Sunday, 29 May 2011

পাট চাষের বিস্তারিত তথ্য

পাট চাষের বিস্তারিত তথ্য

পাট তন্তু জাতীয় উদ্ভিদ। পাটগাছের ছাল থেকে পাটের আঁশ সংগ্রহ করা হয়। আমাদের দেশে পাটকে সোনালি আঁশও বলা হয়। কারণ পাটের আঁশের রঙ সোনালি এবং বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ২৫ শতাংশ আসে এ থেকে। পাট থেকে বিভিন্ন প্রকার পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন হয়ে থাকে। যেমন- সুতা, থলি, চট, দড়ি, সুতলি। পাট দ্বারা বিভিন্ন প্রকার পর্দা, কার্পেট, জায়নামাজ, ত্রিপল, গালিচা, গদি, শিঁকা, আসন, পাটখড়ি, কাগজ, পারটেক্স, হার্ডবোর্ড তৈরি হয়।

বিশ্বে মোট ১৮.৮৮ লাখ হেক্টর জতিতে পাট চাষ হয় এবং ৩২ লাখ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদন ১ হাজার ৬৫৬ কেজি। পাট উৎপাদনে বিশ্বে এশিয়া মহাদেশই প্রথম। বিশ্বে ৯৫ শতাংশ পাট এশিয়ায় জন্মে। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। কিন্তু মেস্তা জাতীয় পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। ২০০৪ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৮.৩৩ লাখ মেট্রিক টন পাট বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। বিশ্বে এর উৎপাদনের হার ২৬.০২ শতাংশ। এ সময় ৫ লাখ ১ হাজার হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদন করা হয়। এবং হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৬২৩ কেজি।

মেস্তা পাট উৎপাদনে ভারত প্রধান। ১৭.৮২ লাখ মেট্রিক টন পাট উৎপন্ন হয় ভারতে। বিশ্বের উৎপাদনের ৫৫.৬৮ শতাংশ। ৯.৯০ লাখ হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদন হয়। হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদনের পরিমাণ ১ হাজার ৭৫৮ কেজি। ২৫ শতাংশ পাটে আমাদের চাহিদা পূরণের পর ৬০ শতাংশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং ১৫ শতাংশ ভারতে রফতানি করা হয়। বাংলাদেশে বেশি পাট উৎপাদন করতে গেলে আগে আলোচনায় আসা দরকার। বাংলাদেশে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বিজেআরআই (The Bangladesh Jute Research Institute) ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে পাট উৎপাদনে প্রথম আগমন ঘটান ১৭৯৫ সালে তৎকালীন কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিচালক Sir William Roxburgh। তার গবেষণার ফল হিসেবে পাট থেকে পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনের ইতিহাসের সূত্রপাত। পরবর্তী সময়ে কাঁচামাল হিসেবে পাট ব্যবহার করে ১৮৩২ সালে ইন্ডাস্ট্রি অব ড্যান্ডি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৩ সালে Jhomas Neigh প্রতিষ্ঠা করেন উন্নত ড্যান্ডি ইন্ডাস্ট্রি। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে আজকের এ সোনালি আঁশের বিকাশ ও ব্যবহার পৃথিবীর মানুষকে আকৃষ্ট করছে।

এ পাট বিভিন্ন জাতের হয়ে থাকে। পাটের জাত অনুযায়ী পাট উৎপাদনে জমি, চাষ পদ্ধতি ও সময় উপযোগী জৈব এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার হয়ে থাকে। আমাদের দেশে তোষা ও দেশি দুই ধরনের পাট হয়ে থাকে। এছাড়া অল্প পরিমাণে কেনাফ এবং মেস্তা পাট উৎপাদন হয়ে থাকে। তোষা পাট প্রধানত উঁচু জমিতে ভালো জন্মে, পক্ষান্তরে দেশি পাট নিচু, মধ্যম ও উঁচু সব প্রকার জমিতে জন্মাতে পারে। উর্বর জমি ছাড়াও যেসব জমিতে খরিফ মৌসুমে বোনা আউশ ধান এবং পাটের ফলন সন্তোষজনক হয় না সেসব জমিতেও কেনাফ এবং মেস্তা ভালো হয়। তবে মেস্তা বেলে মাটির জন্য অধিক উপযোগী এবং কেনাফ নিচু জমিতেও হতে পারে।

তোষা, দেশি, কেনাফ এবং মেস্তার মধ্যে তোষা পাটের আঁশ সবচেয়ে সুক্ষ্ম, মসৃণ এবং শক্ত হয়। পাট থেকে কাপড় ও পাটজাত দ্রব্য তৈরিতে তোষা পাটের উপযোগিতা অধিক বলে এ পাটের দামও অপেক্ষাকৃত বেশি। তাই তোষা পাটের আবাদ আমাদের দেশে বাড়ছে। পৃথিবীতে ২৯ প্রকার পাটজাত উদ্ভাবিত হয়েছে। তার মধ্যে তোষাই সর্বোৎকৃষ্ট।

রোপণের সময়ের ওপর ভিত্তি করে তোষা পাটকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। বৈশাখমাসি (১৫ থেকে পরবর্তী সময়) জাত, যথা- ও-৪ এবং ফাল্গুন-চৈত্রমাসি (১০ মার্চ থেকে পরবর্তী সময়) জাত-ও-৯৮৯৭ এবং ওএম-১।

বৈশাখমাসি জাত ও-৪ :

১৯৬৪ সালে আমাদের দেশে প্রথম উদ্ভাবন হয়। সাধারণত বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শেষ পর্যন্ত প্লাবনমুক্ত উঁচু জমিতে এ পাট রোপণ করা হয়। এ পাট গাছের রঙ সম্পূর্ণ সবুজ। পাতা আকষর্ণীয় লম্বা ও চওড়া। এ পাটের আঁশ সব দেশি আঁশের চেয়ে অনেক উন্নত ও দাম অনেক বেশি। সময়মতো রোপণ ও পরিচর্যা করলে প্রতি হেক্টর জমিতে ৪.৫১ মেট্রিক টন (একরপ্রতি ৪৯ মণ) পাট উৎপাদন হয়।

ফাল্গুন-চৈত্রমাসি জাত ও-৯৮৯৭:

এ জাতের পাট সাধারণত ফাল্গুন মাসের শেষদিকে ও চৈত্র মাসের প্রথমদিকে রোপণ করা হয়। এ পাট সাধারণ ও-৪-এর মতো হয়, তবে উচ্চতা ৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এ পাটের উৎপাদন সবচেয়ে লাভজনক। রোপণের দিন থেকে ১২০ দিনে এ পাট কাটা হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ৪.৬১ মেট্রিক টন (একরপ্রতি ৫০ মণ) উৎপন্ন হয়। এ পাটের আঁশ পৃথিবীতে অন্যান্য জাতের পাট অপেক্ষা বেশি উন্নত ও সমাদৃত।

ওএম-১:

ফাল্গুনের শেষ সপ্তাহ থেকে এ পাট বপন করা হয়। এ পাট গাছ সাধারণত লম্বা, সুঠাম এবং দ্রুত বাড়ন্ত। গাছের কা- ঘন সবুজ। পাতার আকার তুলনামূলকভাবে বড় এবং রঙ ঘন সবুজ, মসৃণ ও চকচকে। এর আঁশের রঙ ও মান উন্নত। প্রতি হেক্টর জমিতে ৪.৮২ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন হয়।

দেশি পাট : জামিতে বীজ বপন সময়কাল এবং পাট কাটার সময়ের ওপর নির্ভর করে দেশি পাটের জাতকে দুভাগ ভাগ করা হয়েছে।
দেশি আশু বপন উপযোগী জাত।
দেশি নাবি বপন উপযোগী জাত।
দেশি আশু বপন উপযোগী জাত

সিসি-৪৫

এ জাত সাধারণ ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বপনকাল। এ জাতের পাট কেটে রোপা আমন ধান রোপণ করা হয়। এ পাট সাধারণত ৩.০০-৩.৫০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এর কা- সম্পূর্ণ সবুজ। প্রতি হেক্টর জমিতে ৫.১৬ মেট্রিক টন (একরপ্রতি ফলন ৫৬ মণ) উৎপাদন হয়।
বিজেসি-৭৩৭০ (বিজেআরআই দেশি-৫)
চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এর বপনকাল। এ পাট দ্রুত বর্ধনশীল। হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ৫.৪৬ মেট্রিক টন।
দেশি নাবি বপন উপযোগী জাত

সিভিই-৩

চৈত্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সারা চৈত্র মাস বপন এর আসল সময়। সাধারণত ৩.০০-৩.৫০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পরিণত বয়সে এর মাথায় শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি এবং তামাটে রঙের হয়ে থাকে। প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদনের পরিমাণ ৪.৫১ মেট্রিক টন।

বিজেসি-৩

চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এ পাট বপন করা হয়। গাছের সর্বাংশে সবুজ, পাতা সিডিএল-১ জাতের চেয়ে সরু ও ঢেউ খেলানো। অন্যান্য জাতের চেয়ে এক মাস আগে কাটা হয়। এ জাতের পাট থেকে প্রতি হেক্টরে ৪.৭২ মেট্রিক টন আঁশ পাওয়া যায়।

সিভিএল-১

চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত এ পাট বপনের সময়। এ জাত সাধারণত ১২২-১৩২ দিনে কাটা যায়। সময়মতো বপন ও পরিচর্যা করলে এ জাতের পাট থেকে সর্বোচ্চ ফলন আশা করা যায়। প্রতি হেক্টর জমিতে ৫.১৬ মেট্রিক টন আঁশ পাওয়া যায়।

কেনাফ

এইচসি-২ সাধারণত ফাল্গুন মাসের শেষ থেকে চৈত্র মাসের মধ্যে এ জাত বপনের আসল সময়। এ জাত সাধারণত ৬.৭০ মিটার লম্বা হয়। উপযুক্ত পরিচর্যায় এর হেক্টরপ্রতি ফলন হয় ৬.৬৩ মেট্রিক টন বা একরপ্রতি ৭২ মণ।

এইচসি-৯৫

এ জাতের পাটের বপন সময় ১ চৈত্র থেকে ১ বৈশাখ। দেশের উত্তরাঞ্চলে এ জাতীয় পাট বেশি উৎপাদন হয়। এর ফলন প্রতি হেক্টর জমিতে ৩.১১ মেট্রিক টন।
ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে এর বপনযোগ্য সময়। সাধারণত বেলে ও বেলে দোআঁশ মাটিতে এ জাতের পাট উৎপাদন হয়। উপযুক্ত পরিচর্যা ও পরিবেশ পেলে ১৯ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ৪৭০ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন হয়।

রবি ফসল তোলার পরপরই জমি চাষ করা উচিত। যদি চাষ দেয়া না যায়, তবে মৌসুমের প্রথমে বৃষ্টি হলেই জমি চাষ দিতে হবে। পাটের প্রকার ভেদে আড়াআড়ি ৫-৬ বার কিংবা প্রয়োজনবোধে তার চেয়ে কম অথচ গভীরভাবে চাষ করা প্রয়োজন। পাটের বীজ আকারে ছোট তাই জমির মাটি মই দিয়ে মিহি করে আগাছামুক্ত না করলে আশানুরূপ বীজ গজাতে পারে না। বেলে বা দোআঁশ মাটি অপেক্ষা এঁটেল মাটি ভালোভাবে চাষ করতে হয়। যেহেতু কেনাফ ও মেস্তার বীজ আকারে বড় তাই অন্যান্য পাটের মতো এত মিহি চাষের দরকার হয় না।

বীজের হার

দেশি পাট প্রতি হেক্টরে ৮ থেকে ১০ (কেজি)।
প্রতি একরে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার কেজি
তোষা পাট প্রতি হেক্টরে ৬ থেকে ৮ কেজি (প্রতি একরে আড়াই থেকে সাড়ে তিন কেজি)।
কেনাফ প্রতি হেক্টরে ১৪ থেকে ১৯ কেজি (একরপ্রতি ৬ থেকে ৮ কেজি)।
বীজ বপনের পর জমির পরিচর্যা
বপনের এক থেকে দেড় সপ্তাহ পর ‘জো’ অনুযায়ী আঁচড়া দিলে মাটি হালকা হয় ও জমিতে রস সংরক্ষিত হয় এবং অল্প খরচে আগাছাও দমন করা সম্ভব হয়।

গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিক অবস্থায় একরপ্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ চারা থাকা উচিত। বীজ বপনের ৩০-৪০ দিনে সব আগাছা নির্মূল করে সুস্থ ও সবল পাট গাছ রেখে বাকি গাছগুলো জমিতে উর্বরতা ও গাছের বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধাপে ধাপে উঠিয়ে ফেলতে হবে।
জলাবদ্ধতা পাটের ফলন ব্যাহত করে। তাই পাটের জমিতে যেন বর্ষার পানি না দাঁড়ায় কিংবা পানি জমে গেলেও যত যাতাতাড়ি সম্ভব পানি বের করে দিতে হবে।
আগাছা পাটের চারার বড় শত্রু। বপনের পর থেকে যথাসময়ে দুই বা ততোধিকবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা উঠিয়ে ফেলা উচিত এবং আঁচড়া কিংবা ‘হুইল হো’ দিয়ে মাটি আলগা করা প্রয়োজন।

সার ব্যবহারের পরিমাণ এবং পদ্ধতিগুলো:

পাটের জমিতে সঠিক সময়ে পরিমাণমতো সার ব্যবহার করে পাটের ফলন সহজেই বৃদ্ধি করা যায়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, রাসায়নিক সারের মধ্যে নাইট্রোজেন সার (ইউরিয়া) ফলন বৃদ্ধির প্রধান সহায়ক। ফসফরাস ও পটাশ সার (টিএসপি ও এমপি) এককভাবে ব্যবহার করে বেশি ফলন পাওয়া যায় না। বিশেষ করে ফসফরাস আঁশের গুণগত মান বৃদ্ধি করে ও পটাশ সার গাছের রোগ প্রতিরোধ করে। অন্যদিকে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ একসঙ্গে জমিতে প্রয়োগ করে সাধারণ ফলনের চেয়ে প্রতি হেক্টরে ১ হাজার কেজি অর্থাৎ একরে ৩৭২ কেজির অধিক এবং কোনো কোনো অঞ্চলে আরো বেশি ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলের মাটিতে গন্ধক ও দস্তার অভাব রয়েছে, সেসব জমিতে পরিমাণমতো গন্ধক ও দস্তা সার প্রয়োগ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো এবং বিভিন্ন অঞ্চলের পাটচাষিদের জমিতে পরীক্ষা করে পাট চাষের জন্য সার প্রয়োগের বিধিব্যবস্থা ও সারের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে, যদিও মাটি পরীক্ষা করে সারের পরিমাণ নির্ণয় করাই প্রকৃষ্ট উপায়। কিন্তু যেসব কৃষক মাটি পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা নিম্নলিখিত সুপারিশ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে পারেন। যদি গোবর বা অন্য যে কোনো প্রকার জৈব সার পাওয়া যায় তবে অবশ্যই পাটের জমিতে যথাসম্ভব প্রয়োগ করতে হবে। কারণ জৈব সার মাটির উর্বরতা শক্তি ও পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া জৈব সারে গাছের প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের খাদ্য উপাদান থাকে বলে অন্যান্য রাসায়নিক সার কম লাগে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ডি-১৫৪, সিভিএল-১, সিসি-৪৫, সিভিই-৩, কেনাফ, মেসমআ, ও-৪ এবং ও-৯৮৯৭ (ফাল্গুনী তোষা) জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ৪.৬ টন অর্থাৎ প্রতি একরে ১৮.৬ কুইন্টাল গোবর সার বীজ বপনের ২-৩ সপ্তাহ আগে জমিতে সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

যদি উপরোক্ত পরিমাণে গোবর সার ব্যবহার করা হয় তাহলে বীজ বপনের দিন ডি-১৫৪, সিডিএল-১, সিসি-৪৫ সিভিই-৩ এবং ও-৪ জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ১৪.৫ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। টিএসপি এবং এমপি সারের প্রয়োজন নেই। ফাল্গুনী তোষা জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ৪৯ কেজি ইউরিয়া, ৫ কেজি টিএসপি, ১৪ কেজি এমপি; ওএম-১ জাতের জন্য ৩৭.৫ কেজি ইউরিয়া, ৫ কেজি টিএসপি; কেনাফ এইচসি-৯৫ জাতের জন্য ১৫.৫ কেজি ইউরিয়া, ৫ কেজি টিএসপি এবং মেস্তা-২৪ জাতের জন্য ৪ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।

গোবর ও অন্যান্য জৈব সারের অভাবে যদি শুধু রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়, তাহলে বীজ বপনের দিন ডি-১৫৪, সিভিএল-১, সিসি-৪৫, সিভিই-৩, ও-৪ জাতের জন্য হেক্টরপ্রতি ৮৩ কেজি জিপসাম, ১৭.৩ কেজি জিংক সালফেট একত্রে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ফাল্গুনী তোষা এবং ওএম-১ জাতের জন্য যথাক্রমে হেক্টরপ্রতি ১০০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমপি এবং ৮৮.৫ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি, ৪০ কেজি এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে উভয় জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ৯৭ কেজি জিপসাম ও ১৭.৩ কেজি জিংক সালফেট প্রয়োগ করতে হবে। মেস্তা এইচএস-২৪ এবং কেনাফ এইচসি-৯৫ জাতের জন্য যথাক্রমে ৫৫ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি, ৩০ কেজি এমপি এবং ৬৬.৫ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি, ৪০ কেজি এমপি সার মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে গন্ধক (সালফার) ও দস্তা (জিংক) অভাব অনুভব না হলে জিপসাম ও জিংক সালফেট ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। বীজ বপনের সময় জমিতে উপরোল্লিখিত পরিমাপের গোবর ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করলেও বীজ বপনের ৬-৭ সপ্তাহ পর জমি নিড়ানি দিয়ে আগাছামুক্ত করে ডি-১৫৪, সিভিএল-১, সিসি-৪৫, সিভিই-৩, ও-৪ জাতের জন্য হেক্টরপ্রতি ৮৩ কেজি; ফাল্গুনী তোষার জন্য ১০০ কেজি, ওএম-১ জাতের জন্য ৮৮.৫ কেজি, মেস্তা এইচএস-২৪ জাতের জন্য ৫৫ কেজি এবং কেনাফ এইচসি-৯৫ জাতের জন্য ৬৬.৫ কেজি ইউরিয়া সার কিছু পরিমাণ শুকনা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে হো অথবা নিড়ানি যন্ত্রের সাহায্যে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়বার সার প্রয়োগের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রয়োগকৃত সার গাছের কচি পাতায় এবং ডগায় না লাগে। আরো লক্ষ্য রাখতে হবে যে দ্বিতীয় কিস্তির সার দেয়ার সময় যেন মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে রস থাকে।

পাট, মেস্তা ও কেনাফের কিছু মারাত্মক রোগ : চারা মোড়ক, ঢলে পড়া, কাওপচা, শুকনো ক্ষত, কালো পট্টি, গোড়াপচা, আগা শুকিয়ে যাওয়া, পাতায় সাদা গুড়া পড়া; এছাড়া ভাইরাসজনিত ১. পাতায় হলদে গুঁড়া পড়া এবং ক্রিমি কীটঘটিত, ২. শিকড়ে গিট রোগ।

পাটের ক্ষতিকর পোকামাকড় ও তাদের দমন পদ্ধতি

পোকা মাকড়গুলো হলো
১. উড়চুংগা পোকা।
২. বিছা পোকা বা শুয়ো পোকা
৩. ঘোড়া পোকা
৪. কাতরী পোকা।

রোগ ও পোকা দমনের জন্য:

আমরা সাধারণত ৪০ শতাংশ হেক্টাক্লোর পাউডার একরপ্রতি ৪ পাউন্ড অথবা ২০ শতাংশ ডায়েলড্রিন পাউডার ব্যবহার করতে হবে। জোয়াজিনন ৬০ শতাংশ ছমি, নুভাক্রম ৪০ শতাংশ ইসি, ইকালক্স ডো ইসি ব্যবহার করা হয়। তোষা, দেশি ১২০ থেকে ১৩২ দিন পর কেটে এবং কেনাফ ও মেস্তা ৯০ থেকে ১০০ দিন পরপর কেটে পাতা ঝরিয়ে নিতে হয়। পরবর্তী সময়ে তা পানিতে জাগ দিয়ে পচন দিলে পাটকাঠি থেকে আঁশ ছড়াতে হয়। ওই আঁশ শুকিয়ে চাষিরা বাজারে বিক্রয় করেন। মহাজন শ্রেণী শুকনা পাট ক্রয় করে বি বটম, সি বটম, ডি বটম, শামলা, লালী, কাকটা বিভিন্ন শ্রেনীতে বিভাগ করে দেশীয় মিলে বিক্রয় বা বিদেশে রফতানি করে।

বাংলাদেশে পাট উৎপাদনে অনেক প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে বিধায় প্রচুর উন্নতমানের পাট উৎপাদন হয়। বর্তমান সরকারকে দেশীয় মিলগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করে পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনের সহায়তা করে দেশীয় চাহিদা মেটাতে পারে সেই সঙ্গে পাট ও পাটজাত দ্রব্য বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশকে স্বাবলম্বী ও বিশ্বমন্দার কবল থেকে রক্ষা করে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। আমরা চাই বাংলাদেশ একটি পূর্ণাঙ্গ স্বনির্ভর দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিশ্ব দরবারে দুর্নীতিমুক্ত সবল দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করুক এটাই জাতির কাম্য।
প্রতিবেদক: মো. রুস্তম আলী

পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পাট পচানো

পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পাট পচানো
পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পাট পচানো
বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে পাটের প্রচুর চাষ হয়, সেসব অঞ্চলে পাট সংগ্রহের সময় পর্যাপ্ত পানি না থাকলে ভালো মানের পাটের আঁশ পাওয়া সম্ভব হয় না। অবশ্য পচনের জন্য পর্যাপ্ত পানি থাকা অঞ্চলেও যথাযথভাবে পাট না পচানোর ফলে পাটের আঁশের মান ভালো হয় না। সে জন্য চাষিরাও ভালো দাম পান না। পাট সংগ্রহের পর এর পচন প্রক্রিয়া বা জাগ দেয়া তিনভাবে করা যেতে পারে।
১. যে এলাকার পানি বেশ পরিষ্কার এবং হালকা স্রোত আছে এমন জলাশয়ে (যেমনন্ধ বিল বা খালে) পাটগাছ পচানো।
২. রিবন রেটিং পদ্ধতিতে কাঁচা পাটের ছাল ছাড়িয়ে বড় চাড়ি বা পাত্রে পাট পচানো।
৩. মিনি পুকুর বা গর্ত তৈরি করে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট থেকে ছাড়ানো ছাল পচানো।
প্রথম পদ্ধতিতে পাট পচানোর আগে কাটা পাটগাছ ছোট-চিকন ও বড়-মোটা হিসেবে বাছাই করা দরকার। কারণ চিকন গাছের ছাল পাতলা তাই দ্রুত পচে এবং মোটা গাছের ছাল পুরু তাই দেরিতে পচে। এরপর বাছাই করা গাছগুলোকে ১০ কেজি ওজনের সমান করে আঁটি বাঁধতে হয়। আঁটি কখনোই শক্ত করে বাঁধতে হয় না। তাতে ভেতরের পাটগাছে পানি সহজে ঢুকতে পারে না বলে পচতে সময় বেশি লাগে বা কখনো কখনো পানির সংস্পর্শে আসে না বলে পচেই না। শক্ত করে বাঁধা আঁটির ভেতরে পাট পচনকারী জীবাণু বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া ঢুকতে পারে না। দুই ধরনের আঁটিগুলোকে আলাদা জাগ দিতে হয়। জাগের ওপরে কখনোই মাটি বা কলাগাছজাতীয় কিছু দিয়ে পানির নিচে ডুবানোর ব্যবস্খা করা ঠিক নয়। এতে পাটের আঁশের রঙ নষ্ট হয়।
দ্বিতীয় পদ্ধতিতে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে কাঁচা পাটের ছাল ছাড়িয়ে সেগুলো গোলাকার মোড়া বেঁধে বড় মাটির চাড়ি বা বড় পাত্রে সাজিয়ে পরিষ্কার পানি দিয়ে চাড়িটি ভরে দিতে হয়। এ রকম একটি বড় চাড়িতে প্রায় ৩০ কেজি ছাল পচানো যায়।

কম গভীরতাসম্পন্ন ছোট ডোবা বা পুকুর বা খালের পানিতে কাঁচা পাট থেকে ছাড়ানো ছাল গোলাকার করে মোড়া বেঁধে লম্বা বাঁশে ঢুকিয়ে বা ঝুলিয়ে পানিতে ডুবিয়ে দিতে হয়। বাঁশটি ডুবানোর জন্য দু’টি বাঁশের খুঁটি ডোবা, পুকুর বা খালের পানিতে দুই পাশে পুঁতে দিয়ে পাটের ছালের মোড়াসহ লম্বা বাঁশটি পানির নিচে বেঁধে দিতে হয়। এভাবে পচানো পাটের আঁশের মান বেশ ভালো হয়।

তৃতীয় পদ্ধতিতে বাড়ির আশপাশে বা ক্ষেতের পাশে ৫ মিটার লম্বা ও ২ মিটার চওড়া এবং ১ মিটার গভীর গর্ত খুঁড়ে গর্তের নিচ থেকে চার দিকের দেয়াল পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। এরপর পরিষ্কার পানি দিয়ে গর্তটি ভর্তি করে সেখানে কাঁচা পাটগাছ থেকে ছাড়ানো ছাল রেখে দিতে হয়। যদি পাওয়া যায় তাহলে কচুরিপানা দিয়ে ছালের মোড়াগুলো ঢেকে দেয়া যেতে পারে। এ পদ্ধতিকে পলিথিন ট্যাংক পদ্ধতি বলা হয়। পলিথিনের এ গর্তে কিছু পাট পচানো পানি দিলে দ্রুত পচন নিশ্চিত হয়। এ জন্য একটা ছোট হাঁড়িতে দুই থেকে তিনটি পাটগাছ কেটে টুকরো করে বা গাছের ছাল আগেই পচিয়ে নিয়ে পরে ওই পচা পানি ব্যবহার করা যায়।
পাটগাছ প্রথম পদ্ধতিতে পচানোর আগে কিছু কাজ করতে হয়। ক্ষেতে থেকে কাটার পর কাটা পাটগাছ তিন থেকে চার দিন ক্ষেতেই স্তূপ করে রাখলে পাতা ঝরে যায়। পাতাগুলো জমিতে ছড়িয়ে দিলে পচে ভালো সারের কাজ করে। এ সময়ের মধ্যে গাছগুলোও কিছুটা শুকিয়ে যায়। শুকানোর ফলে গাছগুলো পানিতে ডুবানোর সাথে সাথে বেশ পানি শুষে নেয়। এতে পচনপ্রক্রিয়া দ্রুত হয়।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় পদ্ধতিতে পাটগাছ থেকে ছাল ছাড়ানোর জন্য একটা পৌনে দুই মিটার লম্বা বাঁশ নিতে হয়। বাঁশের ওপরের দিকে আড়াআড়িভাবে কাটতে হয়, যাতে কাটা অংশটি দেখতে ‘ইউ’ বা হুকের মতো দেখায়। এরপর প্রয়োজনমতো উচ্চতা রেখে বাঁশের খুঁটির গোড়ার অংশ মাটিতে শক্ত করে পুঁতে দিতে হয়। এভাবে পাশাপাশি তিন থেকে চার ফুট পরপর প্রয়োজনমতো এমন কয়েকটি খুঁটি পোঁতা যেতে পারে। এরপর মাটিতে পোঁতা বাঁশের হুকগুলোর সাথে মাটির সমান্তরালে আরেকটি বাঁশ দিয়ে আড়া বাঁধতে হয়, যাতে জমি থেকে কেটে আনা পাটগাছ দাঁড় করিয়ে রাখা যায়। ওই পাটগাছগুলোর গোড়ার ৮ থেকে ১০ সেন্টিমিটার অংশ একটি শক্ত কাঠের বা বাঁশের গোড়া দিয়ে তৈরী হাতুড়ির সাহায্যে থেঁতলে দিতে হয়।

