Wednesday, 25 May 2011

অধিক ধান উৎপাদনে এলসিসির কার্যকারিতা

অধিক ধান উৎপাদনে এলসিসির কার্যকারিতা

যৌক্তিকভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে মাটির ¯স্বাস্থ্য সংরৰণপূর্বক কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি বর্তমান সময়ে একান্ত অপরিহার্য। কারণ ক্রমশবর্ধিষ্ণু জনগণের বর্ধিত খাদ্য চাহিদা মেটাতে একদিকে যেমন ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়েছে ও অন্যদিকে কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়া সার বেশি মাত্রায় প্রয়োগের বিশেষ প্রবণতা লৰ করা যাচ্ছে। ইউরিয়া সারের যথার্থ প্রয়োগে ইউরিয়া সাশ্রয়ের জন্য সামপ্রতিককালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত এলসিসি এক মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। এলসিসি হলো পাতার সবুজ রঙের বিভিন্ন মাত্রার গাঢ়ত্ব মাপার পৱাস্টিকের তৈরি ছোট স্কেল। এ স্কেলে সবুজ রঙের বিভিন্ন গাঢ়ত্বের ৪টি তালিকা রয়েছে যা দিয়ে ধানের পাতার সবুজ রঙের সামঞ্জস্য বিশেৱষণ করে জমিতে ইউরিয়া সারের প্রয়োগ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ধান গাছের পাতার সবুজ রঙের গাঢ়ত্ব নির্ভর করে মূলত নাইট্রোজেন প্রাপ্তির ওপর। গাছ যদি মাটি থেকে প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন না পায় তাহলে গাছের পাতা হলুদাভ হয়ে যায়। এ কারণে জমিতে নাইট্রোজেনের যোগান দিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। এলসিসি স্কেলের মাধ্যমে ধানের সবুজ পাতার গাঢ়ত্ব নির্ণয়  করে জমিতে চাহিদা অনুযায়ী ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হলে সঠিকভাবে জমিতে নাইট্রোজেন  পুষ্টি উপাদান যোগ হয়। এলসিসি সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে ইউরিয়ার অপচয় বহুলাংশে হ্রাস করা যায় এবং ফলন বাড়ে অধিক হারে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহায়তায় ইতোমধ্যে  বাংলাদেশে এলসিসি ব্যবহার আরম্ভ হয়েছে। কৃষকদের মাঝে এর ব্যবহার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধ পাচ্ছে। কারণ এর ব্যবহারে কৃষকগণ ইউরিয়া প্রয়োগে সাশ্রয়ী হচ্ছেন এবং ফলন পাচ্ছেন অধিকহারে। সমপ্রতি (ওজজও) বাংলাদেশ ও ডিএই’র যৌথ গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, কৃষক পর্যায়ে এলসিসি ব্যবহার করে হেক্টরপ্রতি ৯০ কেজি ইউরিয়া (৫২%) সাশ্রয় করেছেন এবং ফলন বেড়েছে গড়ে শতকরা ১১ ভাগ। এছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহারে মাটিতে পটাশের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে এবং ব্যাক্টেরিয়াল বৱাইট রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। ইউরিয়া সাশ্রয়ী ও পরিবেশ বান্ধব এই প্রযুক্তিটি কৃষক পর্যায়ে এখনও জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। এর মুল কারণ এলসিসি প্রাপ্তির অভাব। তবে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর ২০০৭-২০০৮ সালে ১ লাখ ৮০ হাজার এলসিসি ফিলিপাইন থেকে আমদানি করে কৃষক পর্যায়ে বিতরণ করছে এবং ২০০৯-২০১১ সাল নাগাদ আরো ৩ লাখ এলসিসি কৃষক পর্যায়ে বিতরণের ও এলসিসি ব্যবহার বিষয়ক প্রশিৰণের একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।  এলসিসি ব্যবহার বিধি
ধাপ-১: পাতার রঙ মাপার সময়
* আমন মৌসুমে, রোপা ধানে রোপণের ১৫ দিন  ও বোরো ধানে পাতা বের হওয়ার ১৫ দিন পর থেকে ধান গাছের থোড় অবস্থা পর্যন্ত প্রতি ১০ দিন পর পর এলসিসি দিয়ে ধান গাছের পাতার রঙ মাপুন।
* বোরো মৌসুমে, রোপা ধানে রোপণের ২১ দিন ও বোনা ধানে পাতা বের হওয়ার ২৫ দিন পর থেকে ধান গাছের থোড় অবস্থা পর্যন্ত প্রতি ১০ দিন পর পর এলসিসি দিয়ে ধান গাছের পাতার রঙ মাপুন। 
