জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি
জ্যৈষ্ঠ মাস গ্রাম বাংলার মধু মাস। এ মাসে মৌসুমি ফল আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ হরেক রকম ফলের সুঘ্রাণ থাকে চারদিকে। একই সাথে পাকা বোরো ধানে শোভা ছড়ায় পলস্নী গ্রামের মাঠে মাঠে। তবে জ্যৈষ্ঠের খরতাপ এবং ঝড়-বাদলের আশঙ্কাও কৃষকদের কখনো কখনো ভাবিয়ে তোলে। তবুও মধু মাসের আনন্দের জোয়ারে ভাসে সবাই। প্রিয় পাঠক, মধু মাসের শুভেচ্ছা জানিয়েই শুরম্ন করছি জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষিতে করণীয় সম্পর্কে। শুরম্নতেই ধান।ধান
বোরো ধান কাটার সময় এখন। বোরো ধান কাটার পর মাড়াই-ঝাড়াই করতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) কর্তৃক উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার করতে পারেন। আপনার জমির ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে তাড়াতাড়ি ধান কেটে ফেলুন। অন্যথায় হঠাৎ ঝড় বা শিলা বৃষ্টির কারণে পাকা ধানের ব্যাপক ড়্গতি হতে পারে। ধান কাটার পর ‘ব্রি ওপেন ড্রাম পাওয়ার থ্রেসার’ যন্ত্র দিয়ে অতি সহজে ধান মাড়াই করতে পারেন। এ যন্ত্র দিয়ে ঘণ্টায় ১০ মণ ধান মাড়াই করা যায় এবং তিনজন শ্রমিক একসঙ্গে কাজ কতে পারে। ‘ব্রিধান-গম পাওয়ার থ্রেসার’-এর সাহায্যেও ধান মাড়াই করা যায়। যা দিয়ে ঘণ্টায় ২৫ মণ ধান মাড়াই করা যায়। এতে দুইজন শ্রমিক একসঙ্গে কাজ করতে পারে। জ্বালানি প্রয়োজন হয় ঘণ্টায় এক লিটার। ধান মাড়াই বা পরিষ্কার করার জন্য আপনি ‘ব্রি পাওয়ার উইনোয়ার’-এর সাহায্য নিতে পারেন। এটি দিয়ে ঘণ্টায় ১২ মণ ধান ঝাড়াই করতে পারবেন যা চালাতে দুইজন শ্রমিক লাগবে। ধান শুকাতে রোদের প্রয়োজন। তবে ‘ইরি-ব্রি ড্রায়ার’ যন্ত্রের সাহায্যে সহজেই ধান শুকানো যায়। শুকানো ধানের আর্দ্রতা ১২% বেশি যেন না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন। শুকনো ধান সতর্কতার সাথে গোলাজাত করম্নন।
নিচু জমিতে বোরো ধান চাষ করে থাকলে সেসব জমির ধান কাটার আগে বা পরে জলি আমন ধানের চাষ করা যেতে পারে। এজন্য জলি আমন অর্থাৎ বোনা আমনের বীজ বোরো ড়্গেতে ছিটিয়ে বুনে দিন। এতে বিনা পরিশ্রমে অতিরিক্ত একটি ফসল পেয়ে যাবেন। কারণ নিচু জমি বর্ষায় ডুবে থাকে বলে অন্য কোনো ফসল চাষ করা যায় না অথচ জলি ধান বর্ষার পানির সাথে পালস্না দিয়ে সমান তালে বাড়ে।
এ সময় আউশ ধানের চারা রোপণ করা যায়। বৃষ্টি হলে জমিতে চাষ দিয়ে আউশের চারা রোপণ করা যায়। বৃষ্টি না হলে জমি তৈরির জন্য সেচ দিয়ে নিন। ড়্গেতের চারার বয়স ১২-১৫ দিন হলে ইউরিয়ার উপরি প্রয়োগ না করে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে পারেন। এতে গুঁড়া ইউরিয়ার চেয়ে চার ভাগের এক ভাগ খরচ কম লাগে। আবার ফলনও হয় বেশি। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের জন্য প্রতি চার গুছির মাঝখানে দু’টি করে গুটি আঙুলের চাপে কাদা মাটিতে পুঁতে দিন। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের পর বেশ কিছু দিন জমির মাটি নাড়াচারা করতে হয় না বলে ২৫-৩০ দিন পর্যনত্ম জমিতে না নামাই ভালো।