থেঁতলানো পাটগাছের গোড়ার ছাল হাত দিয়ে দুই ভাগ করে হুকের দুই পাশে ও গাছের গোড়া হুকের ভেতরে ধরে জোরে টান দিলে পাটের ছাল পাটের কাণ্ড বা পাটখড়ি থেকে আলাদা হয়ে যায়। হাতে পাটের ছাল থেকে যায় এবং পাটখড়ি সামনের দিকে চলে যায়। এভাবে তিন থেকে চারটি পাটগাছের ছাল এক সাথে পাটখড়ি থেকে আলাদা করা যায়। পরে ছালগুলো গোল করে মোড়া বেঁধে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পদ্ধতিতে পচানো যায়। বর্তমানে বাঁশের বদলে লোহার যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে একই রকমের রিবনার যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে।

অনেক সময়ই আঁশ ছাড়ানোর পর দেখা যায়, গোড়ার দিকের কিছু ছাল আলাদা না হয়ে যুক্ত রয়ে গেছে। এই ছালযুক্ত অংশ পরে কেটে বাদ দিতে হয়। সমস্যাটি সহজেই দূর করা যায় নিচের পদ্ধতি অনুসরণ করলে।
১. পাতা ঝরানোর পর পাটগাছের গোড়ার দিকের প্রায় ৪৫ সেন্টিমিটার তিন থেকে চার দিন পানির নিচে ডুবিয়ে রেখে তার পর জাগ দিতে হয়। এতে গোড়ার অংশ অনেক নরম হয় এবং ছাল ছাড়ানোর সময় গোড়ার আঁশ সহজেই আলাদা হয়।
২. পাটগাছের গোড়ার ৪৫ সেন্টিমিটার একটি কাঠের হাতুড়ির সাহায্যে হালকা করে থেঁতলে নিয়ে আঁটিগুলো পানিতে ডুবিয়ে দিতে হয়। তবে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হয়, দু’টি পদ্ধতি কখনোই একসাথে ব্যবহার করা যায় না। যেকোনো একটি পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। পানিতে জাগ তৈরির সময় প্রথম সারিতে লম্বালম্বিভাবে আঁটিগুলো পাশাপাশি রাখার পর দ্বিতীয় সারিতে আঁটিগুলো আড়াআড়িভাবে রাখতে হয়। তৃতীয় সারিতে আবার প্রথম সারির মতো লম্বালম্বিভাবে রাখতে হয়। ওপর-নিচে তিন থেকে চারটির বেশি সারি করা ঠিক নয়। এভাবে জাগ তৈরি করলে জাগের মধ্যে সহজেই পানি এবং পাট পচনকারী ব্যাকটেরিয়া জীবাণু প্রবেশ ও চলাচল করতে পারে। এতে পাটপচন সহজ হয়।

বদ্ধ জলাশয়ে পাট পচানোর ব্যবস্খা করলে প্রতি ১০০ আঁটির জন্য এক কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে পাট পচন দ্রুত হয়। এতে পাটের আঁশের রঙ ও মান ভালো হয়। ইউরিয়া সার কোনো একটি পাত্রে গুলে নিয়ে পচনপানিতে মিশিয়ে বা সরাসরি জাগের ওপরও ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে। চাড়িতে বা পলিথিন ট্যাংকে পাট পচানোর সময় প্রতি ১০০ মণ বা তিন হাজার ৭৩২ কেজি কাঁচা পাটের ছালের জন্য ০.৫ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হয়।

পাট বেশি পচলে আঁশ বেশ নরম হয়ে যায়, আবার কম পচলে আঁশ গায়ে ছাল লেগে থাকে। তাই এমন সময়ে পাটের পচনপ্রক্রিয়া থামানোর প্রয়োজন হয়, যখন আঁশগুলো একটার সাথে আরেকটা লেগে থাকে না, কিন্তু শক্ত থাকে। জাগ দেয়ার ৮ থেকে ১০ দিন পর থেকেই হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। দুই থেকে তিনটি পচা পাটগাছ জাগ বা ছালের মোড়া থেকে বের করে ধুয়ে আঁশ পরীক্ষা করে পচনের শেষ সময় ঠিক করা যায় বা বের করা যায়। পচা পাটের মধ্যাংশ থেকে দুই থেকে তিন সেন্টিমিটার পরিমাণ ছাল কেটে ছোট একটি স্বচ্ছ শিশির ভেতরে পরিষ্কার পানি দিয়ে ঝাঁকিয়ে যদি দেখা যায়, আঁশগুলো বেশ খানিকটা আলাদা হয়ে গেছে তখন বুঝতে হয় পচনপ্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। একটা কথা মনে রাখা খুব প্রয়োজন, বেশি পচনের চেয়ে একটু কম পচনই ভালো। সঠিক সময়ে আঁশ ছাড়ালে কাটিংসের পরিমাণ কম হয়। আঁশ ছাড়ানোর সময় গোড়ার পচা ছাল হাত দিয়ে টেনে ফেলে দিলেও কাটিংসের পরিমাণ কমানো যায়। উন্নত মানের আঁশ পেতে হলে অবশ্যই প্রচলিত পদ্ধতিতে জলাশয়ে গাছসহ জাগ না দিয়ে রিবন রেটিংয়ের মাধ্যমে ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে জাগ দিয়ে আঁশ সংগ্রহ করতে হয়।

বিনা চাষে পাট উৎপাদন

একসময় পাট ছিল আমাদের সোনালি আঁশ। মাঝখানে নানান কারণে পাট প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছিল। কিন্তু পাটের সেই সুদিন আবার ফিরে এসেছে। ফলে পাট চাষে এখন আবারো আগ্রহী হয়ে উঠেছেন চাষি ভাইয়েরা। কারণ পাটের বাজারমূল্য এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো। এই মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় পাট জাগ দেয়ায় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বিকল্প পাট জাগ দেয়ার জন্য রিবন রেটিংয়ের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কৃষি বিভাগ এই বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। রিবন রেটিংয়ের সাহায্যে পাট জাগ দেয়ায় পাটের গুণগত মান ভালো থাকে। এ বছর খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর এলাকার উপসহকারী কৃষি অফিসার আশুতোষ মারফত জানা যায়, এই এলাকায় এ বছর এই পদ্ধতিতে প্রায় ১০০ একর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। চাষিরা জানান, বোরো জমিতেই পাট চাষ করা সম্ভব।

চাষ কৌশল : বোরো ধান কাটার ২০-৩০ দিন আগে ধানের জমিতে জো অবস্খায় অর্থাৎ মাটিতে রস থাকা অবস্খায় বোরো ধানের জমিতে পাট বীজ বুনে দিতে হয়। মাটিতে রসের অভাব হলে একটা সেচ দিয়ে নিতে হবে। কিছু দিনের মধ্যে পাটবীজ গজাবে।

বীজের পরিমাণ : প্রতি বিঘা জমিতে (৩৩ শতাংশ) ১০০০ গ্রাম-১২৫০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন।

জাতের নাম : তোষা পাটবীজ।

সারের পরিমাণ : কোনো সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই। বোরো চাষের সময় যে পরিমাণ সার ব্যবহার করা হয়েছে ওই ফসল তোলার পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তাতেই পাট উৎপাদন করা সম্ভব।

পরিচর্যা : বোরো ধান কাটার পর পাটের জমিতে দুইবার নিড়ানি দিতে হবে। এতে করে আগাছা দমন হবে এবং মাটির আস্তরণ ভাঙার ফলে মাটির রস সংরক্ষিত হবে।

ফলন : এই পদ্ধতিতে চাষ করে ১০-১২ মণ বিঘাপ্রতি (কাঁচা পাটের আঁশ) ফলন পেয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় চাষ দিয়ে চাষিরা পাট উৎপাদনে ফলন ৭-১০ মণ প্রতি বিঘায় পেয়েছেন। বিষয়টি অনেকের কাছে লাভজনক বলে মনে হয়েছে।

ভূমির পরিমাণ পদ্ধতি

ভূমির পরিমাণ পদ্ধতি

ভূমি সংক্রান্ত যাবতীয় দলিলাদি লিখন, সরকারি হিসাব ও অফিসের কাজ ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে ভূমির পরিমাপ হলো:
(১) ডেসিমেল বা শতাংশ বা শতক
(২) কাঠা,
(৩) বিঘা এবং
(৪) একর
এই পরিমাপ সর্ব এলাকায় সর্বজন গৃহীত। এটা "সরকারি মান"( Standerd Measurement) বলে পরিচিত।
উক্ত পরিমাপের কতিপয় নিম্নে প্রদান করা হলোঃ
ইঞ্চি, ফুট ও গজঃ
১২'' ইঞ্চি = ১ ফুট
৩ ফুট= ১ গজ
(৩) ভূমি যে কোন সাইজের কেন ভূমির দের্ঘ্য ও প্রস্থে যদি ৪৮৪০ বর্গগজ হয় তাহলে এটা ১.০০ একর (এক একর) হবে।
যেমনঃ ভূমির দৈর্ঘ্য ২২০ গজ এবং প্রস্থ ২২ গজ সুতরাং ২২০ গজ×২২ গজ= ৪৮৪০ বর্গগজ।

বর্গগজ/বর্গফুট অনুযায়ী শতাংশ ও একরের পরিমাণঃ
৪৮৪০ বর্গগজ = ১ একর ধরে
৪৮৪০ বর্গগজ = ১ একর
৪৩৫৬০ বর্গফুট= ১ একর
১৬১৩ বর্গগজ= ১ বিঘা
১৪৫২০বর্গগজ= ১ বিঘা
৪৮.৪০ বর্গফুট= ০১ শতাংশ
৪৩৫.৬০ বর্গফুট= ০১ শতাংশ
৮০.১৬ বর্গগজ= ১ কাঠা
৭২১.৪৬ বর্গগজ= ১ কাঠা
৫.০১ বর্গগজ = ১ ছটাক
৪৫.০৯ বর্গফুট= ১ কাঠা
২০ বর্গহাত = ১ ছটাকা
১৮ ইঞ্চি ফুট= ১ হাত (প্রামাণ সাই)

কাঠা, বিঘা ও একরের মাপঃ
১৬ ছটাক = ১/ কাটা
০.০১৬৫ অযুতাংশ = ১/কাঠা
০.৩৩ শতাংশ বা ০.৩৩০০ অযুতাংশ = ১ বিঘা
২০ (বিশ) কাঠা = ১ বিঘা
৩ বিঘা = ১.০০ একর।
টিকাঃ একশত শতাংশ বা এক হাজার সহস্রাংশ বা দশ হাজার অযুতাংশ= ১.০০ (এক) একর। দশমিক বিন্দুর (.) পরে চাষ অঙ্ক হলে অযুতাংশ পড়তে হবে।

মিলিমিটার ও ইঞ্চিঃ
১ মিলিমিটার= ০.০৩৯৩৭ (প্রায়)
১ সেন্টিমিটার= ০.০৩৯৩৭ (প্রায়)
১ মিটার = ৩৯.৩৭ ইঞ্চি বা ৩.২৮ ফুট/ ১.০৯৩ গজ (প্রায়)
১০০০ মিটার = ১ কিলোমিটার
১ কিলোমিটার= ১১ শত গজ
২ কিলোমিটার = (সোয়া মাইল)
১৭৬০ গজ = ১ মাইল
১৩২০ গজ = পৌন এক মাইল।
৮৮০ গজ = আধা মাইল
৪৪০ গজ = পোয়া মাইল।
১ বর্গ মিটার = ১০.৭৬ বর্গফুট (প্রায়)
১ হেক্টর = ২.৪৭ একর (প্রায়)
১ ইঞ্চি = ২.৫৪ সেন্টিমিটার (প্রায়)

গান্টার শিকল জরীপঃ
ভূমির পরিমাপ পদ্ধতি সঠিক এবং সহজ করার জন্য ফরাসী বিজ্ঞানী এডমন্ড গান্টা এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি ভূমি পরিমাপের জন্যে ইস্পাত দ্বারা এক ধরণের শিকল আবিষ্কার করেন। তিনি ভূমি পরিমাপের জন্য ইস্পাত দ্বারা এক ধরণের শিকল আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে তার নাম অনুসারেই এই শিকলের নামকরণ করা হয় গান্টার শিকল। আমাদের দেশে গান্টার শিকল দ্বারা জমি জরিপ অত্যন্ত জনপ্রিয়। একর, শতক এবং মাইলষ্টোন বসানোর জন্য গান্টার শিকল অত্যন্ত উপযোগী। এই শিকলের দৈর্ঘ্য ২০.৩১ মিটার (প্রায়) বা ৬৬ ফুট
গান্টার শিকল ভূমি পরিমাপের সুবিধার্থে একে ১০০ ভাগে ভাগ করা হয় থাকে। এর প্রতিটি ভাগকে লিঙ্ক বা জরীপ বা কড়ি বিভিন্ন নামে ডাকা হয়।
প্রতি এক লিঙ্ক = ৭.৯২ ইঞ্চি
দৈর্ঘ্য ১০ চেইন ×প্রস্থে ১ চেইন = ১০ বর্গ চেইন = ১ একর
গান্টার শিকলে ১০ লিঙ্ক বা ৭৯.২ ইঞ্চি পর পর নস বা ফুলি স্থাপন করা হয় (নস ফুলি)
২০ লিঙ্ক বা ১৫৮.৪ ইঞ্চি পর স্থাপিত হয়-
৩০ লিঙ্ক বা ২৩৭.৩ ইঞ্চি পর স্থাপিত হয়-
৪০ লিঙ্ক বা ৩১৬.৮ ইঞ্চি পর স্থাপিত হয়-
৫০ লিঙ্ক বা ৩৯৬.০ ইঞ্চি পর স্থাপিত হয়-
৮০ গান্টার বা ১৭৬০ গজ পর স্থাপিত হয়- মাইল ষ্টোন

একর শতকে ভূমির পরিমাপ
১০০ লিঙ্ক = ১ গান্টার শিকল
১০০০ বর্গ লিঙ্ক = ১ শতক
১,০০,০০০ বর্গ লিঙ্ক = ১ একর
আমাদের দেশে জমি-জমা মাপ ঝোকের সময় চেইনের সাথে ফিতাও ব্যবহার করা হয়। সরকারি ভাবে ভূমি মাপার সময় চেইন ব্যবহার করা হয় এবং আমিন সার্ভেয়ার ইত্যাদি ব্যাক্তিগণ ভূমি মাপার সময় ফিতা ব্যবহার করেন। ভূমির পরিমান বেশি হলে চেইন এবং কম হলে ফিতা ব্যবহার করাই বেশি সুবিধাজনক।

বিভিন্ন প্রকারের আঞ্চলিক পরিমাপ
আমাদের দেশে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন প্রকারের মাপ ঝোক প্রচলিত রয়েছে। এগুলো হলো কানি-গন্ডা, বিঘা-কাঠা ইত্যাদি। অঞ্চলে ভেদে এই পরিমাপগুলো আয়তন বিভিন্ন রকমের হয়ে তাকে। বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমির পরিমাপ বিভিন্ন পদ্ধতিতে হলেও সরকারি ভাবে ভূমির পরিমাপ একর, শতক পদ্ধতিতে করা হয়। সারাদেশে একর শতকের হিসাব সমান।

কানিঃ কানি দুই প্রকার। যথা-
(ক) কাচ্চা কানি
(খ) সাই কানি
কাচ্চা কানি: ৪০ শতকে এক বাচ্চা কানি। কাচ্চা কানি ৪০ শতকে হয় বলে একে ৪০ শতকের কানিও বলা হয়।
সাই কানিঃ এই কানি কোথাও ১২০ শতকে ধরা হয়। আবার কোথাও কোথাও ১৬০ শতকেও ধরা হয়।

কানি গন্ডার সাথে বিভিন্ন প্রকারের পরিমাপের তুলনা
২ কানি ১০ গন্ডা (৪০ শতকের কানিতে) = ১ একর
১ কানি = ১৭২৮০ বর্গফুট
১ কানি = ১৯৩৬ বর্গগজ
১ কানি = ১৬১৯ বর্গমিটার
১ কানি = ৪০ বর্গ লিঙ্ক
১ একর = ১০ বর্গ চেইন
১ একর = ১০০ শতক
১ একর = ৪,০৪৭ বর্গমিটার
১ একর = ৩ বিঘা ৮ ছটাক
১ একর = ৬০.৫ কাঠা
১ শতক = ১ গন্ডা বা ৪৩২.৬ বর্গফুট

বিঘা-কাঠার হিসাব
১ বিঘা = (৮০ হাত×৮০ হাত) ৬৪০০ বর্গহাত
১ বিঘা = ২০ কাঠা
১ কাঠা = ১৬ ছটাক
১ ছটাক = ২০ গন্ডা
১ বিঘা = ৩৩,০০০ বর্গলিঙ্ক
১ বিঘা = ১৪,৪০০ বর্গফুট
১ কাঠা = ৭২০ বর্গফুট
১ ছটাক = ৪৫ বর্গফুট

লিঙ্ক এর সাথে ফুট ও ইঞ্চির পরিবর্তন
লিঙ্ক = ৭.৯ ইঞ্চি
৫ লিঙ্ক = ৩ ফুট ৩.৬ ইঞ্চি
১০ লিঙ্ক = ৬ ফুট ৭.২ ইঞ্চ
১৫ লিঙ্ক = ৯ ফুট ১০.৮ ইঞ্চি
২০ লিঙ্ক = ১৩ ফুট ২.৪ ইঞ্চি
২৫ লিঙ্ক = ১৬ ফুট ৬.০ ইঞ্চি
৪০ লিঙ্ক = ২৬ ফুট ৪.৮ ইঞ্চি
৫০ লিঙ্ক = ৩৩ ফুট
১০০ লিঙ্ক = ৬৬ ফুট

এয়র হেক্টর হিসাব
১ হেক্টর = ১০,০০০
১ হেক্টর = ২.৪৭ একর
১ হেক্টর = ৭.৪৭ বিঘা
১ হেক্টর = ১০০ এয়র

বায়ো গ্যাস প্রকল্প প্রস্তুত প্রনালী

বায়ো গ্যাস প্রকল্প প্রস্তুত প্রনালী

বায়োগ্যাস প্রকল্প
যুগ-যুগ ধরে বাংলাদেশের গ্রামঞ্চলে রান্নাবান্নার কাজে কাঠ, খড়-কুটা, নাড়া, শুকনা গোবর এগুলোই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। বর্তমানে প্রতিবছর দেশে ৩ কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন এ জাতীয় জ্বালানির প্রয়োজন। জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারের ফলে গাছপালা উজাড় হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে আমরা শুধু বনজ সম্পদই হারাচ্ছি না, আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছি এক ভয়াবহ অবস্থার দিকে। অন্যদিকে গোবর, নাড়া এবং অন্যান্য পচনশীল পদার্থগুলো পুড়িয়ে ফেলার ফলে আবাদি জমি জৈব সার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে জ্বালানি সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। এই জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাসই একমাত্র এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে এবং নিশ্চিত করতে পারে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ উন্নতমানের জৈব সার, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও উন্নত জীবনযাত্রা।

বায়োগ্যাস কী ?

গোবর ও অন্যান্য পচনশীল পর্দাথ বাতাসের অনুপস্থিতিতে পচানোর ফলে যে বড়বিহীন জ্বালানি গ্যাস তৈরী হয় তাই হচ্ছে বায়োগ্যাস। এতে ৬০/৭০ ভাগ জ্বালানি গ্যাস তৈরী হয়ে অবশিষ্ট অংশ উন্নতমানের জৈবসার হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। জ্বলানি গবেষকরা, বলছেন, মানব বিষ্ঠা, মোরগ-মুরগীর বিষ্ঠা, জৈব আবর্জনা এবং গোবর থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ জাতীয় পর্দাথ থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন করে কলকারখানা এবং গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার হচ্ছে। বায়োগ্যাস ব্যবহার এবং উৎপাদনে গণচীন সবচেয়ে এগিয়ে আছ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বায়োগ্যাসের প্রচলন রয়েছে। গৃহস্থালী রান্নাবান্না এবং ম্যান্ডেলবাতি জ্বালানো ছাড়াও বায়োগ্যাস দিয়ে জেনারেটরের সাহায্যে বিদু্যৎ উৎপাদন করে বাতি, ফ্যান, ফ্রিজ, টিভিসহ অন্যান্য বৈদুত্যিক সরঞ্জামাদি চালানো সম্ভব। গবেষকরা বলছেন, ৭-৮ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের জন্য ৫-৬ টি মাঝারি আকারের গরুর দৈনন্দিন গোবর থেকে ১০৫ ঘনফুট গ্রাস উৎপাদন সম্ভব যা দিয়ে তিন বেলার রান্না-বান্না সহ একটি ম্যান্টেল বাতি জ্বালানো যাবে।
জ্বালানি সংকট সমাধানে এই মাধ্যমটিতে এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এর প্রসার ঘটেনি এ দেশের এতটুকুও। বাংলাদশে বিজ্ঞান ও গবেষণা পরিষদের জ্বালানি গবেষণা ও গোড়ার ইনস্টিটিউট এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে অনেক বছর ধরে।

কিভাবে বায়োগ্যাম প্লান্ট তৈরী করবো, এর কারিগরী তথ্য কোথায় পাব, এর নির্মাণ ব্যয় কত হবে ইত্যাদি।

৭/৮ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের জন্য ১০৫ (৩ ঘনমিটার) ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনক্ষম স্থিরডোম বায়েঅগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ পদ্ধতি

ডাইজেস্টার তৈরি পদ্বতি
২৫০ সে. মি. ব্যাস এবং ২২০ সে. মি. গভীর একটি গোলাকার কুয়া খননকরতে হবে। কুয়ার তলদেশ চাড়ির তলার আকৃতিতে খনন হবে যাতে হেব যাতে বাড়ির তলার মধ্যবিন্দু থেকে আর্চের উচ্চতা ৩০ সে. মি. (১ ফুট) হয় এর পর তলদেশে ভালো করে দুরমুজ করে নিতে হবে।
তলদেশে ৭.৫ সে. মি. পুরু ইট বিছিয়ে দিতে হবে। এই সোলিং-এর ওপর ১:৩:৬ (সিমেন্টঃ বালুঃ খোয়া) অনুপাতে ৫ সে. মি. পরু ঢালাই দিতে হবে। ঢালাই এর ওপর ২১০ সে. মি. ব্যাস (ভিতরে রেখে গোলাকৃতি ১২.৫ সে. মি. ইটের দেয়ালের গাঁথুনি করতে হবে। দেয়ালের উচ্চতা যখন ২৫ সে. মি. হবে

মনে করি,
প্রস্তাবিত ডাইজেস্টারের কেন্দ্র হতে ইনলেট চেম্বারের কেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্ব- x
এবং হাইড্রোলিক চেম্বারের কেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্ব- y
ডাইজেস্টারে ব্যাস- D
হাইড্রোলিক চেম্বারের ব্যাস- D2
ভূতল হতে ডাইজেস্টারের টপ ডোমের গভীরতা- ০.৩০ m
ডাইজেস্টারের উপরের ডোমের উচ্চতা- f1
ডাইজেস্টারের দেয়ালের উচ্চতা- H
ডাইজেস্টারের নীচের ডোমের উচ্চতা- f2
ডাইজেস্টারের দেয়ালের পুরুত্ব- T
উপরের ডোমের পুরুত্ব- T1
তলার ডোমের পুরুত্ব- T2
ইনলেট চেম্বারের দেয়ালের পুরুত্ব- T4
হাইড্রোলিক চেম্বারের দেয়ালের পুরুত্ব- T3
ইনলেট চেম্বারের কেন্দ্র- C2
ডাইজেস্টারের কেন্দ্র- C
হাইড্রোলিক চেম্বারের কেন্দ্র- C1
ওপরের ডোমের বক্রাকার বাঁকের ব্যাসার্ধ- R1
নীচের ডোমের বক্রাকার বাঁকের ব্যাসার্ধ- R2
biogas plant
তখন কুয়ার একদিকে হাইড্রলিক চেম্বারের মুখের জন্য ১৫০ সে. মি.× ৭৫ সে. মি. এবং অন্যদিকে ইনলেট পাইপ বসানোর জন্য ২০×২৫ সে. মি. গাঁথুনি খোলা রাখতে হবে। ১৫ সে. মি. ব্যাসবিশিষ্ট একটি আরসিসি পাইপ (ইনলেট পাইপ) দেয়ালের সঙ্গে আনুমানিক ৩০ ডিগ্রি কোণ রেখে বসিয়ে নিতে হবে।
biogas plant
দেয়ালের কাজ মোট ১০০ সে. মি. হলে হাইড্রলিক চেম্বারের দরজার কাজ শেষ হবে। দেয়ালেরকাজ পুনরায় শুরু করে হাইড্রলিক চেম্বারের মুখের উপরিভাগ থেকে ৪০ সে. মি. পর্যন্ত গেঁথে নিতে হবে। এখন দেয়ালের উপরিভাগে ১:২:৪ অনুপাতে ৭.৫ সে. মি.পুরু ঢালাই দিতে হবে। এই ঢালাই-এর ওপর ৭.৫ সে. মি. পুরু ইটের গাঁথুনি দিয়ে ৬০ সে. মি. আর্চ উচ্চতাবিশিষ্ট গম্বুজ আকৃতির ডোম তৈরী করতে হবে।

ডেমের উপরের অংশে গ্যাস নির্গমনের জন্য একটি ১.২৭ সে. মি. ব্যাসবিশিষ্ট ২৫ সে. মি. লম্বা জিআই পাইপ খাড়াভাবে স্থাপন করতে হবে। জিআই পাইপের উপরি অংশে একটি গ্যাস ভাল সংযুক্ত করতে হবে। এখন দেয়ালের ভিতরের অংশে নিচ থেকে হাইড্রলিক চেম্বারের মুখের উপরিভাগ পর্যন্ত ১:৪ অনুপাত ১.২৭ সে. মি. পুরু প্লাস্টার করতে হবে। হাইড্রলিক চেম্বারের মুখের উপরি ভাগ তেকে ডোমের ভেতরের সম্পূর্ণ অংশ ১:৩, ১:২, ১:১ অনুপাতে তিনবার প্লাস্টার করতে হবে।
biogas plant
প্রতিবার প্লাস্টারিং-এর পূর্বে সিমেন্ট পেস্ট করে ব্রাশ করে নিতে হবে। ৫/৬ কিউরিং করার পর ভেতরের ডোমসহ আউটলেটের মুখ পর্যন্ত দেয়ালের শুকনা অবস্থায় ১ মি. মি. পুরু মোম/সিলিকেট প্রলেপ দিতে হবে। ডোমের ওপরের সম্পূর্ণ অংশ প্লাস্টার করে নিতে হবে।

