Wednesday, 25 May 2011

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও ক্ষতিকারক বিদেশী প্রজাতি

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও ক্ষতিকারক বিদেশী প্রজাতি
বিদেশী প্রজাতি হচ্ছে- উদ্ভিদ বা প্রাণির কোনো প্রজাতি যা তার স্বাভাবিক বিসত্মারের বাইরে উপস্থিতি বা বিসত্মার ঘটায় তখন ঐ নতুন স্থানে ঐ প্রজাতিকে বিদেশী প্রজাতি হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ কোনো প্রজাতি সাধারণত মানুষের হস্তক্ষেপ ব্যতীত স্থানান্তর অথবা অনুপ্রবেশ ঘটাতে পারে না। কারণ প্রজাতি বা জীবাণুর এ ড়্গেত্রে কোনো না কোনো প্রকার ভৌতিক বাধা অতিক্রম করার প্রয়োজন হয়। পরিবেশতন্ত্রে একে “পথের বাধা” হিসেবে অভিহিত করা হয়।

বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও পরিবেশ বিদেশী ড়্গতিকারক এ বালাইয়ের প্রজাতি সহজেই বিস্তার লাভের অত্যনত্ম উপযোগী। ভৌগোলিক অবস্থান এবং জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশকে উদ্ভিদকুল ও প্রাণিকুলের স্থানানত্মর  গমন জোন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

বিদেশী প্রজাতির আগমন

ক্রমাগতভাবে পর্যটক ও আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য বিদেশী প্রজাতির আগমন এ দেশে ঘটেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকার যানবাহন, পাত্র, প্যাকেজিং দ্রব্য, জাহাজের বর্জ্য এবং কৃষি বীজ ও অন্যান্য জীবাণুঘটিত পণ্যের মাধ্যমে বিদেশী প্রজাতির আগমন ঘটে। ভারত হতে বন্যার পানির সাথে অনেক ড়্গতিকারক প্রজাতির যত্রতত্র আগমন ঘটে এবং পরবর্তীতে জলাভূমি এলাকায় জীবাণুঘটিত বিস্ফোরণ ঘটায়। দুর্ভাগ্যজনক যে, এ দেশের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের জরিপ অথবা খারাপ দিক বিবেচনা না করে শুধু প্রজাতির দ্রম্নত বর্ধন ও বেশি ফলন দেয়ার ড়্গমতা বিবেচনা করে সরকারিভাবে বিদেশী প্রজাতির আমদানির জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। এর প্রধান কারণ দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করা। অপরদিকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে বিদেশী প্রজাতি আনার ড়্গেত্রে সংগনিরোধ ব্যবস্থাও অত্যনত্ম দুর্বল, ফলে বিদেশী প্রজাতির যথাযথ দলিলপত্র ছাড়াই অতি সহজেই দেশে বিদেশী প্রজাতির প্রবেশ ঘটেছে।

বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশে বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, উদ্ভিদ ও আগাছার আগমন বা অনুপ্রবেশ বেশি ঘটেছে। নিম্নে বিদেশী প্রজাতির মাছ, পোকা, উদ্ভিদ ও আগাছা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ক্ষতিকারক বিদেশী মাছের প্রজাতি

বর্তমানে প্রাণিকুলের মধ্যে বিদেশী মাছের বেশি অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৫ প্রকার বিদেশী মাছ আনা হয়েছে,  যাদের অধিকাংশ রম্নই-কাতলা মাছ। এসব মাছ আনার মূল উদ্দেশ্য ছিল মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। এসব প্রজাতির অধিকাংশ মাছ এশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে আনা হয়েছে। এ আমদানিকৃত মাছের দ্বারা দেশীয় মাছের ও পরিবেশের ওপর কি প্রভাব পড়ে সে বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণা করা হয়নি।