জ্যৈষ্ঠ মাসে আউশ ও বোনা আমনের জমিতে পামরি পোকার আক্রমণ হতে পারে। পামরি পোকা ও এর কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ধান গাছের ব্যাপক ড়্গতি করে। পোকার আক্রমণ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে হাতজাল দিয়ে পোকা ধরে মেরে ফেলুন। তাছাড়া আক্রানত্ম গাছের আগা কেটেও এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রমণ ব্যাপক হলে অর্থাৎ প্রতি গুছিতে ৪টি বয়স্ক পোকা বা প্রতি পাতায় ১৫টি কীড়া পাওয়া গেলে অথবা জমির শতকরা ৩৫টি পাতা মারাত্মকভাবে আক্রানত্ম হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করম্নন।
এখন রোপা আমন ধানের বীজতলা তৈরি করার সময়। বীজতলার জন্য উঁচু জমি নির্বাচন করম্নন যেখানে সূর্য়ের আলো পড়ে নিয়মিত। নির্বাচিত জমিতে ভালোভাবে চাষ দিয়ে কাদা কাদা করম্নন। পানির অভাব হলে সেচ দিয়ে নিন। কাদা করা জমিতে মই দিয়ে সমান করম্নন। ১২০ সেমি. বা ৪ ফুট চওড়া এবং জমির আকার অনুযায়ী লম্বা করে বীজতলার বেড তৈরি করে নিন।
প্রয়োজনীয় পরিচর্যার জন্য বেডের চারপাশে ৪৫ সে.মি. বা দেড়ফুট চওড়া নালা রাখা দরকার। জমির উর্বরতা বাড়াতে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি জৈব সার জমি তৈরির সময় দেয়া যেতে পারে। বীজ বোনার আগে বীজতলায় ছাই ছিটিয়ে দিলে চারা তোলার সময় কোনো অসুবিধা হয় না। এবার জানিয়ে দিই রোপা আমনের উন্নত কয়েকটি জাতের নাম। এগুলো হলো- বিআর-৩, বিআর-৪, বিআর-৫ বিআর-১০, বিআর-২২, বিআর-২৩, বিআর-২৫, ব্রিধান-৩০ ব্রিধান-৩১, ব্রিধান-৩২, ব্রিধান-৩৩, ব্রিধান-৩৪, ব্রিধান-৩৭, ব্রিধান-৩৮, ব্রিধান-৩৯, ব্রিধান-৪০, ব্রিধান-৪১, বিনাশাইল ইত্যাদি।
পাট
পাটের জমিতে এ সময় আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তাছাড়া জমিতে চারা ঘন হলে সুস্থ ও সবল চারা রেখে অন্যান্য চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে। বৃষ্টির কারণে পাট ড়্গেতে পানি জমে গেলে পানি বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করম্নন। ফাল্গুনী তোষা পাটের বয়স দেড় মাস হলে হেক্টরপ্রতি ১০০ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করম্নন। এ মাসে পাটে বিছা পোকা ও ঘোড়া পোকার আক্রমণ হতে পারে। এরা গাছের পাতা ও ডগা খেয়ে পাট গাছের যথেষ্ট ড়্গতি করে থাকে। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে ডিমের গাদা এবং ছোট কীড়ার দলা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে। পাট ড়্গেতে বাঁশ বা গাছের ডাল পুঁতে পাখি বসার সুযোগ করে দিলে পাখি পোকা খেয়ে ফেলবে। এতে পোকার আক্রমণ কমবে। আক্রমণ খুব তীব্র হলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করম্নন।
শাকসবজি