হাইড্রোলিক চেম্বার
৭.৫ সে. মি. ইটের গাঁথুনি দিয়ে ২ স্তরবিশিষ্ট একটি আয়তাকার হাইড্রলিক চেম্বার তৈরী করতে হবে। নিচু ও ওপর চেম্বারের মাপ হবে যথাক্রমে ১০০ সে. মি. দৈর্ঘ্য × ১৫০ সে. মি. প্রস্থ × ১১৫ সে. মি. উচ্চতা এবং ১৬০ সে. মি. দৈর্ঘ্য × ১৫০ সে. মি. প্রস্থ × ৬০ সে. মি. উচ্চতা। ৬০ সে. মি. দেয়ালের শেষ হলে স্পেন্ট স্লারি নির্গমনের জন্য একটা খোলা পথ/দরজা রাখতে হবে হাড্রলিক চেম্বারের ভিতরে দিক ১:৪ অনুপাতে প্লাস্টার কাজ শেষ করে নিতে হবে। স্পেন্ট স্লারী নির্গমনের পথের ওপরে আরও ৭.৫ সে. মি. গেঁথে নিতে হবে। হাইড্রলিক চেম্বারের ওপরের অংশ ঢেকে রাখার জন্য প্রয়োজনবোধে স্লাব ব্যবহার করতে হবে।

ইনলেট ট্যাঙ্ক
ইনলেট পাইপের মুখে ৬০ সে. মি. × ৬০ সে. মি. মাপে একটি ১২.৫ পুরু ইটের ট্যাঙ্ক তৈরী করতে হবে। এই ট্যাঙ্ক ভেতরের অংশ ভালোভাবে প্লাস্টার করতে হবে। ডাইজেস্টার হাইড্রলিক চেম্বার এবং ইনলেট ট্যাঙ্ক তৈরীর পর প্লান্টের চারপাশে বালি ও মাটি দিয়ে এমনভাবে ভরাট করতে হবে যেন ডোমের উপরিভাগ পর্যন্ত মাটির নিচে থাকে।

প্লান্ট চালু করার নিয়মাবলী
প্লান্ট চালু করার সময় ১.৫/২ টন কাঁচামাল যথা গোবর, হাঁস-মুরগির মল, মানুষের মল জাতীয় পচনশীল পদার্থের প্রয়োজন। প্লান্ট তৈরির শুরু থেকে এগুলেপা জমা করে রাখলে প্লান্ট চালুর সময় এগুলো ব্যবহার করা যাবে। অবশ্য কেউ যদি ২/১ দিনেই উক্ত পরিমান কাঁচামাল যোগাড় করতে পারেন, তবে আগে থেকে জমা করে রাখার প্রয়োজন নেই। জমাকৃত কাঁচামাল এবং পরিষ্কার পানি গোবরের ক্ষেত্রে ১:১ হাঁস-মুরগির মলের ক্ষেত্রে ১:৩ অনুপাতে মিশিয়ে ইনলেট পাইপ দিয়ে আস্তে আস্তে কুয়ায় ঢালতে হবে। চার্জিং-এর সময় খেয়াল রাখতে হবে মাটির চাকা, পাথর, বালি, বড় সাইজের খড়কুটা ইত্যাদি যেন কুয়ার ভিতর প্রবেশ না করে। যদি প্লান্ট সম্পূর্ণ ভর্তি না হয়, বাকি অংশ পানি দিয়ে ভরে নিতে হেব।

প্লান্ট এবং গ্যাস বাল্বের ছিদ্র পরীক্ষা
গ্যাস বাল্বের ছিদ্র পরীক্ষার জন্য পলিথিন পাইপের গ্যাস বাল্বের মাথা পানির মধ্যে সামান্য ডুবিয়ে দিতে হবে। যদি বাল্ব বন্ধ অবস্থায় পানিতে বুদবুদ তৈরী হয়, তবে বুঝতে হবে বাল্বের ভিতর ছিদ্র আছে। বাল্বের গোড়ায় সাবানের ফেনা লাগিয়ে যদি বুদবুদ দেখা তবে ধরে নিতে হবে বাল্বের গোড়ায় গ্যাস লিক রয়েছে। এমতাবস্থায় গ্রিজ ও পাট জাতীয় কিছু দিয়ে ছিদ্র বন্ধ করতে হবে।

গ্যাস সরবরাহের নিয়ম
১.২৭/২.৫৪ সে. মি. চওড়া পিভিসি / জিআই পাইপ লাইন প্লান্ট থেকে চুলা, হ্যাজাক লাইট, জোনারেটর পর্যন্সংযোগ করতে হবে। যেহেতু বায়োগ্যাসে পানি মিশ্রিত থাকে, সেহেতু পানি জমে থাকার সম্ভবনা থাকবে না। পাইপের এক মাথা একটি প্লাস্টিক পাইপের সাহায্যে প্লান্টের সরবরাহ লাইনে এবং অন্য মাথাটি চুলা, হ্যাজাক, লাইট, জেনারেটর ইত্যাদির সাথে টি-এর সাহায্যে যুক্ত করে নিতে হবে।
৩ মিটার (১০৫) ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনক্ষম স্থিরডোম বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণের উপকরণ সমূহের পরিমাণ এবং মূল্য ১৯৯৪ সালের বাজর অনুসারে দেয়া হল। ১ হাজার ইট ২,৭০০ টাকা, ১২ বস্তা সিমেন্ট, ২,৭০০ টাকা, ১২০ ঘনফুট বালু ৫০০ টাকাক, আরসিসি পাইপ ১২ ফুট ১৫০ টাকা, রাজমিস্ত্রি ৮ জন ৮০০ টাকা, হেলপার ১২ জন ৬০০ টাকা, গ্রঅস বাল্ব (শর্ট পিসসহ) ১টি ১০০ টাকা, মোম ২ কেজি ১০০ টাকাক, বার্নার ১টি ৫০০ টাকাক, হ্যাজাক ১টি ৫০০ টাকা, পাইপ ২০০ টাকা, কুয়া খনন ৫০০ টাকা এবং অন্যান্য খরচ ২০০ টাকা মিলে মোট ৯,৫৫ টাকা আনুমানিক খরচ হবে। এ জাতীয় একটি গ্যাস প্লান্টের স্থায়িত্ব হবে অন্তত ৩০ বছর।

বর্তমানে বাংলাদেশে গরু-মহিষের সংখ্যা আনুমানিক ২ কোটি ২০ লাখ। এই গরু-মহিষ থেকে দৈনিক প্রাপ্ত গোবরের পরিমাণ ২২০ মিলিয়ন কেজি। প্রতি কেজি গোবর থেকে ১.৩ ঘনফুটগ্যাস হিসাবে বছরে ১০৯ ঘনমিটার গ্যঅস পাওয়া সম্ভব যা ১০৬ টন কেরোসিন বা কয়লার সমান। এ ছাড়াও হাঁস-মুরগি, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদির মলমূত্র থেকে এবং আবর্জনা, কচুরপানা বা জলজ উদ্ভিদ থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বায়োগ্যাস পাওয়া সম্ভব। শুধু তাই নয়, গ্যাসহিসাবে ব্যবহারের পর ঐ গোবর জমির জন্য উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব। তাই প্রতিটি পরিবারকে বায়োগ্যাস প্লান্টের সাথে যুক্ত করতে পারলে জ্বালানি সঙ্কট দূর করে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং উন্নত গ্রামীণ জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব।

হরেক রকম দেশীয় মাছের চাষ

হরেক রকম দেশীয় মাছের চাষ

deshi fish
আমাদের দেশে আগে হাওড়-বাওড়-বিলে এক সময় প্রচুর পরিমাণে দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এসব প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট হাওড়-বাওড়গুলোর কিছু কিছু জায়গায় সারা বছরই পানি থাকতো। এতে বছর শেষে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় প্রজাতির মাছ থেকে যেত যা থেকে পরবর্তী বছরে দেশীয় প্রজাতির মাছের জন্ম হত। কিন্তু দিনে দিনে প্রাকৃতিকভাবে এসব হাওড়-বাওড়গুলোর তলা ভরাট হয়ে যাওয়াতে এসব আশ্রমগুলো সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আগে যেখানে সারাবছর পানি থাকতো সেখানে আজ ভরা মৌসুমেও পানি থাকে না। যার কারণে এসব শুকিয়ে যাওয়া হাওড়-বাওড়গুলোতে এখন ধান আবাদ হচ্ছে। এর পরে অনেক জলাভূমিতে পানি থাকলেও সেখানে মাছের অস্থিত্ব থাকা পর্যন- সেচ দিয়ে এসব মাছগুলোকে মেরে সাফ করে দেয়া হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে পরের বছর মাছের প্রজন্মের জন্য অবশিষ্ট আর কিছুই থাকছে না। এভাবে দেশীয় প্রজাতির মাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। ইতিমধ্যে অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চৈত্র-বৈশাখের খরার পর আষাঢ়ে বৃষ্টির পানি পেলেও মাছের দেখা মেলে না আজকাল। ছোটবেলায় দেখেছি আষাঢ়ের বৃষ্টির পর ডোবা, খাল, বিল ছোট ছোট মাছে_ যেমন মলা, দারকিনা, কয়েক প্রজাতির পুটি মাছ, টেংরা, গুলশা, খলিশা, চান্দা ইত্যাদি নানান প্রজাতির মাছে ভরে যেত। কিন্তু এখন আষাঢ়ে বৃষ্টি হলে খালে-বিলে পানি হলেও এসব মাছ আগের মত দেখা যায় না। নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে আমি দেখেছি, খালে-বিলের এসব ছোট ছোট মাছ প্রতিমাসেই একবার করে বাচ্চা দেয়। যার ফলে ভরা বর্ষা মৌসুমে এসে খাল-বিল মাছে ভরে যেত। কিন্তু বর্তমানে মাছে আর আগের মত ডিম দিতে পারে না। এর কারণ, কয়েক মাস পানি থাকলে ছোট মাছের বংশ বৃদ্ধি ঘটে না।

আগের ইংরেজ শাসকদের শাসন আমলকে যে জোঁকের সাথে তুলনা করা হত সেই জোঁকও এখন আর খালে-বিলে পাওয়া যায় না। অথচ আমরা ছোটবেলায় দেখেছি জোঁকের জন্য খালে-বিলে নামা যেত না। পানিতে নামলেই বিভিন্ন প্রজাতির জোঁক আসতো ধরতে। এখন বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যেও সেই জোঁকের দেখা মেলে না। আগে শামুকের দেখাও মিলতো প্রচুর। খাল-বিলের পাড়ে প্রচুর পরিমাণে সাদা শামুকের ডিমের ছোট ছোট স্তুপ দেখা যেত। বিভিন্ন মৎস্য খামারের খাদ্য হিসেবে শামুক ব্যবহার হওয়াতে এখন শামুকের সংখ্যাও কমে গেছে। এর জন্য দায়ী আমরাই। নানা কারণের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করছি আমরা। এ ছাড়াও অবাধে কীটনাশক ব্যবহার করছি। কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এসব মাছ, শামুক বা প্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমেও মাছের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না। কয়েক মাস ধরে খাল-বিল থেকে দূষিত পানি বেরিয়ে যাবার পর মাছের প্রজনন উপযোগী হতে হতে ততদিনে মাছের প্রজনন মৌসুম শেষ হয়ে যায়। এর পরেও একটি উলে-খযোগ্য পরিমাণের ছোটমাছ বংশ বৃদ্ধি করে। এভাবেই আমাদের দেশের ছোট মাছের বংশ বৃদ্ধির হার একেবারে কমে গেছে। হারিয়ে গেছে বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক প্রজাতির মাছ। সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটি অতীত ঐতিহ্যে।

প্রাকৃতিক জলাশয় বিভিন্ন কারণে সংকুচিত হচ্ছে এটাকে মেনে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। কেননা, আমাদের খাদ্য চাহিদার বিপরীতে ধানের আবাদ যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কীটনাশকের ব্যবহার। আমাদের সবদিকেই খেয়াল রাখতে হবে। ধানের উৎপাদনের কথা মাথায় রাখতে হবে। আবার মাছের বংশ বৃদ্ধির কথাও চিন্তা করতে হবে। কেননা, প্রকৃতি যেভাবে যাচ্ছে আমাদেরও সেভাবে যেতে হবে। কারণ, প্রকৃতিকে ধরে রাখার সামর্থ আমাদের নেই। তবু বিভিন্নভাবে এর লাগাম টেনে এর গতি মন্থর করতে হবে। প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়েই প্রকৃতিকে জয় করতে হবে। আর তাই বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যেও বৃষ্টির কিছুদিন পর পানিতে বিষক্রিয়া কিছুটা কমে গেলে যখন মাছ প্রাকৃতিক জলাশয়ে ডিম পাড়া বা বাচ্চা দেয়া শুরু করবে তখনই কারেন্টজালের ব্যবহার কঠোর হাতে দমন করতে হবে। প্রথমত, যদিও সরকারিভাবে কারেন্টজাল ব্যবহার নিষিদ্ধ, কিন্তু এর কোন প্রয়োগ বাস-বে লক্ষ্য করা যায় না। আমি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি যে, জৈষ্ঠ্যে যে মাছগুলো ডিম পাড়ে সেই বাচ্চাগুলোই পরবর্তীতে ২/৩ মাস পর থেকে আবার প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে আবার বাচ্চা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে দারকিনা, পুটি, ছোট খলিশা, কৈ, খলিশা, টাকি, শিং ইত্যাদি। আর তাই এদের প্রজননের ওপর বিশেষভাবে সচেতন হলে এখনও আশ্বিন-কার্তিকে এসে প্রচুর পরিমাণে ছোটমাছ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বাস-বে যা ঘটে তা হল যখন বৈশাখে প্রথম বাচ্চা হয় সেই বাচ্চাগুলো প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই কারেন্টজাল দিয়ে সমূলে বিনাশ করা হয়। গ্রামাঞ্চলে যে কি পরিমাণে কারেন্টজাল ব্যবহার করা হয় তা হয়তোবা অনেকেরই জানা নেই। খাল-বিলে অসংখ্য কারেন্টজাল অবাধে ব্যবহার করা হয় নিয়মিত প্রতিযোগিতার মত। শুধু কারেন্টজালের ব্যবহার বন্ধ করতে পারলেই এইসব ছোট ছোট মাছের উৎপাদন জ্যামিতিকহারে বহুগুণ বেড়ে যাবে, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। দ্বিতীয়ত, সীমিত আকারে হলেও উপজেলাভিত্তিক একটি করে মৎস্য অভয়াশ্রম গড়ে তোলা উচিত। অভয়াশ্রমগুলো এভাবে করা উচিত যেন আশ্রমের একদিক দিয়ে পানির স্রোত এসে অন্য দিক দিয়ে স্রোত বয়ে যেতে পারে। তাতে বর্ষার প্রাক-মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে এইসব ছোট ছোট মাছ ডিম ছাড়তে পারে। যা পরবর্তীতে এই সব মৎস্য অভয়াশ্রাম হতে ছোট মাছের মাতৃমাছ বা ছোটমাছ স্থানান্তরিত হয়ে সমস্ত এলাকা ছড়িয়ে যাবে। যেহেতু এইসব ছোটমাছ খুবই দ্রুত এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। এ ছাড়াও কিছু কিছু ছোট মাছকে পুকুরেই বংশ বৃদ্ধি করানো যেতে পারে। এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ধারাবাহিকভাবে লেখার আশা রাখছি।


আমাদের ধানের উৎপাদন একদিকে যেমন বাড়াতে হবে অন্যদিকে ভিটামিনের চাহিদা পূরণের সর্বাত্মক উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে যেত হবে। আমাদের দেশে ছিল এক সময় গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ। সেদিনের বাসত্দবতা আর বর্তমানের প্রেক্ষিত সবকিছু বিবেচনা করেই আমাদের এগোতে হবে। আগের ইতিহাসে যদি আমরা ফিরে যাই তাহলে দেখবো যে, আগে জনসংখ্যা ছিল অনেক কম। সে হিসেবে জমির পরিমাণ ছিল বেশি। প্রচুর জলাশয়, ভূমি তখন অব্যবহৃত থেকে যেত। জলাশয়গুলোতে অবাধে মাছ বিচরণ করতো বছরের পর বছর। মানুষের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হত অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ ধানের ক্ষেত্রে বলা যায়, বর্তমানের চেয়ে ধানের উৎপাদন অতীতে অনেক কম হলেও শেরশাহ এর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। এ কথাগুলো লেখার অর্থ হল অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষিতের একটি বাসত্দবচিত্র তুলে ধরা। আমাদের এই বাসত্দবতাকে মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে। আমাদের প্রাকৃতিক জলাশয় সংকুচিত হয়ে আসছে। সেজন্য এই অবস্থানের কথা চিনত্দা করেই আমাদের দেশীয় ছোট ছোট প্রজাতির মাছগুলো রক্ষার বা প্রজননের উদ্যোগ নিতে হবে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে মলা মাছ কীভাবে পুকুরে চাষ করতে হয় তা উল্লেখ করছি-

পুকুরে মলা মাছের চাষ : পুকুরেই হবে মলা মাছের চাষ। আগে আমরা দেখতাম খালে-বিলে দল বেঁধে মলা মাছ চলাফেরা করতো। আর এরা ধরাও পরতো ঝাঁকে ঝাঁকে। ছোটবেলায় আমরা খুব মজা করে মলা মাছ মারতাম- বিশেষ করে ছিপজাল দিয়ে। কোন এক স্রোতের মুখে এই জাল ফেলে বসে থাকতাম। পানি একটু স্বচ্ছ হলে পরিস্কার দেখা যেত দল বেঁধে মলা মাছ আসছে। ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারলে পুরো মলা মাছের দলটিকে জালে উঠিয়ে ফেলা যেত। পুরো দল মানে অনেক মাছ। এই মাছটি বর্তমানে বিপন্নের পথে। অথচ একটু চেষ্টা করলেই এই মাছটিকে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মলা মাছের পুষ্টিগুণ ও ওষুধিগুণের কথা সবারই কম বেশি জানা আছে। মলা মাছ পুকুরেই ডিম দিয়ে থাকে। দরকার শুধু উদ্যোগের। একবার শুধু কিছু মলা মাছকে পুকুরে ছেড়ে দিলেই হল। এটা কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মাস দুয়েক পর থেকেই মলা মাছ পুকুরে ডিম দিতে শুরু করে। একক চাষেও মলা মাছের সম্ভাবনা আছে। একক চাষের জন্য প্রথমে পুকুরে রটেনন দিয়ে অবঞ্চিত মাছ মেরে ফেলতে হবে। তারপর চুন দিয়ে পরিস্কার পানিতে পুকুর পূর্ণ করতে হবে। পানি ৩ ফুট রাখা বাঞ্চনীয়। এরপর আশপাশের যেকোন উৎস হতে কিছু মলা মাছের পোনা বা বড় মলা মাছ পুকুরে ছাড়তে হবে। জীবিত মলা মাছ পরিবহন করা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আশেপাশের যে কোন উৎস হতে খুব সর্তকতার সাথে মলা মাছ বহন করতে হবে। একবার মাছ স্টক হলেই হল। প্রজননের জন্য আর কিছুর প্রয়োজন নেই। মাসখানেক পর থেকেই মলা মাছ ডিম দিতে শুরু করবে। প্রথম দুইমাস কোন মাছ ধরা যাবে না। শুধু বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। দুইমাস পর থেকে প্রতি ১৫ দিন অনত্দর অনত্দর মাছ আহরণ করা যাবে। মাছ আহরণের সময় এমন জাল ব্যবহার করতে হবে যাতে শুধু বড় মলা মাছগুলো জালে উঠে আসে। আর ছোট মাছগুলো জালের ফাঁক দিয়ে পুকুরে চলে যায়। এভাবে প্রতি ১৫ দিন পর পর মাছ ধরা যাবে। মলা মাছের প্রচুর পরিমাণে প্রজননের জন্য অমাবস্যায় বা পূর্ণিমার রাতে পুকুরে শ্যলো দিয়ে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাচ্চা পাওয়া যাবে। খাবার হিসেবে শুধুমাত্র অটোকুঁড়া ব্যবহার করা উচিত। খাবার পুকুরে ভাসিয়ে দিতে হবে। অন্য খাবার ব্যবহার করলে পুকুরের পানির রঙ সবুজ হয়ে যেতে পারে। পানি বেশি সবুজ হলে মলা মাছের ডিমপাড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা বাচ্চা দেয়ার হার কমে যেতে পারে। কারণ, মলা মাছ স্বচ্ছ পানিতে বাস করতে ও প্রজনন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এ জন্য খাবার হিসেবে অটোকুঁড়া দিলে ভাল। অটোকুঁড়া পানিতে ভেসে থাকে বিধায় সমসত্দ খাবার মাছে খেয়ে ফেলতে পারে। তাই পানিও পরিস্কার থাকে।

মলা মাছের বাজারজাত : মলা মাছ একটি নরম প্রকৃতির মাছ। পুকুর থেকে মাছ আহরণের পর মলা মাছকে বেশিক্ষণ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা যায় না। ২ থেকে ৩ ঘন্টা পর থেকেই মলা মাছ পচে যাওয়া শুরু করে। তাই মলা মাছকে পুকুর থেকে ধরেই বরফ দিতে হবে। এভাবে মাছ সংরক্ষণ করলে ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা পর্যনত্দ টাটকা অবস্থায় রাখা যায়। এ সময়ের মধ্যে দেশের যে কোন প্রানত্দে বাজারজাত করা সম্ভব।

মলা মাছের উপযোগিতা : মলা মাছ চাষের খাদ্য খরচ কম। পোনা কিনতে টাকার দরকার হয় না এবং বাজারমূল্য উচ্চ হওয়ার কারণে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ করা যেতে পারে।

এখন পুকুরে কীভাবে শোল মাছের পোনা উৎপাদন করা যায় তার বিবরণ থাকছে-

শোল মাছের প্রজননের অভিজ্ঞতার কথা: ২০০০ সালে অমি বিভিন্ন হাওড়-বাওড় থেকে বিভিন্ন আকৃতির প্রায় হাজার খানেক শোল মাছ সংগ্রহ করি প্রজননের জন্য। এর আগে ১৯৯৮ সালে দেশী মাগুর ও ১৯৯৯ সালে শিং, ২০০০ সালে চিতল ও ফলি মাছের প্রজননে সফলতা পাই। শিং ও মাগুর মাছের প্রজননে সফলতাই আমাকে শোল মাছের প্রজননে উদ্বুদ্ধ করে। আগেই উল্লেখ করেছি, হাওড়-বাওড় থেকে প্রায় হাজার খানেক শোল মাছ সংগ্রহ করি। পুকুরে ব্রুড শোল মাছগুলোকে মজুদ করার পর ব্যাপক ক্ষত দেখা দেয়। তখন ছিল শীতকাল। শীতকালে শোল মাছে এমনিতেই ব্যাপক ক্ষত রোগ দেখা দেয়। বিভিন্ন চিকিৎসা শেষে মাছ সুস্থ হল কিন্তু হাজার খানেক থেকে ৮০ টির মত কংকাল সার মাছ পাওয়া গেল। কোন খাবার খায় না। খাবার নষ্ট হতে হতে পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে গেল। অজানা পথে অনেক টাকার অপচয় করলাম। এ দিকে শোলমাছগুলোকে আমার পাকা পুকুরে স্থানানত্দর করলাম। শোল মাছগুলোকে পাকা পুকুরে স্থানানত্দর করার পর আরও কয়েকটি মাছ মারা গেল। কোন অবস্থাতেই খাবার খাওয়াতে পারছিলাম না। অনেক টাকা বিনিয়োগ করার পরও যখন কোন অবস্থাতেই শোল মাছগুলোকে খাওয়াতে পারছিলাম না। একদিন সন্ধ্যাবেলায় ওই পুকুরের পাড়ে বসেছিলাম। হঠাৎ করে একটি ছোট ব্যাঙ লাফ দিয়ে পুকুরে পড়ে গেল। আর পড়ে যাওয়া মাত্রই কয়েকটি শোল মাছগুলো দৌড়ে এল। মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাঙটিকে নিয়ে গেল। সেই মুহূর্তে আমিও পেয়ে গেলাম শোল মাছের খাবার। যারা খালেবিলে মাছ ধরে তাদের ছোট ব্যাঙ ধরে আনতে বললাম। প্রথম দিন প্রায় ৫ কেজি ব্যাঙ ধরে পাকা পুকুরে ছাড়া মাত্রই সমস্ত পুকুর জুড়েই এক ঝলকে তাণ্ডব হয়ে গেল। ৫ মিনিটের মধ্যেই সমস্ত ব্যাঙগুলোকে উদরে পুড়ে ফেলল ক্ষুধার্থ শোল মাছগুলো। প্রথম দিকে আমি এ দৃশ্য দেখে খুবই তৃপ্তি পাচ্ছিলাম। কিন্তু পর মুহূর্তে আমার মধ্যে একটা অনুশোচনা কাজ করল এই জন্য যে, এতগুলো ব্যাঙকে এ ভাবে মৃতু্যর দিকে ঠেলে দেয়া উচিৎ হয়নি। সপ্তাহখানেক শোল মাছকে খাবার না দিয়ে পরবর্তীতে আবার ব্যাঙ দিতে শুরু করি এই ভেবে যে, সবই একটি ধারাবাহিক পদ্ধতির মধ্যে চলে। বিলে এই মাছ থাকলে কোন না কোনভাবে ব্যাঙ বা অন্যকোন জলজ প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকতো। এভাবে নিয়মিত ব্যাঙ খাওয়ানোর পর মাছগুলো হয়ে উঠল বেশ মোটাতাজা। এরপরে এল বৈশাখ মাস। মাছগুলোর পেটে ডিম এল। প্রজনের জন্য একজোড়া পুরুষ ও একজোড়া স্ত্রী শোল মাছ নির্বাচন করলাম। ২টি মাত্রায় পি.জি. হরমোন দিয়ে ইঞ্জেকশান করলাম। ২টি মাত্রাতেই ডিম দিল ঠিকই কিন্তু পুরুষ মাছের স্পার্ম পাওয়া গেল না। তাড়াতাড়ি পুরুষ মাছের পেট কেটে টেস্টিজ বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অন্যান্য মাছের মত শোল মাছের টেস্টিজের আকার স্পষ্ট না থাকায় বুঝা যাচ্ছিল না কিছুই। অনেকটা ফুলের মত টেস্টিজে স্পার্ম থেকে কেটে তাড়াতাড়ি ডিমের সাথে পাখির পালকের সাহায্যে মিশিয়ে বোতল জারে দেয়া হল। কিন্তু ডিমগুলো বোতল জারে ভেসে উঠল। ডিমগুলো পানিতে ভেসে থাকাতে দেখে খুবই আশ্চর্য হলাম। এর আগে কখনও মাছের ডিম পানিতে ভেসে থাকতে দেখিনি। এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম আমি। শোল মাছের ডিম পানিতে ভেসে থাকতে দেখে মনে হল এভাবে ডিম ভেসে থাকলে ডিম হয়তোবা ফুটবে না। সে ধারণা থেকে ডিমগুলো জার থেকে সরিয়ে সিস্টার্ণে নামিয়ে রাখলাম। পরে ডিমগুলোকে একটি লোহার দণ্ডের ফ্রেম বানিয়ে ফ্রেমের নীচে আটকিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হল। এভাবে প্রায় ২ দিন পর দেখা গেল ফ্রেমের নীচে ডুবন্ত ডিমগুলো নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে যে ডিমগুলো পানিতে ভাসমান ছিল সে ডিমগুলো থেকে কয়েকটি বাচ্চা পাওয়া গেল। এ দিকে একই সময়ে যে পুকুর থেকে মাছগুলোকে ধরে এনে পাকা পুকুরে রেখেছিলাম সে পুকুরে কয়েকটি মাছ ছিল এবং সেখানে প্রাকৃতিকভাবে ২টি বাইশ (শোল মাছের ঝাঁক) দেখলাম। তখনই পাকা পুকুরের সমস্ত মাছগুলোকে পূর্বের পুকুরে স্থানানত্দর করলাম। মাছগুলো স্থানানত্দরের ১৫ দিন পর প্রচুর পরিমানে শোল মাছের বাইশ (শোল মাছের পোনার ঝাঁক) দিতে লাগল। আর তখন এই বাইশগুলোকে ঠেলে জাল দিয়ে ধরে একের পর সিস্টার্ণে ভরতে লাগলাম। প্রথমে কোন খাবার খাচ্ছিল না। পরে চিংড়ির শুটকি ভালভাবে পাউডার করে দেয়ার পর ধীরে ধীরে খেতে শুরু করল। সপ্তাহখানেকের মধ্যে শোল মাছের বাচ্চাগুলো চিংড়ির শুটকি খেতে অভ্যসত্দ হয়ে গেল। এভাবে ১ মাসে প্রায় ২/৩ লক্ষ শোল মাছের পোনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু শোল মাছের চাষ পদ্ধতি জানা না থাকার কারণে বাজারজাত করা যায়নি। শেষ পর্যনত্দ পাশের বিলে অবমুক্ত করা হল। অনেক টাকা বিনিয়োগের লোকসান ঘটিয়ে শোল মাছের পোনা উৎপাদনের পরিসমাপ্তি ঘটল।