কিছুসংখ্যক বিদেশী মাছ স্থানীয় মাছের সাথে খাদ্যের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয় এবং পরবর্তীতে দেশী মাছের  ড়্গতিকারক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এরা পরভোজী স্বভাবের তাই দেশী মাছ ও অন্যান্য প্রাণিদের ধরে খেয়ে ফেলে। তেলাপিয়া ও নাইলটিকা মাছ পরভোজী নহে। এদের প্রাকৃতিকভাবেই বংশবিসত্মার ক্ষমতা ও বৃদ্ধির পরিমাণ অত্যনত্ম দ্রম্নত ও বেশি। অপরদিকে ভারত হতে বিভিন্ন প্রকার ড়্গতিকারক মাছের প্রজাতি বাংলাদেশে বন্যার পানির সাথে যত্রতত্র আগমন ঘটেছে এবং জলাশয়ে ব্যাপক বিসত্মার ঘটেছে। বাংলাদেশে কোনো কোনো বিদেশী প্রজাতির মাছের চাষ শুধু সংরড়্গিত পুকুরে চাষাবাদের সুপারিশ থাকলেও বন্যার কারণে সে শর্ত র
ক্ষা করা সম্ভব হয়নি এবং সংরড়্গিত পুকুরে উক্ত মাছ রাখতে পারা যায়নি। আফ্রিকান মাগুর ও পাংগাস প্রজাতির মাছ দেশী মাছের সাথে হংসশাবক, শামুক এমনকি পাখি পর্যনত্ম খেয়ে ফেলছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, তেলাপিয়া ও নাইলটিকা মাছ দেশী মাছের খাদ্যে ভাগ বসাচ্ছে এবং তাদের বাসস্থান ক্রমশ দখল করে ফেলছে। এদ্বারা সহজেই অনুমেয় যে, বিদেশী মাছের প্রজাতি দেশী বা স্থানীয় মাছের ওপর কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পেরেছে।
মাছের রোগ
 দেশে ক্ষত রোগের কারণে জলাশয়ে অনেক মাছের মৃত্যু ঘটে থাকে। ১৯৯১ সনে এক প্রতিবেদনে দেখা যায়  ড়্গত রোগে সারাদেশে স্থানীয় বিভিন্ন মাছের ব্যাপক আক্রমণ ও মৃত্যু ঘটেছিল। কোনো বিদেশী মাছের প্রজাতি দেশে আমদানি অথবা চাষাবাদের অনুমতি দেয়ার পূর্বে রোগ ও স্থানীয় মাছের ওপর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব যাচাই করা প্রয়োজন। অন্যথায় স্থানীয় মাছের প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

বিদেশী
ক্ষতিকারক পোকার প্রজাতি

বাংলাদেশে স্পাইরালিং সাদামাছি অনেক শোভাবর্ধনকারী গাছের একটি
ক্ষতিকারক বালাই। এ পোকা আম গাছের পাতার ড়্গতি করে থাকে। বাংলাদেশে অন্যান্য বিদেশী ক্ষতিকারক পোকার উপস্থিতি অথবা আগমনের প্রকাশিত তথ্য অথবা গবেষণা তথ্য নেই। দেশের জীববৈচিত্র্য রড়্গার লক্ষ্যে বাংলাদেশে বিদেশী  ক্ষতিকারক পোকার প্রজাতির মর্যাদা, পরিবেশে প্রভাব প্রভৃতি বিষয়ে সমীড়্গা বা গবেষণা পরিচালনা করার প্রয়োজন রয়েছে।

বিদেশী ক্ষতিকারক উদ্ভিদ

উদ্ভিদ জগতের দুটি গণের একাশিয়া এবং ইউক্যালিপটাসের বিভিন্ন প্রজাতির বাংলাদেশে প্রবেশ ঘটেছে। অধিকাংশ প্রজাতি আশির দশকের দিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে। এসব প্রজাতি বাংলাদেশের স্থানীয় উদ্ভিদকুলের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দেখা দিয়েছে। একাশিয়া ও ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা সহজে পচনশীল নয় বিধায় হাজার হাজার হিউমাস নির্ভরশীল প্রজাতি যেমন ওষুধি গাছ এবং কেঁচোসমূহ আশঙ্কাজনক অবস্থায় পড়েছে। এসব উদ্ভিদ মাটি থেকে বিপুল পরিমাণ রস ও পুষ্টি অতিদ্রম্নত আহরণ করে থাকে। ফলে এদের চারপাশে দেশী উদ্ভিদ ভালোভাবে জন্মাতে অথবা বৃদ্ধি পেতে পারে না। কিছু কিছু ইউক্যালিপটাস প্রজাতির গাছ অত্যধিক পরিমাণে পানি শোষণের মাধ্যমে  জলাভূমিকে পানি শূন্য করে ফেলে। পাখিরা ইউক্যালিপটাস গাছকে পছন্দ করে না। এসব উদ্ভিদ বন্য প্রাণীদের সাহায্য বা উপকারে আসে না, কারণ খাওয়ার উপযোগী ফল ও মধু তৈরি করতে পারে না। এসব প্রজাতির দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশ প্রাণহীন ও মরুভূমির মতো হয়ে থাকে। লম্বা ও সরম্ন ডালপালার কারণে এসব গাছ ঝড় প্রতিরোধক নহে এবং ঝড়ের সময় অন্যান্য প্রাণির আশ্রয় দিতে পারে না।
ক্ষতিকারক বিদেশী আগাছা

