাদ্য আর কতক তাদের বাহন, তবুও কি তারা কৃতজ্ঞ হবে না"
গরু মহিষ ভেড়া ছাগল মাংসের জন্য আর ঘোড়া, গাধা, খচ্চর, হাতী বোঝা বহনের কাজে লাগানোর জন্য জঙ্গল থেকে ধরে এনে গৃহপালিত করা হয়েছে। সঙ্গত কারনেই হরিণ পালন অবাস্তব একটা ধারনা নয়।

বাংলাদেশের বন্য প্রাণী হরিণঃ

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন গাছ-পালার প্রয়োজন, তেমনি গহীন অরণ্য আর বনাঞ্চলের নীরব-শান্ত পরিবেশও বনের জীব-জন্তুদের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। অরণ্যের শোভা হচ্ছে নানা জাতীয় বৃ আর উদ্ভিদ। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় বৈচিত্রময় বনে নানা ধরনের পশুপাখির সমারোহ ঘটেছে। কিন্তু দূরদর্শীতার অভাব আর খামখেয়ালী চিন্তা-ভাবনার ফলে বনরাজিকে ক্রমশঃ নিশ্চিহ্ন করে চলেছে সেরা জীব মানুষরাই। এক সময় এ দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে বিশেষ করে ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাংগাইল, জামালপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, পার্বত্য-চট্টগ্রাম ও সিলেটে ছিল মায়াভরা ডাগর চোখের মনোমোহিন দৃষ্টির হরিণদলের প্তি পদচারণা।
আগে এদেশে বেশ কয়েক প্রজাতির হরিণ ছিল। তম্মধ্যে চিত্রা, সাম্বার, পারা, বারশিংগা ও মায়া হরিণ উলেখযোগ্য। অথচ বর্তমানে কেবল চিত্রা হরিণই চোখে পড়ে, তাও কেবল সুন্দরবন অথবা চিড়িয়াখানাগুলোতে। জানা যায় সিলেটের বনাঞ্চল ও চা বাগানে আগে মায়া হরিণ বিচরণ করতো। এরা নম্র স্বভাবের আর ভয় পেলেই কুকুরের মত "ঘেউ ঘেউ" করতো। অথচ এখন আর বনের মাঝে বা চা বাগানের সঙ্কীর্ন আঁকা-বাঁকা পথে এদের দেখা যায় না। চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেকেই সৌখিনতার বসে মায়া হরিণ পালন করতেন। হয়তো এমন হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে, বর্তমানের চিত্রা হরিণও অন্যান্য প্রজাতির হরিণের মতন এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যেহেতু চিড়িয়াখানাগুলোতে চিত্রা হরিণ অত্যন্ত সহজে পোষা সম্ভব হচ্ছে সেহেতু বসতভিটায়ও হরিণ পোষা বাস্তব দিক থেকে সম্ভব।

অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় হরিণ পালনঃ

হরিণ পালন বেশ লাভজনক। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া এবং হাঁস-মুরগির মাংসের তুলনায় হরিণের মাংস অবশ্য অনেক বেশি ব্যয়বহুল। সম্ভবতঃ সেটা অনেকটা দুষপ্র্যাপ্যতার কারণেই হবে। সে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে বসতভিটায় হরিণ পালনের মাধ্যমে আয়-রোজগার করার ধ্যান-ধারনা তাই হয়েতো অবাস্তব কিছু হবে না।
* হরিণ পালন আমাদের সমাজে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। যে বাড়ীতে হরিণ পালিত হয় সে বাড়ির মালিকের পরিচিতি সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। এই পরিচিতিতে তিনি অবশ্যই আনন্দিত ও গৌরবান্বিত হন মনে মনে। সেই সাথে আগন্তুক বা জনসাধারনও বিনোদনের খোরাক পান। আর বিশেষ করে ছোট ছেলে মেয়েদেরতো সীমাহীন আনন্দের উৎস হয় এই হরিণ-হরিণী।
* পশমযুক্ত হরিণের চামড়া যা ফ্যানসি স্কিন (Fancy skin) হিসাবে ঘরের দেয়ালে শোভা বর্ধন করে তার কিন্তু মূল্য যথেষ্ট। এছাড়া চামড়াজাত বিভিন্ন প্রকারের অতি মূল্যবান পণ্য তৈরিতে হরিণের চামড়া ব্যবহৃত হয়। দেশে বিদেশে ঘরের পরিবেশ সুশোভিত করতে হরিণের ফ্যানসি চামড়া অতি কাঙ্খিত একটি উপকরণ।
* হরিণের শিং যে কতো বৈচিত্রময় ও কাব্যিক হতে পারে তার একমাত্র দৃষ্টান্ত হচ্ছে সে নিজেই। পুরুষ হরিণের এক জোড়া শিং ড্রয়িং রুমের অবরবকে আভিজাত্য আর সৌন্দর্যের আবরণে রূপময় করে তোলে। উলেখ্য যে প্রজনন ঋতুতে হরিণের মাথায় শিং গজায় এবং এক সময় তা আবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে খসে পড়ে। ফলে সখের বশে হরিণ পালন করা হলে তা থেকে প্রতি বছরই এক জোড়া শিং উপহার পাওয়া যায়।