পুকুরে শোল ও টাকি মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতি : আমি আগেই উল্লেখ করেছি- হ্যাচারিতে শোল মাছের পোনা চাপ প্রয়োগ পদ্ধতিতে উৎপাদন খুবই জটিল। অন্যদিকে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শোল মাছের পোনা উৎপাদন করা খুবই সহজ। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শোল মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতির বর্ণনা করছি-

ডিসেম্বর/জানুয়ারি মাসে পোনা উৎপাদনের জন্য পুকুর প্রথমে ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর ২০/২৫ দিন এভাবে শুকিয়ে রাখতে হবে। এতে পুকুরের তলায় এক ধরনের ঘাস জন্মে। ঘাস জন্মালে পুকুরে পানি দিয়ে ভরতে হবে। এরপর পানির নীচে এসব ঘাস ধীরে ধীরে বড় হতে থাকবে এবং একসময় এই ঘাসগুলো পানির উপর ভেসে উঠবে। এ সময় কচুরীপানাও দেয়া যেতে পারে পুকুরে। তবে খেয়াল রাখতে হবে কচুরীপানায় যেন পুকুর ভরে না যায়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, পুকুরে ঘাস হয়ে গেলে কচুরীপানা দেয়ার প্রয়োজন নেই। পুকুরের চারদিকে কমপক্ষে ৫ ফুট উচ্চতায় জাল দিয়ে বেড় দিত হবে। অন্যথায় বর্ষাকালে শোল মাছ লাফিয়ে চলে যাবে। এরপরে পুকুরে শোল টাকি মাছ মজুদ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৪টি শোল ও ১০টি টাকি মাছ মজুদ করা যেতে পারে। মজুদের পর খাদ্য হিসেবে কার্প জাতীয় মাছের ধানীপোনা দেয়া যেতে পারে। এছাড়া ছোট ছোট ব্যাঙ বা ব্যাঙাচি দেয়া যেতে পারে। ছোট ব্যাঙ অনেক সময় লাফিয়ে চলে যেতে পারে। সে জন্য ব্যাঙগুলোকে আধমরা করে দিতে হবে। ব্যাঙাচি দিলে আধমরা করার কোন প্রয়োজন নেই। ব্রুড শোল ও টাকি মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যাঙাচির তুলনা হয় না। এ জন্য ব্যাঙাচির চাষ করা যেতে পারে। ব্যাঙাচি উৎপাদন করাও খুব কঠিন কিছু নয়।

বৈশাখ মাসের প্রথম থেকে শোল ও টাকি মাছ বাচ্চা দিতে (বাইশ) শুরু করে। বাচ্চাগুলো এক ঝাঁকে থাকে। সপ্তাহখানেক বয়সের হলেই ঠেলা জালি দিয়ে বাইশ (পোনার ঝাঁক) ধরে সিস্টার্ণ বা হাউজে নিয়ে যেতে হবে। খাদ্য হিসেবে প্রথম ১/২ দিন কিছুই খেতে চায় না। তারপরে খাবার হিসেবে চিংড়ি শুটকির গুঁড়া ভালভাবে পিষিয়ে দিতে হয়। এভাবে ২/৩ দিনেই খাবারে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। এভাবে ১৫ দিন খাওয়ানোর পর পোনাগুলো প্রায় ২/৩ ইঞ্চি সাইজ হয়। এরপর পোনাগুলোকে চাষের জন্য অবমুক্ত করতে হবে।

শোল ও টাকি মাছের চাষ পদ্ধতি : আমাদের দেশে এখনও বাণিজ্যিকভাবে শোল বা টাকি মাছের চাষ পদ্ধতি চালু হয়নি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি- শোল মাছ সাধারনত খৈল বা কুড়া দিয়ে বানানো খাবার খায় না। তবে মরা টাটকা মাছ খেতে দিলে এরা খুব খায়। আমাদের দেশে বাস-বতার নিরিখে শোল মাছের একক চাষের সম্ভবনা খুবই কম। কারণ এত কাঁচা মাছ বা শুটকির জোগান দেয়া প্রায় অসম্ভব। তবে যেকোন মাছের সাথে মিশ্রভাবে প্রতি ২ শতাংশে ১টি করে শোল মাছ দেয়া যেতে পারে। শোল মাছের চেয়ে পুকুরে টাকি মাছের চাষ করার একটা বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, শুটকি মাছের গুঁড়া মিশ্রিত খৈল ও কুড়া দিয়ে বানানো খাবার টাকি মাছ ভাল খায় এবং বেশ মোটাতাজাও হয় যা শোল মাছের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

শোল মাছ আমাদের দেশে এখন প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতীর মাছ হয়ে যাচ্ছে। এ মাছটিকে উপরোল্লিখিত পদ্ধতিতে বাচ্চা ফুটিয়ে সরকারি উদ্যোগে মুক্ত জলাশয়ে ছাড়লে একদিকে যেমন এ মাছটির উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়বে অন্যদিকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া শোল মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে অনায়াসে। আবার টাকি মাছটিকেও উপরোল্লিখিত পদ্ধতিতে বাচ্চা ফুটিয়ে যেকোন মাছের সাথে শতাংশ প্রতি ১০টি মাছ অনায়াসে চাষ করে এর ব্যাপক উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

বিভিন্ন মাত্রায় ডোজ দিয়ে চিতলের কৃত্রিম প্রজনন করতে গিয়ে দেখা গেছে, চিতল মাছকে পি.জি. হরমোন দিয়ে ইঞ্জেকশন করার পর স্ত্রী চিতল মাছ ডিম পাড়লে পুরুষ চিতলের ভূমিকা খুবই কম। একইভাবে ফলি মাছের ক্ষেত্রেও চাপ প্রয়োগ পদ্ধতিতে পুরুষ মাছকে কেটে স্পার্ম মিশাতে হয়। তাই চাপ প্রয়োগে ডিম বের করার পর পুরুষ চিতল/ফলি মাছের টেস্টিজ কেটে স্পার্ম মিশিয়ে সফলতা পেলেও নিম্নলিখিত কারণে এ পদ্ধতিটি লাগসই বলে আমার কাছে মনে হয়নি।

১. চিতল মাছের ডিমের পরিমাণ খুবই কম এবং ডিমের আকার বেশ বড়। এক একটি ডিমের আকার প্রায় ছোট মার্বেলের মত। একটি বড় চিতল মাছে ৩০০ থেকে ৫০০ ডিমের বেশি থাকে না।

২. প্রাকৃতিকভাবে ডিম দিতে প্রত্যেকবার পুরুষ চিতলের সর্্পামের জন্য একটি পুরুষ চিতল মাছ কাটতে হয় যা অল্প সংখ্যক ডিমের জন্য ঠিক নয়।

৩. চিতল মাছের ডিম ফুটতে তাপমাত্রাভেদে প্রায় ১৫ দিন সময় লাগে। অন্যদিকে কার্প বা রুই জাতীয় মাছের ডিম ফুটতে ১৮ থেকে ২৪ ঘণ্টার উপরে লাগে না। দীর্ঘদিন সিস্টার্ণে ডিম রেখে অল্পসংখ্যক বাচ্চা উৎপাদন করে ব্যবসায়িকভাবে খুব একটা লাভবান হওয়া যায় না।

এ সব বিভিন্ন কারণে চিতল মাছের কৃত্রিম প্রজননে আশাপ্রদ ফলাফল পাওয়া যায়নি। কৃত্রিম প্রজননের পাশাপাশি পুকুরে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতেও চিতল মাছের বাচ্চা ফুটানো হয়। দুটি পরীক্ষা থেকে দেখা গেছে প্রাকৃতিকভাবে পুকুরেই চিতল মাছের বাচ্চা ফুটানোই ভাল।

পুকুরে চিতল মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতি : জানুয়ারির দিকে প্রথমে পুকুরকে ভালভাবে শুকিয়ে (১৫ দিন) রাখতে হবে। এর ফলে পুকুরের তলায় এক ধরনের ঘাসের সৃষ্টি হলে পানি দিতে হবে। পানি নীচের ঘাসগুলো আসত্দে আসত্দে বড় হতে হতে এক সময় পানির উপর চলে আসবে। এভাবে প্রাকৃতিক আশ্রম তৈরি হবে পুকুরে। এ ভাবে মাস খানেক পর অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে পুকুরে চিতল মাছের মাতৃ মাছ এবং পুরুষ ব্রুড মাছ মজুদ করতে হবে। মজুদ ঘনত্ব হবে প্রতি শতাংশে সর্বোচ্চ ৩টি। ব্রুড মাছ মজুদের পর খাবার হিসেবে কার্প বা রুই জাতীয় মাছের ধানী পোনা পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। চিতল মাছ কিছুটা রাক্ষুসে স্বভাবের হলেও বড় মাছ খায় না। খাবার হিসেবে ছোট ছোট মাছ খেতে পছন্দ করে। কার্প জাতীয় মাছের ধানী পোনাও ছাড়াও তেলাপিয়ার ছোট ছোট বাচ্চা খেতে পছন্দ করে। সে জন্য পুকুর প্রস্তুতি এবং পানি দেয়ার পর কিছু সংখ্যক ব্রুড তেলাপিয়া ছাড়তে হবে। তাতে তেলাপিয়া প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বাচ্চা দেয়া শুরু করবে। আর সে বাচ্চা চিতলের খাবার হিসেবে চলে যাবে।

চিতল মাছ সাধারণত এপ্রিলের শেষের দিকে অর্থাৎ জুলাই মাস পর্যনত্দ অমাবস্যা বা পূর্ণিমার রাতে পুকুরে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ডিম দিয়ে থাকে। আর সে জন্য প্রজনন প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করার জন্য এপ্রিলের শেষ দিক হতে জুলাই পর্যনত্দ পুকুরে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানির প্রবাহ দেয়া উচিত। তাতে চিতল মাছের প্রজনন প্রক্রিয়ায় দ্রুত সাড়া দিয়ে ডিম পাড়া তরান্বিত হবে। চিতল মাছের ডিম আঠাল। আর সে জন্য চিতলের ডিম সংগ্রহের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। ডিম সংগ্রহের জন্য কাঠের ফ্রেম বানিয়ে দিতে হবে। কাঠের ফ্রেম অনেকটা ছোট নৌকার মত এবং তা ডুবিয়ে রাখতে হবে। চিতলের ডিম সংগ্রহের জন্য এ ব্যবস্থা নিলেই চলবে। এ প্রক্রিয়াটি এপ্রিলের আগেই করে রাখতে হবে। মে মাস থেকেই চিতল মাছ ডিম পারতে শুরু করবে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমের প্রতি অমাবস্যা বা পূর্ণিমা রাতে এরা ডিম পারে। অমাবস্যা বা পূর্ণিমার ২/৩ দিন পর কাঠ দিয়ে বানানো নৌকাটিকে পানির উপর তুলে দেখতে হবে ডিম দিয়েছে কি-না। যদি ছোট নৌকাতে ডিম দেখা যায় তাহলে ডিমসহ নৌকাটিকে নার্সারি পুকুরে স্থানানস্তরিত করতে হবে।

নার্সারি পুকুর প্রস্তুতি : চিতলের ডিমের সংখ্যা যেহেতু কম সেহেতু ছোট ছোট নার্সারি প্রস্তুত করতে হবে। সাধারণত ৫ শতাংশের পুকুর নার্সারির জন্য নির্বাচন করতে হবে। প্রথমে পুকুর শুকিয়ে পুকুরের তলায় চাষ দিয়ে শ্যালো দিয়ে পরিষ্কার পানি ২/৩ ফুট পানি দিয়ে পূর্ণ করতে হবে। তারপর চিতলের ডিমসহ ছোট নৌকাটিকে নার্সারি পুকুরে খুব তাড়াতাড়ি করে সর্তকতার সাথে এনে ডুবিয়ে রাখতে হবে। যেহেতু চিতলের ডিম ফুটতে প্রায় ১৫ দিনের মত লাগে সেহেতু ডিম দেখে নার্সারি পুকুর প্রস্তুত করা ভাল। আর তা না হলে আগেই নার্সারি পুকুর প্রস্তুত হয়ে গেলে পানি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পানি পরিষ্কার না হলে চিতলের ডিমে ফাঙ্গাস পড়তে পারে। এ ভাবে ডিম সংগ্রহ করে নার্সারিতে নেয়ার পর তাপমাত্রাভেদে ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হবে। বাচ্চা ফুটার পর খাদ্য হিসেবে কার্প জাতীয় মাছের রেনু পুকুরে দিতে হবে। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, চিতলের বাচ্চা পূর্ণাঙ্গভাবে ফুটার পর পরই প্রায় ১/২ ইঞ্চি সাইজের হয়ে থাকে। এভাবে নার্সারি পুকুরে সপ্তাহ দুয়েক রাখার পর প্রায় ৩ ইঞ্চি সাইজের হয়ে থাকে। এরপর চিতলের পোনাকে চাষের পুকুরে ছাড়তে হবে। নার্সারি পুকুরে ১ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি সাইজের ফাঁসের জাল রাখতে হবে যাতে সাপ আটকে যায়।

চিতলের চাষ পদ্ধতি: আমাদের দেশে এখনও চিতলের একক চাষ পদ্ধতি চালু হয়নি। পোনা প্রাপ্তির অভাবে মিশ্রভাবে বিচ্ছিন্নভাবে চিতলের চাষ শুরু হয়েছে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে প্রতি ৫ শতাংশে অন্যান্য মাছের সাথে ১টি করে চিতল দিলে ১ বছরে প্রায় ২ কেজি ওজনের হয়ে থাকে। এর জন্য বাড়তি খাবারের প্রয়োজন নেই।

চিতলের রোগবালাই: নীবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে চিতল মাছের প্রজননের সময় পুরুষ চিতল মাছ স্ত্রী চিতল মাছের সাথে জড়াজড়ি করে একটি আরেকটিকে আক্রানত্দ করে ফেলে। বিশেষ করে এদের মুখের দিকে কাঁটা বা বুকের নীচে কাঁটা দিয়ে একে অপরকে নিজের অজানত্দেই আক্রানত্দ করে যা পরবতর্ীতে সমসত্দ শরীরে ক্ষত রোগ হিসেবে দেখা দিতে পারে। এজন্য প্রত্যেকবার ডিম দেয়ার পর পুকুরে পটাসিয়াম পার-ম্যাঙ্গানেট ছিটিয়ে দেয়া প্রয়োজন। এতে প্রজননের পর আক্রানত্দ মাছগুলো দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে। মিশ্র চাষে চিতলের রোগ বালাই নেই বললেই চলে।

উপরোল্লেখিত পদ্ধতি অনুসরণ করে করে যে কেউ চিতলের পোনা উৎপাদন করতে পারবে। যা মিশ্রচাষে খুব ভাল মুনাফা ঘরে আসবে পাশাপাশি চিতলের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।

খরাসহিষ্ণু ধান

খরাসহিষ্ণু ধান

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের বিস্তৃর্ণ এলাকা দিন দিন খরাপ্রবণ অঞ্চলে পরিনত হচ্ছে। অসময়ে বৃষ্টিপাত এবং বিলম্বিত বর্ষার কারণে কৃষকরা উপযুক্ত সময়ে চারা রোপণ করতে পারছে না। আবার অঙ্গজ বৃদ্ধির পর্যায়ে বা ফুল আসার সময়ে অথবা দানা বাধার সময়ে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি না হলে ধানের ফলন আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। খরার মাত্রা বেশি হলে অনেক সময় সম্পূর্ণ ফসলই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিকূল অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট খরাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অনেক দিন ধরে। সমপ্রতি ব্যাপক গবেষণার ফলে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি ধানের জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে, যা খরা মোকাবিলায় যথেষ্ট কার্যকর বলে বিভিন্ন গবেষণার মাঠে প্রমাণিত হয়েছে। ইরি উদ্ভাবিত খরাসহিষ্ণু ধানের এই জাতটির লাইন নম্বর হচ্ছে আই আর ৪৩৭১-৭০-১-১। কৃষকের মাঠে খরা মোকাবিলায় অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হওয়ায় ভারত ২০০৯ সালে শাহবাগী ধান নামে এই জাতটিকে অনুমোদন দেয়, যা এখন ভারতের খরাপ্রবণ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে এই জাতটির ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। মনে করা হচ্ছে অচিরেই এই জাতটি খরাসহিষ্ণু জাত হিসেবে বাংলাদেশে অনুমোদন পাবে। STRASA-IRRI প্রকল্পের আওতায় বিল এন্ড মেলিন্ডা গেট্স ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে আরডিআরএস গত দুই মৌসুম ধরে এই জাতটির খরাসহিষ্ণুতা পর্যবেক্ষণ করছে এবং এই বছর কৃষকের মাঠে এর গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করেছে। দেখা যাচ্ছে কৃষক স্বতঃস্ফুর্তভাবে জাতটিকে একটি খরাসহিষ্ণু জাত হিসেবে গ্রহণ করছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খরা মোকাবিলায় কার্যকর এবং উপযুক্ত বলে বিভিন্ন গবেষণায় ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।

খরাসহিষ্ণু জাতের পরিচিতি: খরাসহিষ্ণু জাত হিসেবে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আই আর ৪৩৭১-৭০-১-১ ধানের জাতটির উপযুক্ততা যাচাই হচ্ছে। এই ধানের জীবনকাল ১১৫ থেকে ১২০ দিন। ধানের ছড়ার দৈর্ঘ্য ২২.১ থেকে ২৫.৪ সেমি। খরাসহিষ্ণু এই ধান গাছের উচ্চতা ৮৫ থেকে ৯০ সেমি। ১০০০ ধানের ওজন ২২.৮০ গ্রাম এবং ধানে চালের পরিমাণ ৬৪.৭%। স্বাভাবিক অবস্থায় হেক্টরপ্রতি ৩.৮ থেকে ৪.৫ টন ফলন পাওয়া যায়।

খরাসহিষ্ণু ধান উৎপাদন কলাকৌশল: সাধারণত খরাপ্রবণ এলাকায় খরাসহিষ্ণু এই ধরনের ধানের চাষ করতে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। জুন মাসের মাঝামাঝিতে বীজতলায় বীজ ফেলে জুলাই মাসের প্রথমদিকে ২৫ দিনের চারা রোপণ করা উচিত। যেহেতু এই ধান স্বল্পমেয়াদি তাই কোনোভাবেই ২৫ দিনের বেশি বয়সের চারা রোপণ করা উচিত নয়। প্রতি হেক্টরে চারা রোপণের জন্য ৪০ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। যেহেতু স্বল্পমেয়াদি ধানের জাতে কুশির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হয়, সেহেতু চারা রোপণের ক্ষেত্রে ৬ ইঞ্চির (১৫ সেমি) বেশি দূরত্বে চারা রোপণ করা উচিত হবে না। চারার গোছা থেকে গোছার দূরত্বও ৬ ইঞ্চির বেশি হওয়া উচিত নয়। প্রতি গোছায় ৩ থেকে ৪টি চারা রোপণ করা উচিত।

মাটি পরীক্ষা করে অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া সম্ভব। মাটি পরীক্ষা করা সম্ভব না হলে প্রতি হেক্টর জমিতে ৭৫ কেজি টিএসপি এবং ৩৪ কেজি এমওপি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হয়। চারা রোপণের ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে আরো হেক্টরপ্রতি ৬৫ কেজি ইউরিয়া সার এবং চারা রোপণের ৩০ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে হেক্টরপ্রতি আরো ৬৫ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। অবশ্যই জমিকে আগাছামুক্ত রাখতে হবে। দ্বিতীয়বার ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগের সময় জমি থেকে আগাছা পরিস্কার করে সারকে কাঁদার সাথে মিশিয়ে দিলে ধানগাছ ভালভাবে সার গ্রহণ করতে পারবে।

চারা রোপণের প্রথম ৪০ দিন পর্যন্ত জমিকে আগাছামুক্ত রাখলে পরবর্তীতে সাধারণত আর আগাছা হয় না। আগাছানাশক দিয়েও জমিকে আগাছামুক্ত রাখা যায়। এজন্য চারা রোপণের ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যে জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় হেক্টরপ্রতি ৮০০ গ্রাম পেটিলাক্লোর অথবা হেক্টরপ্রতি ২০ গ্রাম পাইরাজোসালফিউরোন ইথাইল প্রয়োগ করতে হবে। ধানের জমির বিভিন্ন স্থানে বাঁশের কঞ্চি পুঁতে দিয়ে পাখি বসার ব্যবস্থা করে দিলে পাখি পোকা-মাকড় খেয়ে জমিতে পোকা-মাকড়ের উপদ্রব কমাতে পারে। ধানগাছে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ বেশি হলে উপযুক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশে সাধারণত আশ্বিন-কার্তিক মাসে খরা হয়। এই সময়ে সেচ ব্যবস্থার সুযোগ না থাকলেও এই ধানগাছ সহজে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। প্রায় ৮০ ভাগ ধান পেকে গেলে ফসল কেটে ফেলতে হবে।

সাধারণত বীজ বপনের ১১৫ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে ধান পেকে যায়। ঠিকমত চাষাবাদ করলে হেক্টরপ্রতি ৪ থেকে ৫ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতে পারে।
খরাসহিষ্ণু ধানগাছ শুষ্কতা সহ্য করতে পারলেও ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না। সেজন্য উত্তরাঞ্চলে কোনোভাবেই এই ধানের জাত দেরীতে চাষাবাদ করা যাবে না। পাশাপাশি বোরো মৌসুমেও এ ধানের চাষ করা যাবে না।

সোনার ধান বাংলামতি

সোনার ধান বাংলামতি

banglamoti
নতুন উদ্ভাবিত বাংলামতি ধানের চাল বিদেশে রপ্তানি করে বছরে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব বলে আশা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বাসমতিসদৃশ এ ধান কৃষকের ভাগ্য ফেরাতে পারে বলেও আশা করছেন ব্রি'র সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এবং মাঠ পর্যায়ে প্রথম চাষকারী কৃষকরা।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বোরো মৌসুমে চাষ উপযোগী বাসমতিসদৃশ এ ধান মাঠ পর্যায়ে প্রথমবার চাষে এ বছর আশাতীত ফলন ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ফলে তা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন-বিএডিসি'র হাতে এর বীজ পৌঁছানোর আগেই কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষিত বীজ সংশ্লিষ্ট এলাকা ছাড়াও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। কেবল খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মেছাঘোনা গ্রামের যে কৃষকের জমিতে এবার বোরো মৌসুমে বাংলামতি ধানের চাষ করা হয় সেখান থেকে এ পর্যন্ত দেশের ২১ জেলার কমপক্ষে ২০০ আগ্রহী চাষি, বিভিন্ন পেশাজীবী ও শৌখিন ব্যক্তি সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ ধানের আবাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে এবং ব্রি ধান-২৮ বা বোরো মৌসুমে আবাদকৃত অন্যান্য জাতের ধানের স্থলাভিষিক্ত হবে। এমনকি হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদও কমে যেতে পারে। কারণ এ ধানের ফলন হাইব্রিড ধানের কাছাকাছি। এছাড়া বাংলাদেশের বাংলামতি ভারত ও পাকিস্তানের বাসমতি চালের অন্যতম প্রতিযোগী হয়ে উঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলামতি ধান থেকে যে চাল পাওয়া যাবে তা বাসমতির মতো সুগন্ধি ও উন্নতমানের হওয়ায় এ চাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করবে বলেও আশা করা হচ্ছে। তাই সরকারি পর্যায়ে বিশেষ করে বিএডিসির মাধ্যমে উন্নতমানের বীজ তৈরি এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাঠ প্রদর্শনী ও মাঠ দিবসের মাধ্যমে এ ধানের সঠিক চাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণ প্রয়োজন। তা না হলে কেবল কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষিত বীজ ও চাষ সম্প্রসারণ করে এ ধান চাষে যে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে তা কাজে লাগানো যাবে না এবং বীজের মান রক্ষা করে অধিক ফলন ধরে রাখা যাবে না বলেও বিশেষজ্ঞদের অভিমত । গত মৌসুমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক মাঠ পর্যায়ে যশোরে পরীক্ষামূলকভাবে চাষের পর এবার ব্যক্তি আগ্রহে যশোরের বাইরে মাত্র ১০-১২ জন কৃষক এ ধানের চাষ করেছেন। যার প্রায় সবই পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সব চাষির ধান কর্তন ও মাড়াই শেষ হয়েছে। ব্রি'র ঈপ্সিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৬ মে. টন ছাড়িয়ে গড় উৎপাদন ৭ টনে পৌছেছে, যা খুবই আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। কয়েক জায়গায় উৎপাদন ৮ টনে পেঁৗছেছে। ভারত ও পাকিস্তানের বাসমতির সর্বোচ্চ একরপ্রতি ফলন ৩০-৪০ মণ। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাংলামতির উৎপাদন একরে ৭০-৮০ মণ পর্যন্ত পাওয়া যাবে। ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের তুলনায় কম দামে চাল বিক্রি করলেও বেশি লাভবান হবে আমাদের দেশের কৃষকরা। আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের দেরাদুন বাসমতি বা পাকিস্তানের বাসমতি চালের প্রতি কেজির বিক্রয় মূল্য তিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকার মানে ২০০ টাকার উপরে। বাংলাদেশ বছরে যদি ৪০-৫০ হাজার মে. টন বাংলামতি চাল রপ্তানি করতে পারে তবে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। আর এই ৫০ হাজার মে. টন চাল রপ্তানিতে যে ঘাটতি হবে তা আউশ মৌসুমে ধান চাষ সম্প্রসারণ করে মেটানো সম্ভব। ব্রি'র জেনেটিকস রিসার্চ ডিভিশনের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খায়রুল বাসার জানান, ১৯৭৬ সালে আমন মৌসুমে চাষ উপযোগী সুগন্ধী ধান দুলাভোগ বা ব্রি-৬ উৎপাদনের দীর্ঘদিন পর আমন মৌসুমে চাষ উপযোগী সুপার অ্যারোমেটিক রাইস হিসেবে আমরা বাংলামতি উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছি।

এ ধান বাসমতির প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে। খুলনা অঞ্চলে বাংলামতি ধানের চাষ প্রবর্তক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের উপরিচালক এসএম আতিয়ার রহমান জানান, তার পৈতৃক জমিতে বাংলামতি চাষ করে এ বছর ফলন পাওয়া গেছে একরে ৭২ মণ যা হেক্টরপ্রতি ৭ মে. টন। পত্র-পত্রিকায় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবর প্রকাশের পর এ পর্যন্ত তাদের বাড়ি থেকে বগুড়া, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, শেরপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, মুন্সীগঞ্জ, পিরোজপুর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, নড়াইল, ফরিদপুর থেকে এসে অথবা ফোনে যোগাযোগ করে কুরিয়ারের মাধ্যমে বীজ সংগ্রহ করেছেন।