বাংলাদেশে বিদেশী প্রজাতির আগাছা আগমনের একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ব্রিটিশ আমলে ব্রাজিল থেকে প্রথম ড়্গতিকারক বিদেশী প্রজাতির যে আগাছাটি বাংলাদেশে এসেছিল সেটি হচ্ছে কচুরিপানা। ব্রিটিশ মহিলারা কচুরিপানার ফুল খুব পছন্দ করতেন এবং চুলের ফ্যাশন এবং শোভাবর্ধনের কাজে ব্যবহার করতেন। ওই সময়ে কচুরিপানার এত দ্রম্নত বর্ধন ড়্গমতা ও জলজ আগাছা হিসেবে দেখা দিতে পারে এ বিষয়ে কেহ কোনো চিনত্মা বা ধারণা পোষণ করেননি। বর্তমানে বাংলাদেশের জলাভূমির সর্বত্রই কচুরিপানায় ভরপুর হয়ে গেছে তবে কচুরিপানা, কম্পোস্ট সার তৈরি, মাটির রস সংরড়্গণে জাবড়া দেয়া, পাট জাগ দেয়া, নবনির্মিত দালান কিংবা সিমেন্টের ঢালাই ও  রাস্তায় জাবড়া হিসেবে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেক আগাছা নদীপথে অথবা বন্যার সময় ভারত থেকে এ দেশে আগমন ঘটেছে। বিদেশ থেকে এ দেশে আগত আগাছার প্রভাব ও স্থানীয় পরিবেশে পরিবর্তন বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণা তথ্য নেই। ফসলের জমিতে আগাছা দমনের বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এদের দমনের জন্য বর্তমানে অনেকগুলো আগাছানাশকও ব্যবহার হচ্ছে।

উপসংহার

* ইনভেসিভ এলিয়েন প্রজাতির বিষয়টি বাংলাদেশের জাতীয় ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করা প্রয়োজন। এখনই জাতীয়ভাবে  কার্যকর পদড়্গেপ গ্রহণ করতে হবে। কোনো পদ
ক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে অর্থনৈতিক এবং বর্তমানের পরিবেশতন্ত্রের ব্যাপক ক্ষতি এবং সমৃদ্ধশালী জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
* বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইনভেসিভ এলিয়েন প্রজাতির অবস্থা ও প্রভাবের সমীড়্গা চালানো ও তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
* বন, কৃষি ও মৎস্যের  কোনো প্রজাতি দেশে আনার ড়্গেত্রে ঐ প্রজাতির বিসত্মারিত ইতিহাস, ভবিষ্যতে পরিবেশতন্ত্রে
ক্ষতিকর সম্ভাব্য প্রভাব এবং অর্থনৈতিক লাভের বিষয়গুলো যথাযথভাবে যাচাই করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
* সংগনিরোধ আইনের প্রয়োগ আরো জোরদার করা প্রয়োজন বিশেষ করে কৃষিপণ্য আমদানি, রপ্তানি ও হাতে বহনকারী বিদেশী শোভাবর্ধনকারী প্রজাতি আনার
ক্ষেত্রে। এ ছাড়া বিদেশী জাহাজে বহনকারী পাত্র ও অন্যান্য জিনিস পরীড়্গা-নিরীড়্গার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
* সর্বস্তরের জনগণকে বিদেশী প্রজাতির ভালো ও খারাপ দিক বিষয়ে গণমাধ্যমের দ্বারা সচেতন করা যেতে পারে।

No comments:

Post a Comment