বসতবাড়ীতে হরিণ পালন ও পরিচর্যাঃ

কৃষিভিত্তিক এদশের মানুষ বহুকাল ধরেই গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল পালন করে আসছে। তাদের এ বাস্তব অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে তৃনভোজী আলোচ্য এই আকার্ষণীয় প্রাণীটিকে লালন পালন ও পরিচর্যার জন্য উদুদ্ধকরণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ছাগল পালনের ন্যায় হরিণ পালনও একটি সহজসাধ্য ব্যাপার। আমাদের দেশের আবহাওয়া হরিণ পালনের জন্য যথেষ্ট অনুকূল। পরিচর্যার ক্ষেত্রে তেমন কোনো জটিলতা না থাকলেও এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পশুচিকিৎসক ও পশুপুষ্টিবিদগণ সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করতে পারবেন। বর্তমান বিশ্ব এখন প্রযুক্তির চরম সীমায় উপস্থিতি। এমতবস্থায় হরিণ পালনকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের কাঠামোতে অন্তভূক্ত করা যায় কীনা সেটা সম্ভবতঃ ভাববার সময় এসেছে। সরকার ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করলে হয়তো একটা দিক নির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে।

হরিণ সংরক্ষণে প্রয়োজন গণ সচেতনতাঃ

বন্য প্রাণী হরিণ আমাদের জাতীয় সম্পদ। বর্তমানে পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হয়ে এ প্রাণীর জীবন বিপন্ন হতে চলেছে। অর্থলোভী হিংস্র শিকারীদের দুর্বার আকর্ষন এখন অসহায় মায়াবী হরিণ কুলের উপর। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকহারে হরিণ শিকারের সংবাদ প্রায়শঃ দেখা যাচ্ছে যা আমাদের দেশের জন্য সত্যিই অত্যন্ত হতাশা ও উদ্বেনের বিষয়। পত্রিকান্তরে জানা যায় "শীতের শুরুতেই সংঘবদ্ধ শিকারীদের তৎপরতা শুরু হয়। অহরহ উদ্ধার করা হয় জীবিত অথবা মৃত হরিণ ও হরিণের চামড়া। সমপ্রতি হরিণ শিকারের ১ হাজার ফাঁদসহ একটি ট্রলার আটক করা হয়েছে। পূর্ব সুন্দরবনের শরনখোলা রেঞ্জের দুবলারচরে প্রতিবছর হিন্দু সমপ্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী উৎসব রাসমেলা উদযাপিত হয়ে থাকে। এই মেলাকে উপল্য করে এক শ্রেণীর দুবৃত্ত যারা শিকারী নামে অভিহিত মেতে ওঠে হরিণ শিকার যজ্ঞেও। শিকারীদের ফাঁদে আটকে পড়া হরিণের পায়ের গোড়ালীতে মারাত্মক ক্ষত হয়। মাঝে মধ্যে এসব দুষকৃতকারীদের কেউ কেউ ধরা পাড়লেও অধিকাংশই রয়ে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সুন্দরবনে অন্যায়ভাবে প্রতিদিন কত হরিণ শিকার হচ্ছে তার কোনো খতিয়ান পাওয়া যায় না। প্রাকৃতিক গুরুত্বের কারণে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষনা করা হয়েছে। একটি সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখতে সর্বস্তরের জনগণের সচেতনতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই, অবিলম্বে সুন্দরবনের হরিণ রক্ষার পাশাপাশি দেশের চিড়িয়াখানাগুলোতে ব্যাপকভাবে হরিণের প্রজনন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের হরিণ প্রজনন কেন্দ্রের আদলে আভয়ারণ্যগুলোতে হরিণের প্রাকৃতিক বিচরণ ভূমি সৃষ্টি করতে হবে। উৎসাহী ও অভিজ্ঞ চাষীদের মাঝে হরিণ শাবক বিলির ব্যবস্থাও নেয়া প্রয়োজন। হয়তবা সেদিন আর বেশি দূরে নয় যখন কৃষকের বসতভিটা হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগলের পাশে মায়াবী হরিণ-হরিণী কৃষক কূলের মনকে কাব্যিক করে তুলবে।