হাইব্রিড ধান চাষ পদ্ধতি

হাইব্রিড ধান চাষ পদ্ধতি

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধানের উৎপাদন হ্রাস ও বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে খাদ্য চাহিদা মেটানো ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য ধান উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা মতে, ২০২০ সালে ৭৬০ মি. মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করতে হবে। আমাদের দেশে খাদ্য চাহিদা বেড়ে ৩৫ মিলিয়ন টন হবে। এশিয়া মহাদেশে ধানের উৎপাদন বাড়াতে আবাদি জমি বাড়ানো সম্ভব নয়। তাই এ অতিরিক্ত ধানের চাহিদা অবশ্যই প্রতি একক আয়তনের উৎপাদন বাড়িয়ে মিটাতে হবে। হাইব্রিড ধান চাষের মাধ্যমে ১৫-২০% বেশি উৎপাদন সম্ভব। তবে হাইব্রিড ধানের ভালো ফলন পেতে হলে বীজ বাছাই থেকে শুরু করে ধান কাটা পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ফসলের পরিচর্যা করে যেতে হবে।

জাত নির্বাচন : উফশী জাতের চেয়ে বেশি ফলন দিতে সক্ষম এমন হাইব্রিড জাত নির্বাচন করতে হবে। এখন পর্যন্ত উল্লেখ্য হাইব্রিড ধান বীজ ব্রি হাইব্রিড-১, ২, এল পি-০৫, হীরা-৫, মানিক-২, সুরমা-৪, তেজ, অগ্রণী-৭ ইত্যাদি।

বীজতলা তৈরি : পানিতে ডুবে না, গাছের ছায়া পড়ে না এরূপ জায়গা প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে ২-৩টি চাষ ও মই দিয়ে অন্তত ৭-১০ দিন পানি আটকে রাখা দরকার। এরপর চাষ ও মই দিয়ে থকথকে কাদাময় করে জমি তৈরি করতে হবে। প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি গোবর বা পচা আবর্জনা সার প্রয়োগ করতে হবে। ১.২৫ মিটার চওড়া ও জমি অনুযায়ী লম্বা করে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বীজ তলার জন্য ০.৫ মিটার নালা রাখতে হবে। ফাঁকা রাখা ০.৫ মিটার জায়গা থেকে ১০ সে.মি. গভীর করে মাটি তুলে দুধারে দিতে হবে।

বীজ বপন ও বীজতলার যত্ন : পুষ্ট ও পরিষ্কার বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ডুবিয়ে রেখে তিনদিন বস্তাবন্দি অবস্থায় জাগ দিয়ে অঙ্কুরিত করে নিতে হবে। এরকম অঙ্কুরিত বীজ প্রতি বর্গমিটারে ৫০ গ্রাম হিসেবে সমানভাবে বপন করতে হবে। হেক্টর প্রতি মাত্র ১৫-২০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। অথচ প্রচলিত পদ্ধতিতে দরকার ৪০-৪৫ কেজি। বীজ বপনের ৩-৪ দিন পর থেকে চারা গজানো পর্যন্ত পানি দিয়ে নালা ভর্তি করে রাখতে হবে। বীজতলা শুকিয়ে গেলে শিকড় বেশি বড় হয়ে যায়। বীজ বোনার ১০ দিন পর প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম ইউরিয়া, ৪ গ্রাম টিএসপি ও ৭ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। যত্ন সহকারে চারা উঠাতে হবে যাতে চারার শিকড় ছিঁড়ে না যায়।

রোপণের জন্য জমি তৈরি : উর্বর, সুনিষ্কাশিত ও সেচের সুবিধাযুক্ত জমি নির্বাচন করতে হবে। প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে মাটির প্রকার ভেদে ৩-৪ চাষ ও মই দিয়ে কাদাময় করে নিতে হবে।

চারা রোপণ : জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হবে। ৩০-৩৫ দিনের ১-২টি করে সুস্থ-সবল চারা ২০ সেমি (৮") ঢ ১৫ সেমি (৬") দূরে রোপণ করতে হবে। বোরো মৌসুমে ডিসেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। আগাম বপন অকালপক্ব ছড়া তথা ছোট আকারের ছড়া বের হওয়ার অন্যতম কারণ।

আগাছা দমন : হাইব্রিড ধানের জমি সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।

সেচ ব্যবস্থাপনা : চারা রোপণের পর থেকে জমিতে ৫-৭ সে.মি. (২-৩") পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। কাইচ থোড় আসা শুরু করলে পানির পরিমাণ দিগুণ করা উচিত।

পোকামাকড় ও রোগ-বালাই দমন : হাইব্রিড ধানের রোগ পোকা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা দমনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। মাজরা পোকা, গলমাছি, পামরি পোকা, বাদমি গাছ ফড়িং এবং খোলপোড়া ও খোল পচা রোগ দেখা দিতে পারে। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

ফসল কর্তন : প্রচলিত জাতের বোরো হাইব্রিড ধানের দানা পরিপুষ্ট এবং পরিপক্ব হতে বেশি সময় নেয়। যখন ছড়ায় ৯০% ধান পেকে যায় তখনই ফসল সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।

দেশের কৃষকদের হাইব্রিড ধান চাষাবাদ সম্পর্কে ধারণা খুব সীমিত। হাইব্রিড ধানের চাষাবাদের জন্য সঠিক মাঠ ব্যবস্থাপনা অতি আবশ্যক। এখানে উল্লেখ্য, কৃষক তার উৎপাদিত ধান বীজ হিসেবে পরবর্তী মৌসুমে ব্যবহার করতে পারবেন না। এখানে ফসল উৎপাদনের যে মৌসুম ও উপকরণের মাত্রা ও পরিমাণ যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এলাকাভেদে তা কিছুটা তারতম্য হওয়া স্বাভাবিক।

ছাদে বাগান : প্রারম্ভে করনীয়

ছাদে বাগান : প্রারম্ভে করনীয়

বর্তমানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বাড়ির ছাদে বাগান করা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অধিকাংশ বাড়ির ছাদের দিকে তাকালেই বিভিন্ন ধরনের বাগান দেখা যায়। অবশ্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের ছাদে যেসব বাগান দেখা যায় তার অধিকাংশই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নেয়া হলে বাড়ির ছাদে যেকোন গাছ, এমনকি শাকসবজিও ফলানো সম্ভব। আঙুর, বেদানা, ডালিম, আমড়া, পেয়ারা ইত্যাদি নান ধরনের মৌসুমী ফল ছাড়াও কলমি শাক, কলা, ডাঁটা, লাউ ইত্যাদি অনায়াসে উৎপাদন করা যায়। কোন গাছের জন্য কি ধরনের মাটি উপযোগী তা নিশ্চিত হয়ে ছাদে বাগান করলে ভাল হয়। এ ছাড়া বেশি রোদ বা গরম সহ্য করতে পারে এমন গাছই ছাদে বপন করা উত্তম। ছাদে বাগান করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে নিয়মিত পানি সেচ দেয়া। কারণ, বাগানের গাছগুলো যেহেতু সাধারণ মাটির সংস্পর্শ হতে দূরে থাকে তাই নিয়মিত পানি সেচ না দিলে গাছগুলো যেকোন সময় মারা যেতে পারে। সাধারণত দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটিতে গাছ ভাল জন্মে। ছাদে বাগান করতে হলে এ ধরনের মাটি ব্যবহার করলে ভাল হয়।

শখ করে আমাদের দেশে ছাদে বাগান করার প্রথা শুরু হলেও এখন রীতিমত অর্থনৈতিক খাত হিসেবে চিহ্নিত। অনেকেই আছে যারা বাড়ির ছাদে বাগান করে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করে।


ছাদে বাগান করতে হলে প্রতিদিন সকাল-বিকাল গাছে পানি দিতে হবে। গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া মাটির ধরণ জেনে বাগান করলে ছাদে যেকোন ধরনের গাছই জন্মানো সম্ভব। ৪-৫ কাঠা জমির উপর বাড়ির ছাদে পরিকল্পিতভাবে বাগান করলে পরিবারের চাহিদা পূরণ করেও বছরে বিক্রি কর যায় ৪০-৫০ হাজার টাকা।


ইচ্ছে করলেই শহরবাসী ফলের বাগান বা সবজি বাগান করতে জমি পান না। তাই বিকল্প উপায় বের করে আবাদি জমি নষ্ট না করে ছাদকে কাজে লাগিয়ে বাগান করা যায়। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বিকল্প আয়ের উৎস হতে পারে এই ছাদে বাগান যা পরিবারকে করবে স্বচ্ছল।

ছাদে বাগান: বিস্তারিত তথ্য

বিশাল বাংলার জমিন যেমন বিস্তৃত, তেমনি লাখোকোটি দালান ঘরের ছাদও অবারিত বিস্তৃত। যদিও বাংলার জমিন এখনো যথোপোযুক্তভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। সেখানে ছাদের কথা তো আরও পরে আসে। কিন্তু এ দেশের কিছু আগ্রহী ব্যক্তিবর্গ আছেন যারা ব্যক্তিগত আগ্রহ আর উদ্যোগে ছাদে বাগান করেন শখের বসে। বিনিয়োগের যেমন হিসাব থাকে না, তেমনি প্রাপ্তির হিসেবেও তেমনভাবে করা হয় না শখের ছাদের বাগানে। অথচ সামান্য আন্তরিকতা আর সুষ্ঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে এ প্রতিশ্রুতিশীল দিকটাকে অনেকদূর নিয়ে যেতে পারি। ছাদে বাগান করে ছাদের সৌন্দর্য যেমন বাড়ে, তার সাথে জায়গাটুকু ব্যবহার করে পরিবারের ফুল, শাকসবজি ও ফলের চাহিদা যথাযথভাবে মেটানো যায়। শুধু কি তাই পরিকল্পিতভাবে ছাদে বাগান করে বাড়তি আয়ও করা যায়। সর্বোপরি ছাদের বাগানে পরিবারের অবসরপ্রাপ্ত আগ্রহী লোকগুলো দারুণভাবে সময় কাটাতে পারেন। সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারেন।

বাগান পদ্ধতি ছাদে বাগান দু'ভাগে করা যায়। যেমন কাঠ বা লোহার ফ্রেমে এঁটে বেড তৈরি করে এবং অন্যটি হলো টব, ড্রাম, পট কনটেইনার এসব ব্যবহার করে। প্রথম ক্ষেত্রে পুরো ছাদ বা ছাদের অংশবিশেষ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কার্নিশের পার্শ্বে বা আলাদা ফ্রেম করে সুন্দরভাবে ডিজাইন করে সেটিং করা যায়। এ ক্ষেত্রে জল ছাদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জল ছাদ না থাকলে আলাকাতরার প্রলেপ দিয়ে তার ওপর মোটা পলিথিন বিছিয়ে তার ওপর মাটি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে মাটির পুরুত্ব যত বেশি হবে। অন্তত দু'ফুট পুরু মাটির স্তর থাকতে হবে। তবে যত বেশি তত ভালো। অতিরিক্ত পানি, সার পাবার সুষ্ঠু পথ রাখতে হবে। পরবর্তীতে প্রয়েঅজনীয় পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে। ফ্রেম তৈরির ক্ষেত্রে কাঠ, লোহা, স্টিল, মোটা রবার এসব ব্যবহার করা যায়। তবে যা কিছু দিয়ে বা যে ভাবেই বেড তৈরি হোক না কেন ৩/৪ বছর পর পুরো বেড ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি করতে হবে। এতে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। ছাদে বাগানের জন্য শুরুতেই যদি মাটিকে ফরমালডিহাইড দিয়ে (প্রতি লিটার পানির সাথে ১০০ মিলিলিটার ফরমালডিহাইড) শোধন করে নেয়া যায় মাটি শোধনের কৌশল হলে প্রয়োজন অনুযায়ী মাটি নিয়ে বর্ণিত মাত্রায় ফরমালডিহাইড মিশ্রিত পানি মাটিতে ছিটিয়ে দিয়ে পুরো মাটিকে মোটা পলিথিন দিয়ে ৩/৪ দিন ঢেকে রাখতে হবে। পরে পলিথিন উঠিয়ে সূর্যের আলোর তাপে খুলে রাখতে হবে পরবর্তী ৩/৪ দিন পর্যন্ত। ফরমালিনের গন্ধ শেষ হয়ে গেলেই মাটি ব্যবহারের উপযোগী হবে। দ্বিতীয় পদ্ধতির মধ্যে আছে ড্রাম, বালতি, টব, কনটেইনার এসবের যেকোন একটি বা দুটি নির্বাচন করার পর পাত্রের তলায় কিছু পরিমাণ খোয়া (ইট পাথরের কণা) দিতে হবে। ইটের খোয়া পানি নিষ্কাশন এবং অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়া এবং পাত্রের ভেতরে বাতাস চলাচলের সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রেও অর্ধেক মাটি এবং অর্দেক পঁচা জৈব সারের মিশ্রণ হতে হবে। মনে রাখতে হবে, শাক-সবজি, ফুলের জন্য ছোট খাট টব বা পাত্র হলেও চলে। কিন্তু ফলের ক্ষেত্রে পাত্র/ড্রাম যত বড় হয় তত ভালো। কেননা আমাদের বুঝতে হবে ফল গাছের শেকড় প্রকৃতিতভাবে বেশ গভীরে যায়। কিন্তু ড্রাম/টব/পাত্রের সীমিত জায়গার অভাবে যথাযথভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে পারে না। সে জন্য ছাদের বাগানে টব/ড্রামের আকার যত বড় হয় তত ভালো হয়। টবে/ড্রামে গাছে/ জাত নির্বাচনের পর য়ৌক্তিকভাবে সাজাতে হবে। যেমন বড় গাছ পূর্ব ও দক্ষিন পাশে না দিয়ে পশ্চিম ও উত্তর পাশে দিতে হবে। এতে আলো বাতাস রোদ ভালোভাবে পাবে। তাছাড়া ছোট বড় জাতের মিশ্রণ করে সেটিং করলে গাছের গাত্র বৃদ্ধিসহ বাড় বাড়তি ভালো হয়। আরেকটি জরুরি কথা হলো ছাদে বাগাপন করার ক্সেত্রে ফল চাষাবাদে কলমের এবং হাইব্রিড জাতের ব্যবহার বেশি ফলদায়ক।

তৃতীয় আরেকটি পদ্ধতি অনেকেই অনুসরণ করে। সুন্দরভাবে বাঁশ/পিলার রড দিয়ে জাংলো বা মাচা বানিয়ে পব/প্লাস্টিকের পাত্রে ফুল, বাহারী গাছ গাছালী, অর্কিড আবাদ করে থাকেন। এক্ষেত্রে ঝুলন্ত টব/পাত্র মাঝখানে না ঝুলিয়ে পাশে ডিজাইন করে সেটিং করলে জায়গার সদ্ব্যবহার করা যায়, দেখতেও সুন্দর লাগে।

যেভাবে করবেন মাটি তো নেই, বিশেষ করে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের। কিন্তু গাছ তো দরকার। তাই শেষ ভরসা বাড়ির ছাদ। সেখানেই ফুল, সেখানেই ফল। পৃথিবীর অনেক দেশে এখন ছাদে বাগান করা সে দেশের সিটি করপোরেশনের বাধ্যতামূলক আইন। শহরের ইট-পাথর যেন সবুজের স্পর্শ পায়, আমাদের দেশে সেসবের বালাই নেই। ব্যক্তি উদ্যোগে দুই-একটা ছাদ বাগান হয়েছে। কিন্তু নির্মল পরিবেশের জন্য যা খুবই কম। ছাদে বাগান আর মাটিতে বাগান এক বিষয় নয়, আবার কাজটি যে কঠিন, তাও নয়। জানা দরকার, ছাদের উপযোগী গাছ কোনগুলো। গাছের প্রজাতির ওপর নির্ভর করে ওই গাছটি ছাদ-বাগানের জন্য তা হাফ ড্রাম, টব নাকি চৌবাচ্চা কাঠামো করে লাগানো হবে এবং এসব গাছের জন্য পরিচর্যার ধরন কী হবে, তা আগেই ঠিক করে নিতে হবে। খোলামেলা ছাদ থাকলেই হলো। স্থায়ী বাগান করার জন্য ছাদে সিমেন্টের স্থায়ী টব তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে। গরুর নান্দার মতো বাজারে সিমেন্টের টব কিনতে পাওয়া যায়। সবচেয়ে উত্তম হয় লোহার হাফ ব্যারেল হলে। ব্যারেলের দুই পাশে হাতল থাকতে হবে। এর সুবিধা হচ্ছে টবটি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরানো যাবে। টবের নিচে ছিদ্র থাকা জরুরি। কয়েকটি ভাঙা চাড়ি ছিদ্রের মুখে দিয়ে মাটি ভরতে হবে। তিন ভাগ মাটি, দুই ভাগ গোবর সার আর এক ভাগ পাতা পচা সার দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে টব পূর্ণ করুন। বর্ষার আগে আগে টবে চারা কলম লাগাতে হবে। এই টবে ফুল, ফল, সবজির চাষ করা যেতে পারে। ফুলের মধ্যে গোলাপ, গাঁদা, দোলনচাঁপা, ডালিয়া, চন্দ্রমলি্লকা, ইউফোরবিয়াসহ মৌসুমি সব ফুলেরই চাষ করা সম্ভব। ছাদ বাগানে সবজিও ফলতে পারে। বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মরিচ, শসা, লাউ, কুমড়া, ঢেঁড়স, বরবটি, সিম, ক্যাপসিকাম, লেটুসপাতা, পুদিনাপাতা, ধনেপাতাসহ প্রায় সব ধরনের সবজি টবে ফলানো সম্ভব। ফলের মধ্যে আম, জাম, লিচু, শরিফা, সফেদা, কামরাঙ্গা, বাতাবিলেবু, জলপাই, কদবেল, ডালিম, পেয়ারা, কমলা, মালটা, কুল ছাদ বাগানকে আকর্ষণীয়, অনন্য করে তুলতে পারে। আজকাল অনেকেই ছাদ বাগান করার জন্য এগিয়ে আসছেন। তবে ছাদে ফল গাছ লাগানোর প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। ছোট একটি টবে ফল ধরলে যেমন দেখতে সুন্দর লাগে, তেমনি ছাদে প্রচুর পরিমাণ রোদ লাগে বলে ফলও ভালো হয়।

ছাদে কি কি গাছ লাগাবেন : ছাদে বাগান করার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন গাছটি বড় আকারের না হয়। অর্থাৎ ছোট আকারের গাছ লাগাতে হবে এবং ছোট আকারের গাছে যেন বেশি ফল ধরে সে জন্য হাইব্রিড জাতের ফলদ গাছ লাগানো যেতে পারে। আম্রপালি ও মলি্লকা জাতের আম, পেয়ারা, আপেল কুল, জলপাই, করমচা, শরিফা, আতা, আমড়া, লেবু, ডালিম, পেঁপে, এমনকি কলা গাছও লাগানো যাবে। ছাদ বাগানের প্রথম শর্ত হচ্ছে, গাছ বাছাই। জেনে, বুঝে, বিশ্বস্ত নার্সারি, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে গাছ সংগ্রহ করতে হবে। বেঁটে প্রজাতির অতিদ্রুত বর্ধনশীল ও ফল প্রদানকারী গাছই ছাদ বাগানের জন্য উত্তম। বীজের চারা নয়, কলমের চারা লাগালে অতিদ্রুত ফল পাওয়া যায়। আজকাল বিভিন্ন ফলের গুটি কলম, চোখ কলম ও জোড় কলম পাওয়া যাচ্ছে। ছাদ বাগানের জন্য এসব কলমের চারা সংগ্রহ করতে পারলে ভালো হয়। টবে আমের মধ্যে আম্রপালি, আলফানসো, বেঁটে প্রজাতির বারোমেসে, লতা, ফিলিপাইনের সুপার সুইট, রাঙ্গু আই চাষ করা যেতে পারে। লেবুর মধ্যে কাগজিলেবু, কমলা, মালটা, নারকেলি লেবু, কামকোয়াট, ইরানিলেবু, বাতাবিলেবু (অ্যাসেম্বল) টবে খুবই ভালো হয়। এ ছাড়া কলমের জলপাই, থাইল্যান্ডের মিষ্টি জলপাই, কলমের শরিফা, কলমের কদবেল, ডালিম, স্ট্রবেরি, বাউকুল, আপেলকুল, নারিকেলকুল, লিচু, থাইল্যান্ডের লাল জামরুল, গ্রিন ড্রপ জামরুল, আপেল জামরুল, আঙ্গুর পেয়ারা, থাই পেয়ারা, ফলসা, খুদে জাম, আঁশফল, জোড় কলমের কামরাঙা, এমনকি ক্যারালা ড্রফ প্রজাতির নারিকেলের চাষ করা যেতে পারে। সঠিক মানের চারা হলে এক বছরের মধ্যেই ফল আসে। আজকাল বিদেশ থেকে উন্নত মানের কিছু চারা কলম দেশে আসছে। ছাদ বাগানের সাধ পূরণ করার জন্য এসব সংগ্রহ করে লাগাতে পারেন। বাহারি পাতার জামরুল, পেয়ারা, সফেদা গাছও বিভিন্ন নার্সারিতে এখন কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। ছাদে এসব গাছ লাগানো হলে ছাদ বাগানের সৌন্দার্য বৃদ্ধি পায়।

টব : দরকারমতো সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো যায়। ছাদে টবে গাছ লাগানো অনেকেই পছন্দ করেন। টবে সার-মাটি দেওয়া খুব সহজ। আজকাল অনেকেই পোড়ামাটি এবং প্লাস্টিকের টব ব্যবহার করেন। আবার টবের গায়ে রং দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো যায়। টবে গাছ লাগানোর সময় মনে রাখতে হবে যেন ওই গাছ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টবের অল্প মাটিতে ওই গাছের খাদ্যপুষ্টি থাকে।

হাফ ড্রাম : বড় আকারের ড্রামের মাঝামাঝি কেটে দুই টুকরো করে বড় দুটি টব তৈরি করা যায়। বড় জাতের এবং ফলের গাছের জন্য হাফ ড্রাম ভালো। এগুলো সরাসরি ছাদের ওপর না বসিয়ে কয়েকটি টুকরো ইটের ওপর বসানো দরকার। অনেকে মনে করেন, ছাদের ওপর হাফ ড্রাম রাখলে ছাদের ক্ষতি হয়। এ ধারণা সঠিক নয়।

চৌবাচ্চা : ছাদে এক থেকে দেড় ফুট উঁচু এবং তিন থেকে চারটি পিলারের ওপর পানির ট্যাঙ্ক বা চৌবাচ্চা আকারের রিং স্লাব বসিয়ে ইটের টুকরো এবং সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে স্থায়ী চৌবাচ্চা তৈরি করা যায়। এই ধরনের চৌবাচ্চায় মাছ এবং জলজ উদ্ভিদ চাষ করে ছাদের পরিবেশ সুন্দর রাখা যায় সহজেই।

স্থায়ী বেড পদ্ধতি : ছাদের কোনো অংশে স্থায়ী বাগান করতে চাইলে সুবিধামতো আকারের স্থায়ী বেড তৈরি করা যায়। তবে চার ফুট দৈর্ঘ্য, চার ফুট প্রস্থ এবং দুই ফুট উচ্চতার বেড তৈরি করা ভালো। এ ধরনের বেড তৈরি করতে নিচে পুরু পলিথিন দিয়ে ঢালাই করলে ছাদ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

টবের টিপস : ফুল কিংবা ফল গাছ যাই হোক না কেন, টব ব্যবহার করার সময় লক্ষ রাখতে হবে, গাছের আকার কত বড় হবে। সেই মতো টবের আকার নির্ধারণ করা দরকার। পানি গড়িয়ে যাওয়ার জন্য টবের নিচে ছিদ্র থাকতে হবে। ছিদ্রের ওপর নারকেলের ছোবড়া বা ইটের টুকরো দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। টবে ব্যবহারের আগে টবে ব্যবহার করা ছোবড়া বা ইটের টুকরো ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। গরম পানিতে ধুয়ে নিতে পারলে ভালো। যে গাছের চারা লাগানো হবে তা সাধারণ পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। এর ফলে রোগের সংক্রমণ অনেক কমে যায়। চারা কেনার সময় অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের চারা সংগ্রহ করা দরকার। গাছ বড় হলে প্রয়োজনে বড় টবে সাবধানে চারা স্থানান্তর করে নেওয়া যায়। তবে টব ভেঙে চারা গাছ বের করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, চারা গাছটি যেন কোনোভাবেই আঘাত না পায়।

টবের সার-মাটি : টবের গাছের খাদ্যপুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য মাটিতে দরকারি সার মেশাতে হবে। মাটি, গোবর সার, কম্পোস্ট, পচা পাতা, পরিমাণমতো রাসায়নিক সার মেশাতে হবে। শুকনো দূর্বা ঘাস টবের মাটির মাঝামাঝি দিয়ে তার ওপরে মাটি দিয়ে চারা গাছ লাগানো ভালো।

গাছ বা চারা নির্বাচন ছাদে বাগান যতটা না বাণিজ্যিক তার চেয়ে বেশি নান্দনিক এবং শখের। উদ্দেশ্য যাই থাক জাত নির্বাচনে সতর্ক সচেতন হওয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে সাধারণ জমিতে যে ভাবে চাষ বাস করা যায় ছাদে সে ভাবে করা যায় না। গাছ সাধারণভাবে তাদের বাড় বাড়তির জন্য তেমন জায়গা পায়না। সেজন্য অতিরিক্ত যত্ম সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষভাবে সর্তক থাকতে হবে। মনে রাখা দরকার ছাদের বাগানে কখনো ঝোপ/ঝাড়/বাঁশ টাইপের কোন বড় গাছ/জাত লাগানো যাবে না। এতে হিতের বীপরিত হয়ে যাবে। লেবু, পেয়ারা, আম, জামরুল, ডালিম, আমড়া, লিচু, কামরাঙ্গা, জলপাই, করমচা এসব ফল বেশী উপযোগী। ফলের ক্ষেত্রে হাইব্রিড বা দেশীয় যে কোন জাত থাকনা কেন কেন কলমের চারা ব্যবহার করা বেশি ভালো। এতে নানন্দিকতা ভালোভাবে রক্ষা পায়, কম জায়গা খরচ হয়। ফুল এবং সবজির ক্ষেত্রে জাতের কোন বালাই নেই। কেননা ফুল এবং সবজি কখনো বেশি জায়গা নেয় না। আমাদের দেশের প্রচলিত জাতের ফুল, শাকসবজির সবটাই সহজে উৎপাদন করা সম্ভব। বাড়ির বারান্দায় মালতি লতা, দোপাটি, হাসনাহেনা। উঠোনে লাউয়ের মাচা, ঘি কাঞ্চন মরিচ। একটু দূরেই ডালিম, প্রবীণ আম বৃক্ষ। এসব স্মৃতি হয়ে গেছে। স্মৃতি হয়ে গেছে দলিজ ঘরের বারান্দার বাগান, নিকানো উঠোন। কংক্রিটের দেয়াল, বহুতল ভবন ওইসব স্মৃতি গিলে খেয়েছে। নগর সভ্যতায় হারিয়ে যাচ্ছে মাটি। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। তারপরও অনেকে বাগান করার স্বপ্ন দেখেন। জানালায় ঝুলিয়ে দেন মানিপ্লান্টের লতা। তবে স্বপ্ন থাকলে, ইচ্ছা থাকলে কংক্রিটের দালানকোঠার মধ্যেও বাগান করা সম্ভব। ফিরিয়ে আনা সম্ভব শৈশবের স্মৃতিঘেরা সেই হারানো লতা, ফুলের খশবু। ছাদে বাগান করে ফুল, ফল, সবজির সব স্বাদই পূরণ করা সম্ভব। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন ইচ্ছাশক্তি আর বাগানের প্রতি প্রেম।