ধাপ-২ : গোছা বাছাই 
* প্রতিবার পাতার রঙ মাপার সময় জমির বিভিন্ন জায়গা থেকে ১০টি সুস্থ সবল ধানের গোছা বেছে নিন।
 * লৰ রাখবেন বেছে নেয়া গোছাগুলোর চারপাশের গোছাগুলো যেন বিদ্যমান থাকে। 
ধাপ-৩ : পাতার রঙ মাপা ও এলসিসি পরিমাপক নম্বর  নির্ণয় 
* বেছে নেয়া প্রতিটি গোছায় পুরোপুরি বের হওয়া সবচেয়ে উপরের পাতাটির মাঝের অংশ এলসিসির  উপরে রাখুন।
* এবার পাতার রঙের সাথে এলসিসির রঙ মিলান। 
* এলসিসর যে রঙের সাথে পাতার রঙ মিলবে সে রঙের নিচের নম্বরটির এলসিসি মাপক নম্বর| 
* তবে পাতার রঙ এলসিসির দুটি পাশাপাশি রঙের মাঝামাঝি রঙের সাথে মিলছে বলে মনে হলে রঙ দুটির নম্বরটির গড় হবে এলসিসি মাপক নম্বর
* এভাবে বেছে নেয়া দশটি গোছার পাতার রঙ এলসিসির রঙের সাথে মিলিয়ে দশটি এলসিসি মাপক নম্বর পাবেন। 
* পাতার রঙ মিলানোর সময় পাতাটি গাছ থেকে ছিঁড়বেন না। 
* পাতার রঙ মিলানোর  সময় শরীর দিয়ে সূর্যের  আলো আড়াল করে রাখুন যাতে সূর্যের আলো সরাসরি এলসিসির ওপর না পড়ে।
* সকাল ৯-১১টা বা বিকাল ২-৪টার মধ্যে এলসিসি দিয়ে পাতার রঙ মাপা ভালো। 
ধাপ-৪ : ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ
•    কোন জমিতে ১০টির মাঝে ৬ বা ৬টির বেশি এলসিসি মাপক
নম্বর যখনই রোপা ধানে ৩.৫ এবং বোনা ধানে ৩.০ এর কম হবে তখনই ঐ জমিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ কর্বন। 
* ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হলে, প্রতিবার উপরিপ্রয়োগে প্রতি ৩৩ শতক জমিতে আমন মৌসুমে ৭.৫ কেজি ও বোরো মৌসুমে ৯ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ কর্বন। 
ব্যতিক্রম কখনো এলসিসি দিয়ে মাপার পর ইউরিয়অ সার প্রয়োগ করতে না হলে ১০ দিন অপেকজ্‌ষা না করে ৫ দিন পর পুনরায় পাতার রঙ মাপুন। এ ৰেত্রে যদি সার দিতে হয় তবে সার প্রয়োগের তারিখ থেকে একই নিয়মে আবার ১০ দিন পর পাতার রঙ মাপুন।
আগাছা দমন হয় এবং সহজেই চারা রোপণ করা যায়।  চারা রোপণ   চারার বয়স ভালো ফলন পেতে সঠিক বয়সের চারা রোপণ করা জরুরি। সাধারণভাবে রোপা আমনে ২৫ থেকে ৩০ দিন বয়সের চারা রোপণ করা  উত্তম।   
চারা রোপণের নিয়ম
রোপণের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকতে হবে এবং প্রতি গুছিতে ২-৩টি চারা রোপণ করা ভালো। মাটির ২-৩ সেন্টিমিটার গভীরতায় চারা রোপণ করতে হয়। সঠিক গভীরতায় চারা রোপণ করলে চারার বাড়বাড়তি তাড়াতাড়ি শুরু হয় ও কুশির সংখ্যাও বেশি হয়।  চারা রোপণের দূরত্ব লাইন করে চারা রোপণ করলে অনেক সুবিধা। এতে আগাছা দমনের জন্য নিড়ানি যন্ত্র ও গুটি ইউরিয়ার  ব্যবহার করা সহজ হয়। সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করলে প্রত্যেক গাছ সমানভাবে আলো, বাতাস ও সার গ্রহণের সুবিধা পাবে ও ভালো ফলনের নিশ্চয়তাও পাওয়া যায়। রোপা আমনে চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ১৫ সেন্টিমিটার ও সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে  ২০ সেন্টিমিটার।  বিকল্প চারা   বন্যা কিংবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক কারণে ফসল নষ্ট হলে যেসব জায়গায় ধান নষ্ট হয়নি সেখান থেকে কুশি ভেঙ্গে নিয়ে অন্য জায়গায় চারা রোপণ করা যায়। এতে ফলনের ঘাটতি দেখা যায় না। প্রতিটি গোছা থেকে ২-৩টি কুশি রেখে বাকিগুলো আলাদা করে অন্য জায়গায় প্রতি গোছায় দুটি করে রোপণ করলেও ভালো ফলন পাওয়া যায়। পরবর্তীতে সুষম সার প্রয়োগ, সঠিক পরিমাণ সেচ, বিজাত বাছাই ও সঠিক নিয়মে কর্তন, ঝাড়াই, বাছাই, শুকানো হলে ধান অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। আর্থিকভাবে লাভবান হতে হলে আদর্শ বীজতলা তৈরি ও সঠিক নিয়মে চারা রোপণের বিকল্প নেই।

No comments:

Post a Comment