এখন গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির পরিচর্যা করা বিশেষ জরম্নরি। সতর্কতার সাথে শাকসবজির জমিতে সারের উপরিপ্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া, লতাজাতীয় সবজির মাচা তুলে দেয়ার কাজ করতে হবে নিয়মিত। লতা জাতীয় সবজির বাড়-বাড়তি বেশি হলে কিছুু কিছু লতা বা পাতা কেটে ছাঁটাই করে দেয়া দরকার। এতে তাড়াতাড়ি এবং বেশি বেশি ফল ধরবে। শাকসবজির রোগ ও পোকা দমনের জন্য অনেক সময়ই বালাইনাশক প্রয়োগের পয়োজন হয়। এ ড়্গেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, যেসব বালাইনাশকের বিষের প্রভাব ৩-৪ দিনের বেশি থাকে সেসব বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে না। কুমড়া জাতীয় সবজির ড়্গেত্রে অধিক ফলন পেতে কৃত্রিম পরাগায়ন করম্নন নিয়মিত।
অন্যান্য ফসল
০ এ সময় আদা ও হলুদ চাষ করা যেতে পারে।
০ গ্রীষ্মকালীন মুগডাল চাষ করতে পারেন এখন।
০ সবুজ সার ফসলের বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে জমিতে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিন। সবুজ সার ফসল এর আগে চাষ না করে থাকলে ধৈঞ্চা, শনপাট বা ডালজাতীয় ফসলের বীজ বুনে দিন।
০ লতিরাজ বা অন্য কোনো ভালো জাতের কচুর চাষ করতে পারেন এখন।
গাছপালা
গাছপালায় বছরে দু’বার সার প্রয়োগ করতে হয়। বর্ষার আগে একবার এবং বর্ষার পরে একবার। বর্ষার আগে এখনো গাছের গোড়ায় সার প্রয়োগ না করে থাকলে দ্রম্নত সার প্রয়োগের ব্যবস্থা নিন। গাছের গোড়ার চারদিকের মাটি ভালো করে কুপিয়ে পরিমাণমতো জৈব ও রাসায়নিক সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিন। নতুন করে বনজ, ওষুধি বা ফল গাছের চারা রোপণ করতে চাইলে নির্ধারিত স্থানে গর্ত করে জৈব ও রাসায়নিক সার দিয়ে গর্ত ভরাট করে রাখুন। ৭-১০ দিন পর চারা রোপণের কাজ শুরম্ন করম্নন।
পশু-পাখি পালন
বর্ষার আগে গবাদিপশুর গোয়াল ঘর সংস্কার করম্নন এবং ঘরের আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করম্নন। বর্ষায় যাতে পশু-খাদ্যের সংকট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। প্রয়োজনে পশুর খাদ্য সংরড়্গণ করম্নন। বর্ষার আগে অবশ্যই গরম্ন বাছুরের টিকা দেয়া উচিত। আপনার গরম্ন-বাছুরকে নিয়মিত গোসল করান এবং ঠান্ডা স্থানে রাখুন। হাঁস-মুরগির ড়্গেত্রেও নিয়মিত ভ্যাঙিন দিয়ে নিন এবং সুষম খাদ্য পরিবেশন করম্নন। উপজেলা পশুসম্পদ অফিসে গিয়ে যে কোনো বিষয়ে জেনে নিন।
মাছ
মাছ চাষের জন্য যারা হ্যাচারি করেছেন এবং ডিম থেকে পোনা করবেন তারা এ সময় বিশেষ সতর্ক থাকুন। কারণ এ সময় মাছের প্রজননের সময়। আঁতুর পুকুরের পোনা আঙুলের সমান লম্বা হলে চারা পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিন। বর্ষার আগে পুকুর পাড়ের সংস্কার করে নিন। প্রয়োজনে উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে পরামর্শ নিন।
প্রিয় পাঠক, জ্যৈষ্ঠের আনন্দঘন মধুমাসে আপনার ঘরে যেমন আম- কাঁঠাল খাওয়ার ধুম লাগে তেমনি মাঠে মাঠে থাকে কৃষি কাজের ব্যসত্মতা। এ ব্যসত্মতা ফসলকে ঘিরে, গৃহপালিত পশু-পাখি ও মাছ চাষকে ঘিরে। কৃষি কাজের নানান বিষয় সম্পর্কে বিসত্মারিত জানতে যোগাযোগ করম্নন আপনার পাশের কৃষিকর্মীর সাথে। সকলের ব্যসত্ম সময়ে লাগুক মধুমাসের আনন্দের পরশ। এ কামনায় শেষ করছি জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি। আলস্নাহ হাফেজ।য় (সংকলিত)
No comments:
Post a Comment