যত্ম সেবা যেহেতু সীমিত আকারে সীমিত জায়গায় উৎপাদন করা হয় সেজন্য অতিরিক্ত যত্ম সেবা নিশ্চিত করতে হবে এবং বিভিন্ন পরিচর্যায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি। কেননা সার কমবেশি হলে, গাছের সাথে লেগে গেলে গাছ মরে যাবে, পরিমাণ মতো না হলে অপুষ্টিতে ভুগবে।
টবের ক্ষেত্রে ছোট গাছ বড় হলে পট/টব বদল, ডিপটিং (পুরানো টবকে আলতো করে মাটিতে শুইয়ে গড়াগড়ি দিলে গাছটি টব থেকে বেড়িয়ে আসবে। পরে অতিরিক্ত মূল কেটে মাটি বদলিয়ে সার প্রয়োগসহ নতুনভাবে গাছ বসানো) করতে হবে সময়মতো। বছরে অন্তত একবার পুরাতন মাটি বদলিয়ে নতুন মাটি জৈব সারসহ দিতে হবে। ইদানিং বাজারে টবের মাটি কিনতে পাওয়া যায়। মানসম্মত মাটি কিনে টবে/পটে/ড্রামে ভরতে হবে।
খুব সাবধানতার সাথে টব/পটে/ড্রামে/চারা/কলম/বীজ লাগাতে হবে। ঠিক মাঝখানে পরিমাণ মতো মাটির নিচে রোপন করতে হবে। চারা বা কলমের সাথে লাগানো মাটির বল যেন না ভাঙ্গে সেদিকে নজর রাখতে হবে। চারা বা কলমের ক্ষেত্রে বীজতলা/নার্সারিতে যতটুকু নিচে বা মাটির সমানে ছিল ততটুকু সমানে ছাদে লাগাতে হবে। বীজতলার থেকে বেশি বা কম গভীরে লাগালে গাছের বাড়বাড়তিতে সমস্যা হবে। মাঠে ফলমুল সবজি চাষের চেয়ে ছাদে সবজি চাষের অনেক পার্থক্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। চাদের বাগানে প্রতিদিন পরিষ্কার কার্যক্রম অনুসরণ করতে হবে। সেজন্য পুরাতন রোগাক্রান্ত, বয়স্ক ডালপালা, পাতা সাবধানতার সাথে কেটে নির্দিষ্ট স্থানে জমা করতে হবে। এতে গাছপালা রোগমুক্ত থাকবে ফলনে সুবিধা হবে। ফুল এবং সবজিতে প্রয়োজন মাফিক সার প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু ফলের ক্ষেত্রে অন্তত দু'বার একবার বর্ষার আগে একবার বর্ষার পরে সাবধানে পরিমাণমত সার দিতে হবে। সার প্রয়োগের সময় মাটির আর্দ্রতা দেখে নিতে হবে। কেননা বেশি আর্দ্র বা কম আর্দ্র কোন টাইপের সার প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত নয়। বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু কিছু সার পানিতে মিশিয়ে গাছ ছিটিয়ে দিতে হবে। গুঁটি সারও এ ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগী।
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় কোন ফলে পোকা বা রোগের আক্রমণ অহরহ ঘটে থাকে। সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রতি ২/৩ বার যদি চাদের বাগান পরিদর্শন করা যায় তাহলে বালাই আক্রমণ যেমন কম হবে তেমনি ফসলও পাওয়া যাবে অনেক। সুতরাং লাভ বেশি হবে। যদি হঠাৎ বেশি মারাত্মক আক্রান্ত হয়ে যায় তখন উপযুক্ত বালাইনাশক সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে হবে। আলোচ্য নিবন্ধে ছাদের কথা বলা হয়েছে কিন্তু অন্যান্য পদ্ধতি অনুসরন করে স্থানকালপাত্র অনুযায়ী ঘরের ভেতরে, সিঁড়ি, ব্যালকনি, বারান্দা, কার্নিশ এসব জায়গায় ও অনায়াসে গাছ লাগানো যায়।

সেচ নিস্কাশন ছাদে/টবে সেচ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা মাটির আর্দ্রতার জন্য সহজেই গাছপারা নেতিয়ে যাবে তেমনি অতি পানি বা পানির আর্দ্রতার জন্যও গাছ নেতিয়ে পড়ে মরে যেতে পারে। তাই অবশ্যই ছাদের বাগানে প্রতিনিয়ত সেচের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। ছাদের বাগানে সেচের জন্য ক্সিকিলার অর্থাৎ ঝাঁঝরি দিয়ে সেচ দেয়া ভালো। তাছাড়া প্লাস্টিকের চিকণ পাইপ দিয়েও পানি সরবরাহ বা দেয়া যায়। এক্ষেত্রে ডেলিভারি পাইপের মাথায় চাপ দিয়ে ধরলে পানি হালকাভাবে ছিটিয়ে পরে সুতরাং ইচ্ছে করলে ঐ পদ্ধতিও অনুসরণ করা যায়। জীবনের প্রয়োজনে মানুষ অনেক নতুন তথ্য প্রযুক্তি আবিষ্কার করে। শখের বিলাশী ঘটনাও সময়ের ব্যবধানে আবশ্যকীয় হয়ে যায় এবং সর্বজনবিদিত উপকারি ও জনপ্রিয় হয়ে যায়। ছাদের বাগানও তেমন। সময়ের প্রয়োজনে জীবনের প্রয়োজনে সবাই এক চিলতে জায়গাও খালি রাখতে চায় না। প্রতি ইঞ্চি জায়গাকে যৌক্তিকভাবে ব্যবহার করতে চায়। দিন বদলের পরিক্রমায় অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ছাদের বাগান একটি আবশ্যকীয় প্রযুক্তি পদ্ধতি হয়ে স্থান পাবে। সবচেয়ে বড় কথা ছাদে বাগানকে একটি অতিরিক্ত লাভ হিসেবে পরিগণিত করা যায়।

তাই আমাদের যার যার সুযোগ আচে সে সুযোগকে যৌক্তিকভাবে কার্যকর ভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের বহুমুখী লাভ হবে। আসুন আমরা সবাই এ সুযোগের আওতায় সর্বোচ্চ লাভ ঘরে তুলি, কৃষিকে সমৃদ্ধ করি দেশেকে সমৃদ্ধ করি।

ছাদে বাগানের কিছু জরুরি টিপস
১) লম্বা গাছকে ছোট গাছকে সামনে রাখতে হবে।
২) টবে বা ফ্রেমে খৈল দেয়া যাবে না, এতে পিঁপড়ার উপদ্রব বাড়তে পারে।
৩) বাজার থেকে কেনা প্যাকেটজাত কম্পোস্ট সার ব্যবহার করলে ভালো।
৪) বছরে একবার নতুন মাটি দিয়ে পুরাণ মাটি বদলিয়ে দিতে হবে। এটি অক্টোবর মাসে করলে ভালো।
৫) ছাদে বাগানের জন্য মিশ্র সার, গুঁটি ইউরিয়া, খৈল, হাড়ের গুঁড়া (পচিয়ে) ব্যবহার করা ভালো।
৬) বাজারে স্টিল লোহার ফ্রেম পাওয়া যায়। এগুলো দিয়ে অনায়সে ছাদে বাগান করা যায়।
৭) অবস্থা বুঝে গাছের গোড়ায় চুনের পানি সপ্তাহে ১ বার ব্যবহার করা যায়।

সমন্বিত গলদা চিংড়ি চাষ পদ্ধতি

গলদা চিংড়ি
ভূমিকাঃপ্রতিনিয়তই আমাদের দেশের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার বাসস্থানের প্রয়োজনেই মূলতঃ কৃষি জমির পরিমাণ কমলেও বাড়ছে মানুষের খাদ্যের চাহিদা। ফলে ব্যাপক জনগোষ্ঠির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের চাহিদা বর্তমান আবাদযোগ্য জমি থেকে প্রাপ্ত ফলন দ্বারা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রথমতঃ ক্রষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে এবং দ্বিতীয়তঃ সম্পদের সঠিক ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না বিধায় কৃষকের আয় বাড়ছে না। ফলশ্রুতিতে কৃষি প্রধান আমাদের এই দেশের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশই খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দূরাবস্থায় জীবন-যাপন করছে। এমতাবস্থায় কৃষি জমি ও সম্পদের সঠিক ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই সম্পদের সঠিক ও সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে লক্ষিত জনগোষ্ঠির অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নের উদ্দেশ্যে মৎস্য চাষ সমপ্রসারণ প্রকল্পের অধীনে পরীক্ষামূলকভাবে করা হয়েছিল নীচু ধানক্ষেতের মিঠা পনিতে "সমন্বিত চিংড়ি চাষ কার্যক্রম"। কারণ ইতিমধ্যে এই খামার পদ্ধতিটি একটি খুবই লাভজনক ব্যবসায়িক কর্মকান্ড হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
সমন্বিত চিংড়ি চাষ অধিক আয়ের উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট ধানের জমিকে গলদা চিংড়ি চাষের উপযোগী করে প্রস্তুত করণের পর সেখানে মিঠা পানির চিংড়ি (গলদা), সাদা মাছ, ধান ও শাক-সব্জি একত্রে চাষাবাদ করাই হচ্ছে "সমন্বিত চিংড়ি চাষ"। অর্থাৎ একটি জমির চারপাশে উঁচু আইল তৈরী করে আইলের ভিতরের দিকে ক্যানেল বা ড্রেনের মতো কেটে পানিকে দীর্ঘদিন আটকে রাখার ব্যবস্থা করে (১-দিক, ২-দিক) সেখানে গলদা চিংড়ি সাদা মাছ (সিলভার কার্প, কাতলা, বিগহেড ইত্যাদি), জমির মাঝখানের সমতল জায়গায় ধান ও আইলে শাক-সব্জি একত্রে চাষ করাই হচ্ছে "সমন্বিত চিংড়ি চাষ"। উল্লেখিত ফসলের মধ্যে গলদা চিংড়িই বেশী মূল্যবান তাই এই চাষ ব্যবস্থাকে "সমন্বিত চিংড়ি চাষ" বলে অভিহিত করা হয়েছে।
সমন্বিত চিংড়ি চাষের গুরুত্ব আমদের দেশের বিভিন্ন জমিতে চাষ করা হয়। যেমনঃ যদি কোন জমিতে ধান চাষ করা হয় তবে ষেখানে শাক-সব্জি চাষ করা হয় না বা জতিতে শাক-সব্জি চাষ করলে ধান চাষ করা হয় না আবার মাছ চাষের জন্য পুকুরকেই নির্বাচন করা হয়। আবার শখের বসে যদি কেই চিংড়ি চাষ করে তবে পুকুরই শেষ ভরসা। এভাবেই চলঠে আমাদের বর্তমান চাষাবাদ অবস্থা। ফলশ্রুতিতে জমির সঠিক ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে না এবং জমি থেকে প্রাপ্ত আয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছে না আমাদের চাষী ভাইয়েরা। এমতাবস্থায় সমন্বিত চাষের মাধ্যমে ছোট্ট এক টুকরা জমিকেও টাকার খনিতে রূপান্তরিত করা যায়। অর্থাৎ বিভিন্ন ফসল প্রথকভাবে চাষ না করে এক টুকরা ধানের জমিতে একই সাথে গলদা চিংড়ি, মাছ, ধান ও শাক-সব্জির চাষ করার মাধ্যমে একদিকে যেমন জমি থেকে প্রাপ্ত আয় বৃদ্ধি পায় অপরদিকে চাষাবাদের ঝুঁকি/ক্ষতির সম্ভাবনা কমে যায়। নিম্নে একর প্রতি (১০০ শতাংশ) জমির বাৎসরিক আয়ের তুলনামূলক তথ্য প্রদান করা হলোঃ
ক্রমিক নং ফসল একক চাষ সমন্বিত চাষ
১. ধান ১০,০০০ ১০,০০০
২. চিংড়ি (মিঠা পানির) - ৬০,০০০
৩. মাছ - ৮০০০
৪. শাক-সব্জি - ২০০০

মোট ১০,০০০ (সর্বোচ্চ) ৮০,০০০(নুন্যতম)
সমন্বিত গলদা চিংড়ি চাষ পদ্ধতিসমন্বিত চিংড়ি চাষ পদ্ধতি হচ্ছে ধারাবাহিক কার্যক্রমের সমন্বয়। অর্থাৎ কাংখিত ফল পেতে হলে এই চাষাবাদ ব্যবস্থার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কিছু পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সামান্য অবহেলা আপনাকে অনেক লাভ থেকে বঞ্চিত করতে পারে। বাংলাদেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্জলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার চাষী ভাইয়েরা সমন্বিত চিংড়ি চাষ পদ্ধতির প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্ব ও যত্নের সহিত পালন করে এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদের অতীত দুরাবস্থার থেকে অতি অল্প সময়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ভালো অবস্থায় আসতে পেরেছে। আর এতে এটি প্রমাণিত হয় যে, পরিশ্রম করলে অবশ্যই সফলতা আসে।
সমন্বিত চিংড়ি চাষ পদ্ধতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে সমস্ত পদক্ষেপগুলো নিতে হবে তা হলোঃ
১. জমি নির্বাচন ও অবকাঠামো তৈরী।
২. জমি প্রস্তুতকরণ / উপযোগীকরণ।
♥ মজুদ পূর্ব ব্যবস্থা
♥ মজুদকালীন ব্যবস্থা
♥ মজুদ পরবর্তরী ব্যবস্থা
৪. নার্সারী পুকুর থেকে জুভেনাইল (ছাটি) মূল জমিতে মজুদ, নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ ও যত্ন নেয়া।
৫. চিংড়ির সাথে অন্যান্য মাছের মিশ্রচাষ।
৬. আইলে শাক-সব্জি চাষ।
৭. নিয়মিত (মাসে দু'বার) চিংড়ির নমুনা পর্যবেক্ষণ।
৮. চিংড়ি আহোরণ ও বাজারজাতকরণ।
৯. চিংড়ি রোগ ব্যবস্থাপনা (সম্ভাব্য)।

জমি নির্বাচন ও অবকাঠামো তৈরী
জমি নির্বাচনঃ
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সমন্বিত চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনায় ধানের সাথে গলদা চিংড়ি, মাছ (সিলভার, কাতলা) ও শাক-সব্জি একত্রে চাষ করা হয়। কিন্তু সব জমিই এই চাষাবাদ ব্যবস্থার জন্য উপযুক্ত নয়। যেমনঃ উচুঁ জমি বা যে জমিতে বালি মাটির পরিমাণ বেশী সে জমিতে পানি ধরে রাখা যাবে না তাই চিংড়ি ও সাদা মাছ চাষ করা যাবে না এবং সমন্বিত চাষ হবে না। তাই প্রথমে জমি নির্বাচন একান্ত জরুরী।

উপযুক্ত জমির বৈশিষ্ট্যঃ
জলাবদ্ধ নিচু জমি বা ধান ক্ষেত ।
যেখানে ৭-১০ মাস বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায়।
যেখানে কাঁদা মাটির পরিমাণ বেশী।
বসত বাড়ির নিকটস্থ জমি।
অবকাঠামো তৈরীঃ
জমি নির্বাচনের পর নির্বাচিত জমিতে সমন্বিত চিংড়ি চাষের উপযোগী অবকাঠামো তৈরী করতে হবে। যেন জমির প্রতিটি অংশই সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়।
অবকাঠামো তৈরীর ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণঃ
(ক) আইল তৈরীঃ জমির পার্শ্বে পর্যাপ্ত উঁচু (বর্ষাকালে জমিতে আটকে থাকা পানির লেভেল থেকে ১ হাত উঁচু) ও মোটা/চওড়া (উপরে ২ ফুট নীচে ৩ ফুট) আইল তৈরী করে-
নিম্নোক্ত সুবিধা অর্জন করা যায়ঃ
জমিতে পানি ধরে রাখা যায়।
চিংড়ি বা মাছ অন্য জমিতে যেতে পারে না।
বাইরের পঁচা ও নোংরা পানি ভিতরে ঢুকবে না।
আইলে শাক-সব্জি চাষ করে পারিবারিক চাহিদা মেটানো ও অর্থ উপার্জন করা যায়।
(খ) ক্যানেল/ড্রেনঃ জমিতে আইলের ভিতরের দিকে আইল থেকে ৩-৪ ফুট জায়গা (বকচর) ছেড়ে দিয়ে ক্যানেল বা ড্রেন (৭-১০ ফুট চওড়া ও ৩-৫ ফুট গভীরতা) তৈরী করে-
নিম্নোক্ত সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে হবে-
চিংড়ি ও মাছের আশ্রয়স্থল হিবেবে কাজ করবে।
সূর্যের তাপে পানি গরম হলে ক্যানেলের ঠান্ডা পানিতে আশ্রয় নিবে।
শুকনা মৌসুমে জমিতে পানি ধরে রাখা যাবে।
চিংড়ির খাদ্য প্রয়োগের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
উল্লেখ্য জমির আয়তন ও চাষীর সামর্থ্য অনুযায়ী জমির ক্যানেল তৈরী করতে হবে। জমি বড় হলে কমপক্ষে ৩ দিকে ব্যানেল এবং ছোট হলে ২ দিকে ক্যানেল কাটতে হবে। জমিতে একটু বেশী চওড়া করে ১০-১ ফুট ক্যানেল কাটলে একদিকে হলেও চলবে।

(গ) নাসর্রী পুকুরঃ অন্যান্য মাছের রেণুর মত চিংড়ির রেণুকে প্রথমেই চাষের জায়গায় ছেড়ে দেওয়া উচিৎ নয়। কারণ এতে চিংড়ির রেণু বেশী পরিমাণ মারা যায়। তাই রেণুকে বাঁচানোর জন্য অবকাঠঅমো তৈরীর সময়ই নির্বাচিত জমির যে কোন এক পার্শ্বে প্রথম একটি জায়গা তৈরী করতে হবে যেখানে ৩০-৩৫ দিন রেণুকে প্রথকভাবে যত্ন নেয়া যায়। রেণুকে পৃথকভাবে যত্ন নেয়া যায়। রেণুকে পৃথকভাবে রাখার এই জায়গাকেই নার্সারী পুকুর বলে। নাসর্রী পুকুর সাধারনতঃ ছোট হলেই ভালো এবং জমির পরিমাণও সম্ভাব্য চিংড়ি মজুদ সংখা্যার উপর পুকুরের আকার নির্ভর করে। তবে সাধারণতঃ ৩ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ এবং ৩-৫ ফুট গভীরতাই উত্তম।

জমির প্রস্তুতকরণ সমন্বিত চাষের জমি প্রস্তুত করা হলো- ধান বা অন্য ফসল উৎপাদনের জন্য জমি তৈরী করা মতো। জমিতে ভাল ফসল পাবার জন্য যেমন আইল ঠিক করা, চাষ দেয়া, আগাছা পরিস্কার করা, সার প্রয়োগ এবং আনুসাঙ্গিক কাজ করে চারা রোপন করতে হয় তেমনই চিংড়ি চাষের জমিতে পোনা ছাড়ার পূর্বে আনুসাঙ্গিক কতগুলো কাজ করতে হয়। এতে করে পোনা উপযুক্ত পরিবেশ পায়। ফলশ্রুতিতে ভাল উৎপাদন পাওয়া যায়। তাছাড়াও চিংড়ি চাষে ভবিষ্যতের সমস্যাসমূহ যেমনঃ পানিতে দূষিত গ্যাস সৃষ্টি, চিংড়ির রোগ ইত্যাদির হাত হতে চিংড়িকে রক্ষা করতে চিংড়ি চাষের নির্ধারিত প্লট/জমিকে প্রস্তুত করা একান্ত জরুরী। সুতরাং জমি প্রস্তুতের মাধ্যমে নির্ধারিত প্লট/জমিকে চিংড়ি পোনা মজুদের উপযোগী করে তোলা অর্থাৎ তাদের জন্য একটা সুস্থ্য-সবল পরিবেশ তৈরী করে দেয়া হয়।

ঘের বা খামার প্রস্তুত করার সময় কতগুলো পদক্ষেপ বা ধাপ অনুসরণ করতে হয়, সেগুলো হলোঃ
ঘেরের পাড় মেরামত করা
পর্যাপ্ত সূর্যের আলো নিশ্চিত করা ও আগাছা অপসারণ
পেরী বা কাঁদা উঠিয়ে ফেলা
রাক্ষুসে এবং অবাঞ্চিত মাছ অপসারণ করা
চুন প্রয়োগ করা
সার প্রয়োগ করা
সার প্রয়োগ করা
পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতি ও পোনা ছাড়ার উপযোগ্যতা যাচাই

পাড় মেরামত করাঃ
জমির পাড়ে যাতে এমন কোন বড় গাছ বা অন্য কিছু না থাকে যাতে পানিতে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়তে অসুবিধা হয়। তা'ছাড়া ঘেরের ঢাল বা পাড়ে অনাকাঙ্খিত আগাছা থাকলে, পাড়ে গর্ত থাকলে, বিভিন্ন ধরনের রাক্ষুসে প্রাণী লুকাতে পারে যারা পোনা খেয়ে ফেলতে পারে ( যেমনঃ সাপ, উদ, বেজী ইত্যাদি)। তাছাড়া পাড় যাতে ভাঙ্গা না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে বন্যার পানি বা পাশর্্ববর্তী জমির পানি অনুপ্রবেশ জনিত অসুবিধার সৃষ্টি না হতে পারে। ঘের তৈরীর সময় ঘেরে পানি আসা-যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। কারণ পানি আসা-যাওয়ার সাথে ঘেরের পানির গুণাগুণ নির্ভর করে।

পর্যাপ্ত সূর্যের আলো নিশ্চিত করা ও আগাছা অপসারণঃ
জমিতে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত জলজ উদ্ভিদ জন্মাতে পারে যা ডুবন্ত বা ভাসমান বা অর্ধ ডুবন্ত যারা পানি থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে খাদ্য উপাদার কমিয়ে ফেলে এবং এরা পর্যাপ্ত সূযের আলো প্রবেশ করতে দেয় না এবং রাতে পানি হতে অক্সিজেন গ্রহণ করার ফলে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয় তাছাড়াও সালোক সংশ্লেষন প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরী প্রক্রিয়া ব্যহত করে ও আগাছা পচনের বিষাক্ত গ্যাস তৈরী করতে পারে ফলে জমি চিংড়ি চাষের অনুপযোগী হয়ে যায়। তাই জমি প্রস্তুতের সময় এবং পরবর্তী সব সময় এগুলো অপসারণ করতে হবে।

পেরী বা কাঁদা উঠিয়ে ফেলা (মাছ/চিংড়ি চাষকৃত পুরাতন জমি):
চিংড়ি ও মাছের উৎপাদনের জন্য চিংড়ি চাষীরা প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন প্রকার খাবার দিয়ে থাকে। এদর সবটাই চিংড়ি বা সাদা মাছ গ্রহণ করে না। ফলে অবশিষ্টাংশ পঁচে পানির তলায় জমা হয়। এছাড়া বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ মরে পচে মাটিতে মিশে এবং ঘেরের পাড়ের মাটি তলায় জমে জ্রচুর কাঁদার সৃষ্টি করে থাকে। এসব থেকে বিভিন্ন প্রকার গ্যাস সৃষ্টি হয় এবং এতে পানির গুণাগুণ নষ্ট হয়। চিংড়ি এবং সাদা মাছের উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাই চিংড়ি চাষের জমি তৈরীর সময় অতিরিক্ত কাঁদা তুলে ফেলতে হয়। উল্লেখ্য নতুন চিংড়ি চাষের জমি হতে প্রথম ৩ বৎসর কাঁদা অপসারনের প্রয়োজন নেই।

রাক্ষুসে এবং অবাঞ্চিত মাছ অপসারণ করাঃ
চিংড়ি খামারে পোনা মজুদের পূর্বেই নিশ্চিত করতে হবে যে, খামারে রাক্ষুসে এবং অবাঞ্চিত প্রজাতির মাছ নেই। আর রাক্ষুসে এবং অবাঞ্চিত মাছ থাকলে ঘের ব্যবস্থাপনা ভালো হবে না। কারণ রাক্ষুসে প্রজাতিরা (যেমনঃ বোয়াল, শোল, টাকী, কই, আইর, কাকিলা, চিতল ইত্যাদি) মাংস ভোজী বিধায় এরা অন্য সকল প্রজাতি ভক্ষণ করে। তা'ছাড়া অবাঞ্চিত প্রজাতি (যেমনঃ মলা, ঢেলা, পুটি ইত্যাদি) এরা রাক্ষুসে নয় কিন্তু চাষযোগ্য পোনার খাবার এবং অক্সিজেন এ ভাগ বসায়।
তা'ছাড়া আমাদের দেশের চিংড়ি চাষীরা পূর্ববর্তী বছরের চিংড়ি রেখে দেন পরবর্তী বছর ভালো বাজার পাবার আশায় কিন্তু গলদা চিংড়ি স্বজাতিভোজী তাই সুযোগ পেলে তারা পরবর্তী বছরের রেণু পোনা খেয়ে ফেলে। এজন্য পূর্ববর্তী পোনা না রাখাই ভালো।
রাক্ষুসে এবং অবাঞ্চিত প্রজাতি অপসারণের ক্ষেত্রে চাষীদের আর্থিক ক্ষমতা ও প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বিবেচনা করে।

নিম্নোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারেঃ
(ক) বারবার জাল টেনে-এতে রাক্ষুসে এবং অবাঞ্চিত মাছ অপসারণ করা সম্ভব।
(খ) ঘেরের পানি শুকনো- ২/৩ বছর পর পর ঘেরের পানি শুকালে ভাল হবে।
তবে সে ক্ষেত্রে পানির উৎস বিবেচনায় রাখতে হবে।

চিংড়ি চাষের জমি শুকানোর সুবিধাঃ
অতিরিক্ত কাদা বা তলানী দূর করা
রাক্ষুসে বা অবাঞ্চিত মাছ অপসারিত করা
সূর্যের তাপে ঘেরের তলদেশের মাটি পুষ্টি সমৃদ্ধ হয়
তলার মাটির বিষাক্ত গ্যাস দূরীভূত হয়, তবে বিবেচনা করতে হবে পুনরায় পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করা যাবে কিনা।

যদি উপরের পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করা সম্ভব না হয় সে ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত হারে রোটেনন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
(গ) রোটেনন প্রয়োগঃ
প্রয়োগ মাত্রা আয়তন গভীরতা শক্তি বিষাক্ততার মেয়াদ
১৮-২০ গ্রাম প্রতি শতক প্রতি ফুট পানির জন্য ৯.১ ৭-১০ দিন
২০-২৫ গ্রাম প্রতি শতক ৭%
চুন প্রয়োগ করাঃ চিংড়ি ও মাছ চাষের ক্ষেত্রে চুনের ব্যবহার হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে চুনের গুনের শেষ নেই। যেমনঃ
চুন ব্যবহার মাটি ও পানির ক্ষতির রোগজীবানু ধ্বংস হয়।
চুন প্রয়োগে (চুনে ক্যালসিয়াম থাকে) মাছ ও চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
চুন নিয়মিত ব্যবহারে রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
চুন প্রয়োগে পানির ঘোলাটে ভাব দূর হয়ে পানির ভিতরে সূর্যের আলো প্রবেশে সহযোগিতা করে ও প্রকৃতিক খাদ্য তৈরীর প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।
চুন সারের কার্যকারিতাকে বৃদ্ধি করে।
পানিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া পানিতে থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করায় চিংড়ির অক্সিজেনের অভাব হয়। চুন প্রয়োগ করলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যাকটেরিয়াগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে ফলে তাদের অক্রিজেন ব্যবহার কমে যায়।