লেখক: মোঃ আনোয়ারুল কাদির

প্রশিক্ষক (পশুসম্পদ), ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমী, সিলেট।
তথ্যসূত্র: পোলট্রি, পশুসম্পদ ও মৎস্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকা ‘খামার’
এগ্রোবাংলা ডটকম

হরিন পালনের নীতিমালা

বনের চিত্রল হরিণ এখন থেকে ঘরে ও খামারে পোষা যাবে। তবে এ জন্য পালনকারীকে হরিণের বসবাস উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এ জন্য একটি নীতিমালা অনুমোদন করেছে। এতে বন বিভাগকে হরিণ পোষার অনুমতির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং এর জন্য ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বন বিভাগ দেশের বিভিন্ন বন অফিস থেকে হরিণ পোষার অনুমোদন দিতেও শুরু করেছে।

পরিবেশবাদীরা মনে করছেন, ঢালাওভাবে হরিণ পালনের অনুমতি দিলে এর অপব্যবহার হতে পারে। বন্য হরিণ আরও বিপন্ন হতে পারে। বাংলাদেশ বন্য প্রাণী আইন (সংরক্ষণ, সংশোধন), ১৯৭৪-এর আওতায় চিত্রল হরিণ পোষাসংক্রান্ত নীতিমালা-২০০৯ অনুমোদন করেছে সরকার। তবে চিত্রল ছাড়া অন্য কোনো হরিণ পোষা যাবে না। কেউ অন্য হরিণ পুষলে তাঁর বিরুদ্ধে বন্য প্রাণী আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগে বন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় হরিণ লালন-পালনের অনুমোদন দিত। এ ক্ষেত্রে বন বিভাগের কাছ থেকে প্রাথমিক অনুমোদন নিতে হতো। এই নতুন নীতিমালায় চিত্রল হরিণ লালন-পালন ও ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে।

নীতিমালার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে, চিত্রল হরিণ পাওয়া যায় এমন বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে এই হরিণ পোষা যাবে না। ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১০টি চিত্রল হরিণ পোষা যাবে। এর বেশি হলে খামার হিসেবে অনুমতি নিতে হবে। বন বিভাগ ও চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী হরিণ বিক্রি করতে পারবে। তবে হরিণ কিনতে হলে বন বিভাগের কাছ থেকে ‘পজেশন সার্টিফিকেট’ নিতে হবে।
পরিবেশ ও বনসচিব মিহির কান্তি মজুমদার এ ব্যাপারে বলেন, ‘হরিণ পালনের জন্য নীতিমালা অনুমোদিত হলেও বন বিভাগ আপাতত কোনো হরিণ বিক্রি করবে না। দেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে হরিণগুলো রয়েছে, ওই হরিণগুলোকে ক্রয়-বিক্রয়ের বৈধতা দেওয়া হবে।’
খামার ছাড়া অন্যত্র অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে বা বাসাবাড়িতে চিত্রল হরিণ পোষার অনুমোদন ফি ধার্য করা হয়েছে ৫০০ টাকা। মহানগর এলাকায় প্রতি খামারের জন্য অনুমোদন ফি দুই হাজার টাকা। জেলা সদর এলাকায় প্রতি খামারের জন্য ফি আড়াই হাজার টাকা। অন্য এলাকায় খামারের জন্য ফি দুই হাজার টাকা। প্রতিটি হরিণের জন্য পজেশন ফি ১০০ ও নবায়ন ফি বছরে ১০০ টাকা।

খামারের হরিণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বন সংরক্ষক ও ব্যক্তিগত হরিণের ক্ষেত্রে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন দিতে হবে। হরিণ পরিণত হলে তার মাংস খাওয়া যাবে। তবে বাচ্চা প্রসব করলে বা মারা গেলে ঘটনা ঘটার ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের কাছে তা জানাতে হবে। হরিণের মাংস বা কোনো অঙ্গ স্থানান্তর করতে হলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে স্থানান্তর অনুমোদন নিতে হবে। কাউকে হরিণ দান করতে হলেও বন বিভাগকে অবহিত করতে হবে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই লাখ চিত্রল হরিণ রয়েছে। চিত্রল হরিণের মূল বসতি এলাকা সুন্দরবনে রয়েছে প্রায় দেড় লাখ। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে ১২ থেকে ১৫ হাজার। এ ছাড়া চর কুকরিমুকরি, বাঁশখালীসহ উপকূলীয় বনে বিচ্ছিন্নভাবে হরিণের বসতি রয়েছে।