প্রয়োগ মাত্রাঃ
চুন প্রয়োগ মূলত নির্ভর করে জমির মাটির গুনাগুনের উপর। চিংড়ি চাষের জমি তৈরীর সময় পাথুরে চুন শতাংশে ১ কেজি হারে ব্যবহার করা উত্তম।
ব্যবহার পদ্ধতিঃ

শুকনা জমির জন্যঃ
জমিতে যখন পানি থাকে না অর্থাৎ শুকনা জমিতে পাথুরে চুন গুড়া করে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
পানি থাকা অবস্থায়ঃ
চাড়ি বা মাটির গর্তে পরিমানমত চুন ৮-১০ (প্রয়োজনে ৩-৪ ঘন্টা পরে ও ব্যবহার করা যায়।) ঘন্টা পূর্বে ভিজিয়ে গুলিয়ে নিতে হবে। উক্ত চুন ঘেরের পানিতে বা শুকনো ঘেরের চাতাল ও পাড়ের মাঝের খালে ও ঢালে ছিটিয়ে দিতে হবে।

সার প্রয়োগ করাঃ
চুন প্রয়োগের অন্তত ৫-৭ দিন পর জমিতে তলার প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য জৈব সার বা কম্পোষ্ট সার বা সবুজ সার বা প্রয়োজনে অজৈব সার ব্যবহার করা যেতে পারে। জৈব সার হিসেবে হাঁস-মুরগীর বিষ্টা, পানিতে সরাসরি না দিয়ে অন্ততঃ ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে তারপর প্রয়োগ করা উত্তম। তবে শুকনা জমিতে সরাসরি প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়া যায়।

চিংড়ি চাষের জমি তৈরীর সময় নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করা যেতে পারেঃ

প্রতি শতাংশে- পানিতে প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে- পানিতে প্রয়োগের ক্ষেত্রে
গোবর / কম্পোষ্টঃ ৩-৫ কেজি বা গোবরঃ ৩০-৪০ কেজি
হাঁস-মুরগীর বিষ্টাঃ ২-২.৫০ কেজি হাঁস-মুরগীর বিষ্টাঃ ১৫-২০ কেজি
ইউরিয়াঃ ১০০ গ্রাম চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে খুব একটা প্রযোজ্য নয়।
টিএসপিঃ ১০০ গ্রাম
[বিঃ দ্রঃ এখানে মনে রাখা দরকার যে, সার প্রয়োগের মাত্রা সব সময় ঠিক থাকবে না। অবস্থা ভেদে এর পরিবর্তন করতে হতে পারে।]

পানিতে প্রকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতি ও পোণা ছাড়ার উপযোগ্যতা যাচাইঃ

সার প্রয়োগের সময় পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরী হয়। পানিতে আনুবিক্ষণীক ও দৃশ্যমান বিভিন্ন প্রকার শেওলা ও প্রণী কনাই হলো প্রকৃতিক খাদ্য। প্রাকৃতিক খাদ্যে চিংড়ির স্বাস্থ্য বৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুকুরের পানির রং দেখেও পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্যর উপস্থিতি বুঝা যায়। প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরীর জন্য আলো, তাপ, পুষ্টি পদার্থ ও অনুকুল পরিবেশের প্রয়োজন হয়। পরিবেশের তারতম্যের জন্য এই প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদনেও হ্রা-বৃদ্ধি ঘটে।
প্রাকৃতিক খাদ্যের সঠিক মাত্রা নিূপণ করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। সার প্রয়োগের ৫-৭ দিনের মধ্যে পানিতে খাবার তৈরী হয়েছে কিনা তা বুঝা যাবে। পানির রঙ হালকা সবুজ, লালচে ও বাদামী সবুজ হলে বুঝতে হবে খাদ্য তৈরী হয়েছে। তাছাড়া প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরী হয়েছে কিনা তা বুঝা যাবে-

সেকী ডিস্ক ব্যবহার করে

স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাস ব্যবহার করে

হাত দিয়ে


সেকী ডিস্ক পদ্ধতিঃ

সেকী ডিস্ক পানিতে ডুবানেরা পর-

লাল সুতা পর্যন্ত বেশী খাদ্য সার দিতে হবে না, পোণা ছাড়া যাবে না
সবুজ সুতা পর্যন্ত ভালো খাদ্য পোণা ছাড়া যাবে, নিয়মিত সার দিতে হবে
সাদা সুতা পর্যন্ত খাদ্য নেই সারের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে
হাতের তালু পদ্ধতিঃ সূর্যের আলোয় আলোকিত দিনের ১০-১১ টায় হাতের কনুই পর্যন্ত পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে হাতের তালু / পাতা যদি দেখা না যায় তবে বুঝতে হবে পরিমিত প্রাকৃতিক খাদ্য নেই এবং নিয়মিত সার দিতে হবে। অর্থ্যৎ হাতের তালু না দেখা গেলে বুঝতে হবে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য আছে।
স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসে পানি নিয়েও এ কাজ করা যায়।

গলদা চিংড়ির রেণূ মজুদ উল্লেখিত চিংড়ি চাষের জমি প্রস্তুতের ধাপগুলো অনুসরণ করে জমি প্রস্তুত করার পর গলদা চিংড়ির রেণু মজুদের ব্যবস্থা করতে হবে। সমন্বিত চিংড়ি চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়, তার মধ্যে নাসর্রী পুকুরে রেণু মজুদ ও এর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রেণু পর্যায়ে এর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশী। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চিংড়ির রেণু মজুদের পর ৩০-৪৫ দিন বেশেষভাবে যত্ন নিতে হবে, তাহলে পরবর্তিতে আর তেমন কোন ঝুঁকি থাকে না এবং রেণু মৃতু্হার হার খুব কম হয়। ফলে চাষী ভাই তার কাংখিত ফল পায়। আর তাই একজন চাষী ভাইকে গলদা চিংড়ির রেণু মজুদ করার নিয়ম এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে খুব ভালো করে জানতে হবে। এইজন্য গলদা চিংড়ির নার্সারী ব্যবস্থাপনার সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা হলোঃ
গলদা চিংড়ির নার্সারী ব্যবস্থাপনাঃ


গলদা নার্সারী কি ?

গলদা রেণু পোনাকে বলা হয় পোষ্ট লার্ভা বা পিএল। এই গলদা রেণুকে ছোট আকারের পুকুরে (জমির ভিতরে পৃথক জায়গায়) পরিকল্পিতভাবে লালন-পালন করে কিশোর চিংড়ি (জুভেনাইল বা ছাটি) উৎপন্ন করাকে গলদা নার্সারী বলে।

কেন নার্সারী করা প্রয়োজন ?

গলদা রেণুকে মানব শিশু সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মানব শিশুটির (অবুঝ) যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য যেমন আমরা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে থাকি যাতে সে বেড়ে উঠতে পারে সেরূপ রেণুর ক্ষেত্রেও বেশেষ যত্নের প্রয়োজন। কারণ রেণু পর্যায়ে এরা থাকে দুর্বল এবং অসহায়। তার উপর পরিবহনের ফলে সে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। তা'ছাড়া রেণু পর্যায়ে সাপ, ব্যাঙ, হাঁসপোকা, রাক্ষুসে মাছ ইত্যাদির হাত থেকে বাঁচার ক্ষমতা তার থাকে না। সে কারনে অপরিকল্পিতভাবে অনেক বড় জায়গায় রেণু মজুদ করলে ৫০-৬০ ভাগ রেণূ মরে যেতে পারে বলে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। তাই রেণু মজুদের গুরুত্বপূর্ণ এবং এত রেণুর মৃতু্যহার অনেকাংশে কমে যায়।

গলদা চিংড়ির নার্সারী ব্যবস্থাপনার ধাপঃ

ক. মজুদ পূর্ব ব্যবস্থাপনাঃ
নার্সারীর আকারঃ
নার্সারী পুকুরের আকার ৫-১০ শতাংশের মধ্যে হওয়া ভালো। এক্ষেত্রে ধান ক্ষেতের ১ টি ক্যানেল বা গর্ত ব্যবহার করা যেতে পারে।

গভীরতাঃ
নার্সারী পুকুরের গভীরতা ৩-৪ ফুট এর মধ্যে হলে ভালো কারণ এতে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে ও অঙ্জনের ঘাটতি থাকে না।

নার্সারী পুকুরের তলদেশ শুকানোঃ
গলদা চিংড়ির নাসর্ারীর ক্ষেত্রে পানি অপসারণ করে পুকুরের তলদেশ ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে এবং আগাছা দূর করতে হবে।

চুন প্রয়োগঃ শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। পুকুর শুকালে চুন গুড়া করে সরাসরি এবং পানি থাকলে পানিতে গুলিয়ে ছিটাতে হবে।

প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরীঃ চুন প্রয়োগের ৩-৫ দিন পরে শুধুমাত্র গোবর প্রতি শতাংশে ৩-৫ কেজি পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে।

জলজ পোকামাকড় দমনঃ জলজ পোকা যেমনঃ হাঁস পোকা ছোট রেণুর ক্ষতি করে। তাই রেণু ছাড়ার আগের দিন প্রতি শতাংশে ১২৫ মি.লি. ডিজেল বা কেরোসিন পানির উপর ছড়িয়ে দিলে ৪-৬ ঘন্টার মধ্যে হাঁস পোকা সহ অন্যান্য পোকা মারা যায়। পরে চট জাল বা কাপড় দিয়ে কেরোসিনসহ পোঁকা তুলে ফেলতে হবে। পোকা মাকড় দমনের ক্ষেত্রে কোন কীটনাশক অবশ্যই ব্যবহার করা যাবে না।

চিংড়ির আশ্রয়স্থল স্থাপনঃ
চিংড়ির নার্সারীতে আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করতে হবে।রেণু বাঁচার হার অনেকাংশে নির্ভর করে নার্সারীতে স্থাপিত আশ্রয়স্থলের উপর। চিংড়ির বৃদ্ধি খোলস বদলানোর মাধ্যমে হয়ে থাকে। খোলস বদলানোর সময় চিংড়ি দুর্বল থাকে। চিংড়ির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এরা স্বজাতিভোজী। সব চিঙড়ি একসাথে খোলস বদলায় না। তাই এ সময় সবল চিংড়ি অর্থাৎ যেগুলো খোলস বদলায় না সেগুলো দুর্বল গুলোকে খেয়ে ফেলে। কাজেই এসময় দুর্বল চিংড়ির জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল প্রয়োজন হয়। তাই পোণা মজুদের পূর্বে পুকুরে চিংড়ির জন্য আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আশ্রয়স্থল হিসেবে শুকনো বাঁশের শাখা-প্রশাখাসহ (ঝংলা) উপরের অংশ খুবই উপযোগী। প্রতি শতকে ১-২ টি করে বাঁশের ঝিংলা (বাঁশের শাখা প্রশাখাসহ উপরের অংশ) বা শুকানো ডাল পানিতে ডুবন্ত রাখতে হবে।

আশ্রয় ছাউনী তৈরীঃ
নার্সারী পুকুরের পানি যাতে অতিরিক্ত গরম হয়ে না যায় কিংবা পানি গরম হয়ে গেলে চিংড়ির রেণু ঠান্ডা জায়গায় আশ্রয় নিতে পারে সেজন্য নার্সারী পুকুরের উপরে অর্ধেকাংশে নারিকেল পাতা দিয়ে মাচার আকারে ছাউনী দিতে হবে।

খ. মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা-


মজুদ ঘনত্বঃ
প্রতি শতাংশে ৫০০-৬০০ টি গলদা রেণু মজুদ করা যেতে পারে। যদি নার্সারীতে ১৫-২০ দিন রেণু লালনের পরিকল্পনা থাকে সে ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ১০০০-২০০০ রেণু মজুদ করা যেতে পারে।
রেণু ছাড়ার সময়ঃ
গলদা চিংড়ির পোনা অবশ্যই সন্ধ্যার পর মজুদ করতে হবে। তবে রাত ৮/৯টার মধ্যে মজুদ করা সবচেয়ে ভালো কারন দিনের বেলায় পানির তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যায় ফলে রেণু তার শরীরে তা অভ্যস্ত করাতে পারে না। ফলে রেণু মারা যায়। কিন্তু রাত্রে পানির তাপমাত্রা খুব ধীর গতিতে কমতে থাকে। যা রেণুর জন্য তেমন অসুবিধা হয় না। তাই রেণু রাত্রেই ছাড়া উত্তম। রাতে রেণু ছাড়ার মাধ্যমে ভালো ফল পাওয়া যায় যা কৃষকের মাঠে ১০০ ভাগ পরীক্ষিত।
পোনা অভ্যস্তকরণঃ
রেণুকে অবশ্যই পুকুরের পানির সাথে অভ্যস্ত করে ছাড়তে হবে। পাতিল / ব্যাগের পানির তাপমাত্রা ঐ পুকুরের পানির তাপমাত্রার সমতায় না আসা পর্যন্ত অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে। পাত্রের পানি আস্তে আস্তে পরিবর্তন করে পোণাসহ পাত্রটি কাত করলে রেণু স্বেচ্ছায় পানিতে বেরিয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়া ২০-৩০ মিনিট পর্যন্ত চলতে পারে। রেণু পানিতে ছাড়ার ক্ষেত্রে কোনভাবেই তাড়াহুড়া করবেন না, পর্যাপ্ত তাপমাত্রা সঙ্গে রেণুকে খাপ খাওয়াতে হবে। কারণ রেণু বহন পাত্রে ও নার্সারী পুকুরর পানির তাপমাত্রার সমান্য পার্থক্যই রেণুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই ছাড়ার সময় রেণু খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়াকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।

মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা-

সম্পুরক খাদ্য প্রয়োগঃ গলদা চিংড়ি প্রাকৃতিক খাদ্যের উপর নির্ভর করে না। তাই তাকে প্রতিদিন পম্পুরক খাদ্য দিতে হবে। পোণা মজুদের পর প্রথম ৭ দিন প্রতি ৫০০০ রেণুর জন্য একমুঠ সুজি প্রতিদিন একবার সন্ধ্যায় দিতে হবে। কারণ চিংড়ি সাধারণত রাতেই আহার করে থাকে।

পরবর্তী ২য় ও ৩য় সপ্তাহের জন্য- ১ কেজির তৈরীতে-
মাছের গুড়া / মাংসের গুড়া ৪০% ⇒৪০০ গ্রাম
খৈল (সরিষা / সয়াবিন) ৪০% ⇒৪০০ গ্রাম
চিটাগুড় ১০% ⇒১০০ গ্রাম
এবং গমের আটা ১০% ⇒১০০ গ্রাম
উপরোক্ত পরিমাণে বিভিন্ন উপাদন একত্রে মিশিয়ে কাই তৈরী করে ডিমের আকারে বল তৈরী করে নিতে হবে।
প্রতিটি ডিম আকরের বল প্রতিহাজর রেণুর জন্য সন্থ্যায় দিতে হবে। প্রতিটি বল আবার চারটি ছোট বল তৈরী করে যেখানে ঝোঁপঝাড় দেয়া হয়েছে সেখানে দিতে হবে। পরবর্তী সপ্তাহ গুলোতে এই খাবারের পরিমাণ ২০% হারে বাড়াতে হবে।

রেণু বেঁচে থাকা পর্যবেক্ষণঃ
রেণু বা পিএল ছাড়ার পরদিন পুকুরে গামছা বা মশারীর জালের খন্ড দিয়ে পুকুরের এক কোণায় টেনে রেণুর অবস্থা দেখতে হবে, যদি প্রতি চানে ৪/৫ করে রেণু আসে তবে বুঝতে হবে বাঁচার হার খুবই ভালো। কৃষক অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, নার্সরী পুকুরে রেণু ছাড়ার পর দুইদিন টিকে গেলে পরবর্তীতে আর তেমন ঝুঁকি থাকে না।
স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণঃ রেণূর স্বাস্থ্য ভালো আছে কিনা এবং স্বাস্থ্য বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা পরীক্ষা করতে হবে। পুকুরে গামছা বা মশারীর জালের খন্ড দিয়ে টেনে রেণুর অবস্থা দেখতে হবে, যদি রেনু গুলো খুব দ্রুত নড়াচড়া করে তবে বুঝতে হবেরেণুর স্বাস্থ্য ভাল আছে।
এভাবে ৩০-৪৫ দিনে নার্সারীতে রেণু লালন পালনের পর বড় পুকুরে/ধানক্ষেতে মজুদ করতে হবে।
গলদা রেণু চাষের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়ঃ

♣ সন্ধ্যার পর রেণু মজুদ করা।
♣ নার্সারীতে ঝোঁপঝাড় (ঝিংলা) দেয়া।
♣ নিয়মিত সন্ধ্যার পর খাবার দেয়া।
♣ রেণু বেঁচে থাকা পর্যবেক্ষণ করা।
♣ নার্সরী পুকুরের যে কোন একপার্শ্বের ছায়ার ব্যবস্থা করা।

হাঁপাতে গলদা চিংড়ির রেণু লালন পালন বা হাঁপা নার্সারী

গলদা চিংড়ির রেণু লালন পালনের জন্য আরো একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তাহলো হাঁপা নার্সরী। হাঁপা নার্সরীর যে কোন পরিস্কার পুকুরেই স্থাপন করা যেতে পারে। অর্থাৎ ছোট নার্সারী পুকুর বা পকেট ঘের (ধান ক্ষেতের একটি ক্যানেল বা খাল) এর সুবিধা না থাকলে এ পদ্ধদিতে গলদা রেণু লালন পালন করে মজুদ পুকুর বা ধানক্ষেতে ছাড়া যেতে পারে।
হাপাঁ নার্সারীর প্রয়োজনীয় উপকরণঃ
প্লাষ্টিক ফিল্টার নেট, নাইলন সুতা, বাঁশ, টিনের প্লেট, ঘরে তৈরী সম্পুরক খাবার, নারিকেলের/খেজুরের শুকনো ডাল-পাতাসহ অথবা বাঁশের আগালী (ঝিংলা)।

পদ্ধতিঃ
সুক্ষ্ম ফাঁসের প্লাষ্টিকের নেট দিয়ে হাঁপা তৈরী করতে হবে। হাঁপার আয়তন ২ মিঃ ২ মিঃ ১.৫০ মিঃ। এই আয়তন কম-বেশী করা যেতে পারে। এই হাঁপা যে কোন পরিস্কার পুকুরে বাঁশের খুটি দিয়ে স্থাপন করতে হবে। হাঁপা নার্সারীর জন্য ঐ পুকুরে চুন, সার দেওয়ার প্রয়োজন নাই হাঁপটি পানির তলদেশে মাটি থেকে একহাত উঁচুতে স্থাপন করতে হবে এবং পানির উপরে একহাত থাকবে। গলদার রেণুর খাবার প্রয়োগের জন্য নাইলন সুতা দিয়ে টিনের প্লেট এমনভাবে ঝুলিয়ে দিতে হবে যাতে খাবারের প্লেট হাঁপার পানির মাঝ বরাবর থাকে। প্রতি হাঁপাতে ২-৪ টি প্লেট ব্যবহার করা যেতে পারে। খেজুরের শুকনো ডাল পাতাসহ প্রতিটি হাঁপাতে ২টি করে দিতে হবে। যাতে গলদার রেণুর আশ্রয়স্থলের কাজ করে এবং খেজুর পাতার ডাল সাত/আট দিন পর পর পরিবর্থন করতে হবে। এবং সাতনি পর পর হাঁপাটিকে পরিস্খার করতে হবে যেন পানিতে আটকানো শেওলা হাঁপাতে লেগে না থাকে।

খাবার প্রয়োগঃ
হাঁপাতে যে টিনের প্লেট স্থাপন করা হবে তাতে খাবার দিতে হবে প্রতিদিনে মোট খাবার প্রয়োগের চারভাগের তিভাগ সন্ধ্যায় এবং একভাগ ভোরে প্রয়োগ করতে হবে।

খাবারের উপাদানঃ


শুটকী মাছের / মাংসের গুড়া- ৪০%
সরিষার খৈল ৪০%
ময়দা / আটা- ২০%
উপকরণ তিনটি পানিতে মিশিয়ে ছোটবল আকারে তৈরী করতে হবে এবং এই বল রৌদ্রে ভালো কর শুকিয়ে নিতে হবে। প্রয়োগের সময় বলটি ভালো করে গুড়া কর টিনের প্লেটে দিতে হবে। এভাবে প্রতি হাজার রেণুর জন্য প্রথম সপ্তাহে ৬০ গ্রাঃ হারে, ২য় সপ্তাহে ৮০ গ্রাঃ হারে, ৩য় ও ৪র্থ সপ্তাহে ১০০ গ্রাঃ হারে দিতে হবে। ৫ম ও ৬ষ্ঠ সপ্তাহে ১২০ গ্রাঃ হারে খাবার প্রয়োদ করতে হবে। খাবার প্রয়োগের পরিমাণ টিনের প্লেটে খাবারের উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে কমানো বাড়ানো যেতে হবে।

মজুদের পরিমাণঃ
প্রতি বর্গমিটার জলায়তনে ১০০ থেকে ২০০ টি রেণু মজুদ করা যেতে পারে। মজুদের সময়কালঃ ৪০ থেকে ৪৫ দিন। হাঁপাতে লালন-পালন করে ধান ক্ষেতে বা মজুদ পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে।

সতর্কতাঃ

১. অনেক সময় দেখা যায় কাঁকড়া হাঁপার নেট কেটে দেয় তাই সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
২. যেহেতু হাঁপা দীর্ঘদিন পানিতে থাকে তাই হাঁপা তৈরীতে দ্রুত পচনশীল কোন কাপড় ব্যবহার করা যাবে না।

নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ
নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগঃ সমন্বিত চিংড়ি চাষের বিভিন্ন পদক্ষেপ / কার্যক্রমের মধ্যে নিয়মিত সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ অন্যান্য মাছের মত চিংড়ি পানি থেকে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাবার গ্রহণ করতে পারে না। তাই অল্প সময়ে চিংড়িকে বিক্রি উপযোগী করার জন্য নিয়মিত সম্পূরক খাদ্য অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে। নার্সরী পুকুর থেকে মূল জমিতে জুভেনাইল স্থানান্তরের পর থেকে চিংড়ি বিক্রির পূর্ব পর্যন্ত চিংড়িকে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, খাদ্য প্রয়োগ ছাড়া কোনভাবেই চিংড়ি চাষকে লাভজনক করা যায় না।
সম্পূরক খাদ্যঃ

সাধারনতঃ পানিতে সার বা গোবর প্রয়োগ করলে পানিতে প্রাকৃতিক খাবার (উদ্ভিদ কণা ও প্রাণী কণা) উৎপন্ন হয় যা সিলভার কার্প, কাতলা, রুই, জাতীয় মাছ গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু চিংড়ি এই সমস্ত খাবার খেতে অভ্যস্ত নয়। তাই এদের জন্য বাইরের থেকে খাবার অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে। বাইরের থেকে খাবার প্রয়োগ করাকেই সম্পূরক খাবার বলে।
চিংড়ির জন্য সম্পূরক খাদ্যঃ

চিংড়িকে খাওয়ানোর জন্য বাজারের বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত খাদ্য কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই খাদ্যগুলোর দাম অনেক বেশী। যেহেতু চিংড়িকে নিয়মিত খাদ্য দিতে হয় আর একজন চাষী যদি বাজার থেকে চিংড়ি খাবার কিনে খাওয়াতে চান তবে, চাষাবাদ খরচ অনেক বেড়ে যাবে। ফলে চাষীর লাভের পরিমাণ কমে যাবে। তাই বাজার থেকে খাদ্য না কিনে সহজ পদ্ধতিতে বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে বাড়িতে খাদ্য তৈরী করে চিংড়িকে খাওয়ানোই উত্তম। এতে যেমন খাদ্যের পুষ্টিমাণ নিশি্টত থাকবে তেমনি খরচও কম (৫০%) হবে। বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন পরিমাণে মিশিয়ে চিংড়ির খাদ্য তৈরী করা যায়। তবে উপাদানের সহজ প্রাপ্যতা ও খাদ্যের পুষ্টিগুণ বিবেচনা করে চিংড়ির জন্য সম্পূরক খাদ্য তৈরীর ৩টি নিয়ম এখানে উল্লেখ করা হলোঃ

নিয়মঃ ১

উপাদানের নাম পরিমাণ
মাংস/শুটকী মাছের গুড়া ২৫%
খৈল (সরিষা/সয়াবিন) ২৫%
চাউলের কুঁড়া ২০%
আটা ২৫%
শাক-সব্জি ৫%
মোট ১০০%
নিয়মঃ ২
উপাদানের নাম পরিমাণ
মাংস/শুটকী মাছের গুড়া ২৫%
খৈল (সরিষা/সয়াবিন) ২৫%
চাউলের কুঁড়া ২০%
আটা ১৫%
ভুঁষি ১০%
শাক-সব্জি ৫%
মোট ১০০%
নিয়মঃ ৩
ক্রমিক নং উপাদানের নাম পরিমাণ
১. খৈল (সরিষা/সয়াবিন) ৪০%
২. আটা/ ময়দা ১০%
৩. চাউলের কুঁড়া ৪০%
৪. চিটা গুড় ১০%

মোট ১০০%
উপরোক্ত ছকে উল্লেখিত প্রথম নিয়ম অনুসরণ করে যদি ১ কেজি খাদ্য তৈরী করা হয় তবে মাংসের /শুটকি মাছের গুড়া, খৈল ও আটা ? ময়দা সমান পরিমাণ অর্থাৎ ২৫০ গ্রাম ও ৫০ গ্রাম মিলিয়ে ১০০০ গ্রাম পূরণ করতে হবে। যদি বেশী পরিমাণ খাবার একসাথে তৈরী করা হয় তবে এভাবে সহজেই বিভিন্ন উপাদানের পরিমাণ বের করা যাবে।
খাদ্য প্রস্তুত প্রণালীঃ

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, খাদ্য উপাদানের মাধ্যমে বাড়িতে তৈরী করা উত্তম। ছকে উল্লেখিত বিভিন্ন উপাদানের পরিমাণ ম্বলিত ৩টি নিয়মের যে কোন একটি বাছাই করে সে মোতাবেক উপাদানগুলো সংগ্রহ করতে হবে।

তারপর নিম্নোক্ত উপায়ে খাদ্য প্রস্তুত করতে হবে-

♣ খৈলগুলোকে খাবার তৈরীর একদিন আগে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
♣ শাকসব্জিগুলোকে একটু হালকা সিদ্ধ করে নিতে হবে।
♣ এবার সবগুলো উপাদান (মাংস / মাছের গুড়া, খৈল, চালের কুঁড়া, আটা, ভূষি, শাক-সব্জি) একত্রে মিশিয়ে ঠিক রুটি বানানোর কাঁই এর মত তৈরী করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন পানির পরিমাণ বেশী না হয়ে যায়।
♣ এবার মেশিন বা ছিদ্রযুক্ত টিনের থালার মাধ্যমে কাইগুলো দিয়ে সেমাই এর মত রৈী করে ১ ঘন্টা সূর্যের আলোতে শুকিয়ে নিতে হবে।
♣ শুকানোর পর এই পিলেটগুলোকে (সেমাইয়ের মত) হাত দিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে প্লাষ্টিক জার (বয়াম) টিন বা প্লাষ্টিকের বস্তায় ভরে প্রয়োজন মত চিংড়িকে খাওয়ানো যাবে। প্রতিবার প্রস্তুতকৃত খাদ্য ১৫-২০ দিনের মধ্যে চিংড়িকে খাইয়ে ফেলাই উত্তম। অর্থাৎ প্রতিবার ১৫-২০ দিনের আন্দাজে খাদ্য তৈরী করতে হবে। এতে খাদ্যের পুষ্টিগুণ অটুট থাকবে।

খাদ্য প্রয়োগ পরিমাণঃ

চিংড়িকে তার প্রয়োজন মত খাবার দিতে হবে। কম দিলে চিংড়ির শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে এবং বেশী দিলে অপচয় হবে। যেহেতু চিংড়ি দিন দিন শারীরিকভাবে বড় হবে সেহেতু দিন দিন তার খাবারের পরিমাণও বাড়াতে হবে। আর এই কারণে খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ নির্ধারণ করা অনেকে জটিল মনে করে। কিন্তু সহজে এর পরিমাণ র্নিধারণ করা যায়। আকেটি চিংড়ির ওজন যত তার ৫% বা ৫ ভাগ খাবার তাকে দিতে হবে। অর্থাৎ যদি একটি চিংড়ির ওজন ১০০ গ্রাম হয় তবে পরিমাণ হবে ৫ গ্রাম। এভাবে হিসাব করে জমিতে আন্দাপ অনুযায়ী যতগুলো চিংড়ি আছে তাদের অদ্যের পরিমাণ নির্ধারন করে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। তাই মাঝে মাঝে চিংড়ি তুলে আন্দাপ করতে হবে। মজুদের ৮০% বাঁচার হার ধরে খাদ্য দিতে হবে।
৪-৫ টি চিংড়ির ওজন নিয়েই বুঝতে হবে গড়ে প্রতিটি চচংড়ির ওজন কত হবে এবং জমিতে কি পরিমাণ চিংড়ি আছে তা আন্দাজ করে মোট ওজন কত হবে। সে অনুযায়ী খাবার দিতে হবে।
প্রয়োগের সময়ঃ

সাধারণতঃ চিংড়ি নিশাচর প্রাণী এবং দিনের বেলা থেকে রাতেই চিংড়ি বেশী খাবার গ্রহণ করে। তাই খাদ্যের অপচয় কমানোর জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে চিংড়িকে খাদ্য দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিদিন সন্ধ্যায় একবার খাদ্য চিংড়ি চাষের জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
প্রয়োগের স্থানঃ

সমন্বিত চিংড়ি চাষের জমির ক্যানেলে যেখানে ঝোঁপঝাড় (ঝিংলা) রাখা আছে সে জায়গাগুলোতে চিংড়ি চলাচল বেশী। তাই খাদ্য প্রয়োগের সময় এ স্থানগুলোতেই ছিটিয়ে দিতে হবে।
চিংড়ির আশ্রয়স্থল তৈরী করাঃ

গলদা চিংড়ির বৃদ্ধি খোলস পরিবর্তনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। সকল চিংড়ি একই সময়ে খোলস পরিবর্তন করে না। খোলস পাল্টানোর পর দুই ঘন্টা পর্যন্ত চিংড়ি দুর্বল থাকে চিংড়ির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এরা স্বজাতীভোজী তাই এ সময়ে সবল চিংড়ি অর্থাৎ যেগুলো খোলস বদলায় না সেযুলো দুর্বল গুলোকে খেয়ে ফেলে। কাজেই এ সময় দুর্বল চিংড়ির জন্য নিরাপদ আশ্রয় স্থলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আশ্রয়স্থল হিসেবে শুকনা বাঁশের শাখা-প্রশাখাসহ (ঝংলা) উপরের অংশ খুবই উপযোগী। প্রতি শতাংশে ১-২ টি করে বাঁশের ঝিংলা বা শুকনো ডাল পানিতে ডুবন্ত রাখতে হবে। চিংড়ির বাঁচার হার অনেকাং শে নির্ভর করে আশ্রয়স্থলের উপর। তাই চিংড়ির জন্য আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা অতীব জরুরী।

চিংড়ির সাথে অন্যান্য মাছের মিশ্রচাষ

মিশ্রচাষ কিঃ

একই জমিতে একই সময়ে একাধিক ফসল একসাথে উৎপন্ন করা যায় এবং একটি ফসল অন্যটির জন্য ক্ষতিকর নয় বরং সহায়ক তাই মিশ্র চাষ।

মিশ্রচাষের উপকারিতাঃ

একটি জমি থেকে একই সময়ে একাধিক ফসল পাওয়া যায়।
১. জমির সর্বেচ্চ ব্যবহার হয়।
২. একটি আরেকটি থেকে সুবিধা পায়।
৩. অর্থনৈতিকভাবে কৃষক লাভবান হয়।
৪. মাটি ও পানির পরিবেশ ভালো থাকে।

কেন মিশ্রচাষঃ

চিংড়ির সাথে অন্যান্য কার্পজাতীয় মাছের চাষ করা চিংড়ির জন্য ভারো। কারণ ধান ক্ষেত বা পুকুর যেখানেরই চিংড়ির চাষ করা হউক না কেন সেখানে কিছু প্রাকৃতিক খাদ্য (সবুজ উদ্ভিদ ও প্রাণী কণা) জন্ম নেয় যা চিংড়ি খায় না। বরং এসব উদ্ভিদ কণিকা রাত্রে পানি থেকে অকিসজেন গ্রহণ করে ফলে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। যা চিংড়ির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অনেক সময় চিংড়ি ব্যাপক হারে মারা যায়। তাই চিংড়ির সাথে কিছু সিলভার কার্প, কাতলা বা বিগহেড জাতীয় মাছ ছাড়লে এরা এই প্রাকৃতিক খাদ্য খেয়ে অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং এরা চিংড়ির সম্পূরক খাবারে ভাগ বসায় না। এরা এসব প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে চিংড়িকে বসবাসের উপযোগী করে তুলে। তাছাড়া আরা জানি চিংড়ি পানির নীচের অংশে থাকে এবং সিলভার কার্প, বিগহেড ও কাতলা মাছ পানির উপরে অংশে থাকে তাই চিংড়ির সাথে খাদ্য, আশ্রয় ইত্যাদির কোন প্রতিযোগিতা হয় না।

চিংড়ির সাথে অন্যান্য কার্প জাতীয় মাছের হিসাবঃ


নিম্নে প্রতি শতাংশ জলায়তনে চিংড়ি ও কার্প জাতীয় মাছের মজুদ ঘনত্ব বর্ণিত হলোঃ

ক্রমিক নং মাছের নাম পরিমাণ
১. গলদা জুভেনাইল (ছাটি) ৫০-৬০টি
২. সিলভার, বিগহেড, কাতলা ১০-১২ টি
চিংড়ির সাথে এই মাছগুলো ছাড়া অন্যান্য মাছ দেয়া যাবে না। কারণ সেগুলো চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর।
আইলে শাক-সব্জি চাষ

শাক-সব্জি চাষের গুরুত্বঃ

আইল হলো জমির একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ যা সাধারণতঃ পতিত ফেলে রাখা হয় ফলে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চি হয় না। সমন্বিত চিংড়ি চাষের বিভিন্ন ফসলের মধ্যে আইলে উৎপাদিত শাক-সব্জি অন্যতম।
আইলে শাক-সব্জি চাষ করলে কৃষক অর্থনৈতিকভবে লাভবান হতে পারে এবং ঝুঁকি কমে যায়। ফলে তাকে দু'শ্চিন্তাগ্রস্থ হতে হয় না। কারণ একটি ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হলেও অন্যটি দিয়ে পুষিয়ে নেয়া যায়। আইলে লতা জাতীয় গাছ যেমন- মিষ্টি কুমড়া, লাউ, শিম, চালকুমড়া, শশা, ঝিংগা, চিচিংগা, বাঙ্গি ইত্যাদি চাষ করলে পারিবারিক চাহিদা জূরণ করা যায় এবং বিক্রি করে ল্ভবান হওয়া যায়। তাছাড়া এসব লতা জাতীয় গাছ পানির উপর মাচা করে চাষ করলে প্রচন্ড রৌদ্রে পানি সহজে গরম হয় না। ফলে চিংড়ির মৃতু্যর ঝুঁকি কমে যায়। তাছাড়া মাচা থাকার কারণে চুরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। মাচা জাতীয় গাছের পাশাপাশি ঢেঁড়শ, পুঁইশাক, লালশাক, গিমা কলমী, চমেটো, মূলা, গাজর, ওলকপি, ডাটা, পেঁপে, বেগুন ইত্যাদ শাক-সব্জি চাষ করাও অধিক লাভজনক, এগুলি আইলের মাটিকে ক্ষয়রোধ থেকে সহায়তা করে। আগাছা হতে দেয় না। সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি আশ্রয় নিতে পারে না।
এছাড়া কিছু কিছু সব্জি যেমনঃ গিমা কলমী সিদ্ধ করে চিংড়ির খাবারের সাথে মিশিয়ে চিংড়ির খাবার তৈরী করা যায় যা গুণগতমান সম্পন্ন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সমন্বিত চাষাবাদ ব্যবস্থায় যে ফসলগুলো নির্বাচন করা হয় সেগুলো একটি অপরটির জন্য উপকারী। তাছাড়া সমন্বিত চাষের মাধ্যমে জমিকে পরিকল্পিতভাবে সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে টাকার খনিতে রূপান্তরিত হয়।

গলদা চিংড়ির নমুনা পর্যবেক্ষণ

নমুনা পর্যবেক্ষণ কি?

একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর গলদা চিংড়ির বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি পরীক্ষা করার জন্য নমুনা হিসেবে কয়েকটি চিংড়ি ধরে পর্যবেক্ষণ করা বা দেখাই হচ্ছে নমুনা পর্যবেক্ষণ।

নমুনা পর্যবেক্ষণ কেন করা প্রয়োজন ?

১. শারীরিক বৃদ্ধি হচ্ছে কি-না তার জন্য নমুনা পর্যবেক্ষণ করা অতীব জরুরী।
২. চিংড়ি রোগাক্রান্ত হচ্ছে কি-না তা দেখার নমুনা পর্যবেক্ষণ।
৩. খাবার প্রায়োগের জন্য নমুনা পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।

নমুনা পর্যবেক্ষণ কিভাবে করা যায় ?

১. ১৫ দিন পর পর ঝাঁকি জাল দিয়ে ৫-১০টি চিংড়ি ধরতে হবে।
২. চিংড়িগুলোকে একত্র করে ওজন নিয়ে গড় ওজন বের করতে হবে এবং তা লিখে রাখতে হবে।
৩. পরবর্তী ১৫ দিন পর ওজন নিয়ে আগের ওজনের পার্থক্য দেখে ওজন বৃদ্ধি পরীক্ষা করতে হবে।
৪. নমুনায়িত চিংড়ি-গুলির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। চিংড়ির এন্টেনা (দাঁড়ি গোঁফ), রোষ্ট্রেম (করাত), লেজ, ফুলকা এবং সাতার পাঁ অঞ্চল ভালোভাবে দেখতে হবে। এসব এলাকা কালো হয়ে যাচ্ছে কিনা বা দাঁড়ি গোঁফ পচন ধরছে কিনা ইত্যাদি দেখতে হবে।
এভাবে ১৫ দিন অন্তর অন্তর নমুনা পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

গলদা চিংড়ি আহরণ ও বাজারজাতকরণ

গলদা চিংড়ি সাধারণতঃ
৮-১০ মাসের মধ্যেই বাজারজাতকরণ আকৃতিতে পৌছায়। সকল চিঙড়ি একই সময় বাজারজাত আকৃতিতে পৌছায় না। তাই ব্যবসায়িক দিক থেকে লাভবান হতে হলে যেগুলি বাজারজাতকরণের উপযোগী হয়েছে সেগুলো বাজারজাতকরণ করাই উত্তম এবং পর্যায়ক্রমে বাজারজাতকরণ করতে হবে। গলদা চিংড়ি যেহেতু রপ্তানীযোগ্য পণ্য তাই বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সর্তকতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

চিংড়ি আহরণের উপকরণঃ

চিংড়ি সাধারণতঃ বেড় জাল, ঝাঁকি জাল দিয়ে আহরণ করা হয়ে থাকে। তবে বৎসর শেষে পাম্প দিয়ে ড্রেন শুকিয়ে চিংড়ি আহরণ করা উত্তম।

আহরণের পর করণীয়ঃ

আহরণের পর দ্রুত বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে চিংড়ি আহরণ করার পর পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোবাবে ধুয়ে নিতে হবে এবং সেগুলো ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। স্থানীয় বাজারে এগুলো বাজারজাত করা যেতে পারে। তবে দূরে বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করে পরিবহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
বর্তমানে চিংড়ি বাজারজাতকরণ দুইভাবে করা যায়। মাথাসহ পদ্ধতি ও মাথা ছাড়া পদ্ধতি। তবে মাথা ছাড়ানোর ক্ষেত্রে ভালো অভিজ্ঞতা না থাকলে না ছাড়ানোই উত্তম।

চিংড়ির রোগ ব্যবস্থাপনা
সমন্বিত চিংড়ি চাষ বিষয়ক এই সহায়িকাটিতে উল্লেখিত জমি জ্রস্তুত, রেণু মজুদ, নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ ইত্যাদি বিভিন্ন পদক্ষেপসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনা গুরুত্ব সহকারে অনুসরণ করলে সাধারণত চিংড়ির রোগ বালাই হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। তথাপি যদি চিংড়ির রোগ বালাই দেখা দেয় তবে একজন চাষী ভাই যেন সে মূহুর্তে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে সেটা বিবেচনা করে নিম্নে রোগ বালাই ও প্রতিকার সম্বন্ধে আলোচনা করা হলোঃ

রোগ হচ্ছে এমন এক অস্বাভাবিক অবস্থ যা কতিপয় লক্ষণ দ্বারা বুঝা যায়। চিংড়ি একটি খোলস বিশিষ্ট জলজ অমেরুদন্ডী প্রাণী এবং বিভিন্ন কারণে অনেক সময় পানিতে প্রতিকুল অবস্থায় তাকে বসবাস করতে হয়। তাই চিংড়ির রোগ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।


রোগ সৃষ্টির তিনটি প্রধান বিষয় হচ্ছেঃ
১. রোগ সৃষ্টিকারী জীব (প্যাথজেন)
২. পরিবেশিক প্রতিকুলতা এবং
৩. চিংড়ি / মাছ নিজে
চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য অমেরুদন্ডী প্রাণীদের চেয়ে কম, তাই চিংড়িতে রোগ বেশী হয়।


পরিবেশ ⇒ রোগ বালাই ⇔(চিংড়ি)⇔ রোগ সৃষ্টিকারী জীবানু


ঘেরের পরিবেশ যখন রোগ জীবাণুসহ ভারসাম্য অবস্থায় বসবাস করে তখন সাধারণতঃ চিংড়ির কোন রোগ বালাই হয় না। যদি কোন কারণে দুর্বল / পীড়িত হয়ে পড়ে তখন সহজেই রোহ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং পরবর্তীতে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঘেরের সার্বিক পরিবেশ ভালো থাকলে সাধারণতঃ চিংড়ির কোন রোগ বালাই হয় না।


একটি স্বাভাবিক রোগমুক্ত চিংড়ি দেখতে কি রকম দেখায় ?

♥ পাগুলি দেখতে পরিস্কার এবং সম্পূর্ণ।
♥ শরীর পরিস্কার এবং চকচকে ও সম্পূর্ণ।
♥ খোলস নরম নহে এবং সহজে ভেঙ্গে যাবে না।
♥ ফুলকা পরিস্কার এবং স্বাভাবিক রংয়ের।

রোগের সাধারণ লক্ষণঃ

মাসে একবার জাল টেনে মাছ ও চিংড়ির স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করে তাৎক্ষণিবভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। পুকুরে ঘন ঘন জাল টানা ঠিক না। পুকুরে একবার জাল টানলে মাছ ও চিংড়ির যে ক্ষতি হয় তা পূরণ করতে এক দুই দিন সময় লাগে।

রোগের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো নিম্নরূপঃ

♥ মাছ ও চিঙড়ির সাধারণ চলাফেরা বন্ধ হয়ে যায়।
♥ মাছ ও চিংড়ি পানির উপরে ভেসে খাবি খায়।
♥ চিংড়ি পানির উপরে চলে আসার চেষ্টা করে।
♥ ফুলকার স্বাভাবিক রং কালো হয়ে যায়।
♥ দেহের উপর লাল/কালো/সাদা দাহ পড়ে।
♥ চিংড়ির খোলসের উপর সবুজ শেওলার স্তর পড়ে।
♥ চিংড়ির হাটার অঙ্গ এবং এন্টেনা (দাঁড়ি) খসে পড়ে অথবা আঁকা বাঁকা হয়ে যায়।
♥ চিংড়ির খোলস নরম হয়ে যায়।
রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চিংড়ি ও মাছের বাহ্যিক অবস্থা এবং পুকুরের পরিবেশের প্রতি অত্যন্ত ভালোভাবে নজর রাখা উচিৎ।

গলদা চিংড়ির কয়েকটি সাধারণ রোগ

চিংড়ির নরম খোলস ও স্পঞ্জের মত দেহঃ


কারণঃ
পানিতে ক্যালসিয়াম কমে গেলে এ্যামুনিয়া ও তাপমাত্রা বেড়ে গেলে, পুষ্টিকর খাদ্য কমে হেলে এবং পানির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে গেলে এ রোগ হয়।

লক্ষণঃ
চিংড়ির খোলস নরম হয়ে যায়, উপর থেকে চাপ দিলে নীচে ডেবে যায়।

প্রতিকারঃ

♥ মজুদ ঘনত্ব কমিয়ে পুকুরে অন্তত ৫০% পানি বদল।
♥ পুকুরে প্রতি মাসে চুন প্রয়োগ। (প্রতি একরে ১৫-২০ কেজি ডলমাইট কৃষি চুণ)
♥ পুকুরে সার ও খাদ্য প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ।

মাথায় ও ফুলকায় কালো দাগঃ

কারণঃ
পুকুরে এ্যামুনিয়া ও লৌ হ বেড়ে গেলে এবং খাদ্যে ভিটামিন সি, ভিটামিন বি কমপ্লেঙ্ কমে গেলে চিংড়ি এ রোগে আক্রান্ত হয়।

লক্ষণঃ
মাথা, ফুলকা, লেজ, এবং উদর খন্ডেও কালো দাহ দেখা যায়।

প্রতিকারঃ

♥ মজুদ ঘনত্ব হ্রাস, পানি বদল (৩০-৫০%)।
♥ চুণ প্রয়োগ (০.৫ কিলো/শতাংশ/প্রতিমাসে।
♥ খাদ্যের সাথে ভিটামিন সি (০.০৩ মি.গ্রা./কেজি), ভিটামিন প্রিমিঙ্ (২৫ মিলি গ্রা./কেজি মিশিয়ে দেওয়া।

চিংড়ির কালো ফুলকা রোগ ও ফুলকা পচন রোগঃ

চিংড়ি যখন আহোনলযোগ্য আকার ধারণ করে তখন তাদের ফুলকার উপর ও নীচে কালো দাগ দেখা যায়। ফলে তাদের ফুলকা পঁচে যায় এবং শ্বাস প্রশ্বাস কষ্ট হয়। অবশেষে চিংড়ি মারা যায় এবং বাজারে চিংড়ির দাম কম হয়।

কারণঃ
পুকুরের তলদেশে অতিরিক্ত জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ কালো মাটি। মাটিতে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসের বিস্তৃ্ততি। ফ্যাংগাস এর উপস্থিতি।

লক্ষণঃ
ফুলকার রং কালো হয়ে যায় এবং ফুলকা পঁচে যায়।

প্রতিকারঃ

♥ পুকুরে পানি পরিবর্তন (৩০-৫০%)
♥ সম্ভব হলে আশ্রয়স্থল তুলেদিয়ে হররা টেনে গ্যাস অপসারণ করে দেয়া
♥ পুকুরে চিংড়ির ঘনত্ব কমিয়ে দেয়া। খাদ্য নিয়ন্ত্রন করা।

এন্টেনা পচন(দাঁড়ি মোচ পচনঃ)

কারণঃ জৈব পদার্থ (প্রাণী দেহ) পচনের ফলে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া, দূষিত ও বিষাক্ত গ্যাস (এ্যামুনিয়া, হইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস)।

লক্ষণঃ
এনটেনা পচে ক্রমে ক্রমে খাটো হয়ে যায়। এনটেনাতে গিট গিট সৃষ্টি হয়।

প্রতিকারঃ

♥ বড় চিংড়ি ধরে ঘনত্ব কমাতে হবে।
♥ পানি পরিবর্তন, নতুন পানি প্রবেশ।
♥ প্রতি মাসে ২০-২৫ কেজি/একর হারে ডলমাইট বাক্রৃষি চুন প্রয়োগ।
♥ শামুকের মাংস প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ। পিলেট জাতীয় খাদ্য প্রয়োগ।
♥ বিকলাঙ্গ রোগঃ

কারনঃ
এ রোগের প্রধান কারণ পুষ্টিহীনতা খাদ্যে পুষ্টিকাক দ্রব্যের ঘাটতি। খাদ্যে ট্রেচ ইলিমেন্টের অভাব।

লক্ষণঃ
অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেমনঃ পা, রোষ্ট্রাম বেঁকে যাওয়া।

প্রতিকারঃ

চিংড়ি ধরে ঘনত্ব কমানো।
প্রোটিন মিনারেল সমৃদ্ধ খাদ্য প্রয়োগ।

রোগ প্রতিরোধের সহজ পথগুলো হচ্ছে নিম্নরুপঃ

♥ পুকুর নিয়মিত শুকিয়ে পরিমিত মাত্রায় চুন প্রয়োগ।
♥ পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদা অপসারণ।
♥ পুকুরে নিয়মিত সার প্রয়োগ প্রাকৃতিক খাদ্যের যোগান স্থিতিবস্থায় রাখা। প্রয়োজনের বেশী সার প্রয়োগ থেকে চাষীকে বিরত রাখুন।
♥ কোন অবস্থাতেই অতিরিক্ত পোনা মজুদ না করা।
♥ পুকুরের তলায় আশ্রয়স্থল সৃষ্টি করা।
♥ কোন অবস্থাতেই বেশী পরিমাণ খাদ্য প্রয়োগ না করা।
♥ পুকুরে কোন ক্ষতিকর দ্রব্য না ফেলা।
♥ চিংড়ির বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যের পরিমাণ প্রয়োজন মত বাড়ানো। তাই প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি কিছু পরিমাণে সম্পুরক খাদ্য প্রয়োগ করা।
♥ পুকুর পাড়ে বড় ধরণের গাছ-পালা না রাখা এবং পুকুরে আলো বাতাস পড়ার সুযোগ থাকা।
♥ অল্প পরিমাণে জলজ গাছ থাকা।
♥ চিংড়ির সাথে অল্প পরিমাণে কাতলা, সিলভার কার্প ও প্রাস কার্প ছাড়া।
♥ পনির গভীরতা ৬০-১০০ সেন্টিমিটারে রাখা।

চিংড়ি সম্পর্কে কিছু ভুল ধারনা

সাধারণতঃ
কোন বিষয়ের গভীরে না ঢুকে অর্থাৎ বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনে উপর থেকে দেখেই আমরা অনেক সময় কিছু ভুল ধারণা নিয়ে বসে থাকি। তদ্রুপ গলদা চিংড়ি সম্পর্কেও আমাদের দেশের অনেক চাষী ভাইয়ের মধ্যে কিছু কিছু ভুল ধারণা কাজ করে। যা মাঠ পর্যায়ের চাষী ভাইদের সাথে আলোচনা করে বেরিয়ে এসেছে। গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত গলদা চিংড়ি সম্পর্কে এই সমস্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে চাষী ভাইদের সঠিক ও পরিস্কার ধারণা থাকার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করেই কিছু বিষয় তুলে ধরা হলোঃ

সমস্যা সমূহঃ

♥ পানিতে ভেসে উঠে / হাজল উঠা।
♥ সমস্ত চিংড়ি পানির এক কোণে এস উপস্থিত হয়।
♥ চিংড়ি হেঁটে হেঁটে চলে যায়।

উপরোক্ত র্দশ্যগুলো গ্রামাঞ্চলে অনেক চাষী ভাইদের মুখে মুখে প্রচলিত আছে যেমনঃ চিংড়ি হেঁটে হেঁটে চলে এবং এই জন্য কেউ কেউ চিংড়ির বড় দু'খানা পাও ভেঙ্গে দেন। কারণ হেঁটে নলে যাওয়া চিংড়ির বৈশিষ্ট্য নয়। বাস্তবতা হলো এই যে, কখনও কখনও দেখা যায় চিংড়িগুলো পানিতে থেকে পাড়ের দিকে চলে আসার চেষ্টা করছে বা পানি থেকে একটু উপরে মাটিতে উঠে গেছে। এক্ষেত্রে দোষটা চিংড়ির নয় বরং আমাদের। চিংড়ি সব সময়্ তারজন্য সহনশীল পরিস্কার পরিবেশ পছন্দ করে যা কিনা মানুষ হিসেবে আমরাও করি। আমরা যেমন কোন দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশে বেশীক্ষণ থাকতে পারি না তেমনি চিংড়িও তার থাকার অনুপযোগী কোন স্থানে থাকতে চায় না। আর তষনই বাতাস থেকে অক্সিজেন নেয়ার চেষ্টা করে এবং মনে হয় চিংড়ি পুকুর থেকে উঠে চলে যাচ্ছে।

কি কি কারণে এমনটি ঘটেঃ

♥ যদি কোন কারনে পানির অক্সিজেন কমে যায়।
♥ যদি কোন কারণে পানি অতিরিক্ত ঘোলাটে হয়ে যায়।
♥ যদি পানিতে কিছু পঁচে নষ্ট হয়ে যায়।
♥ কীটনাশক বা বিষ জাতীয় কিছু পানিতে মিশলে।

উপরের কারণগুলোর জন্যেই চিংড়ির ক্ষেত্রে উল্লেখিত সমস্যাগুলো ঘটে, তবে মূলতঃ অক্সিজেনে স্বল্পতাই এর জন্য দায়ী। পানিতে অন্যান্য সমস্যা না থাকলেও মেঘলা দিনে ঘোমট আবহাওয়া এমনিতেই পানিতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয় এবং তখনও "চিংড়ি পানিতে খাবি খাচ্ছে" (ভেসে উঠা) এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। মেঘলা দিনে এমনিতেই বাতাসের চাপ কম থাকে তার উপর প্রচলিত নিয়ম অনুসারে পানি নড়াচড়া করা হয় বা পানিতে ঢেউ সৃষ্টি করা হয় যার ফলে পানিতে অক্সিজেন বৃদ্ধির পরিবর্তে আরো কমে যায়। তাছাড়াও পানিতে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো পানি থেকে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন গ্রহণ করে ফলে চিংড়ির অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দেয়।

করণীয়ঃ

♥ শতাংশ প্রতি ২৫০ গ্রাঃ করে চুন প্রয়োগ, যা অন্যান্য উপকারীতার পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়াগুলোকে নিস্ক্রিয় করে দেয় ফলে ব্যাকটেরিয়াগুলো পানি থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে না।
♥ মেঘলা দিনের ঘোমট আবহাওয়ার সময় পানিতে কখনও ঢেউ সৃষ্টি করা যাবে না।
♥ অতিরিক্ত খাদ্য পানিতে পঁচে পানি নষ্ট করবে এমন কিছু পানিতে ফেলা যাবে না।
♥ সম্বনিত চিংড়ি চাষের জমিতে (ধান বা সব্জিতে) কীটনাশক বা বিষ জাতীয় কিছু প্রয়োগ করা যাবে না। আর ধানক্ষেতে মাছ বা চিংড়ি থাকলে বিষ প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না যা মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষিতভাবে প্রমাণিত।