গরুর ক্ষুরারোগ ও তার প্রতিকার
আমাদের দেশে কৃষি কাজের পাশাপাশি গর্ব পালন একটি অতি পরিচিত দৃশ্য। অনেকেই শুধু গরু পালনের দ্বারাই জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু এই গরু পালনের ৰেত্রে মূল সমস্যা হলো প্রাণীর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া। যেসব রোগ গবাদিপশুর ৰেত্রে দেখা যায় তার মধ্যে ক্ষুরারোগটি সব থেকে মারাত্মক। এ রোগটি ভাইরাসঘটিত। দ্বি-খ-িত ক্ষুর আছে এমন যেকোনো প্রাণীর দ্বারাই এ রোগটি সংক্রমিত হতে পারে। মানুষ ও পশুর চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ যাবৎ আবিষ্কৃত রোগের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এই রোগের ভাইরাস আক্রান্ত পশু হতে চলিৱশ মাইল দূরবর্তী তার টার্গেটে পশুকে আক্রান্ত করতে পারে। এ রোগে বড় গর্বর মৃত্যুর হার কম হলেও বাছুরের ৰেত্রে মৃত্যুর হার শতকরা ৭০ ভাগ পর্যন্ত দেখা গেছে। সবচেয়ে বড় কথা সঙ্কর জাতের গর্বতে এ রোগের সংক্রমণ অত্যন্ত বেশি। যা এ খাতে বিনিয়োগ ও জাত উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে দার্বণভাবে ব্যাহত করছে। আমাদের দেশে ৰুরারোগ চার রকমের ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে।
সব ঋতুতে দেখা গেলেও শীত ও বর্ষা ঋতুতে ৰুরারোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। যে কোনো বয়সের গর্বর দেহে রোগটি সংক্রমিত হলেও বাছুরের দেহে রোগটি সংক্রমণ হলে বাছুরটি মারা যেতে পারে। গর্বর শরীরে এই ভাইরাস প্রবেশ করার ২-৮ দিনের মাথায় এ রোগের লৰণ দেখা যায়। এ রোগ হলে যেসব লৰণ দেখা যায় তা হলো-
* গরুর শরীরে প্রচ- জ্বর হয়। দেহের তাপমাত্রা ১০৬ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে।
* আক্রান্ত পশুর মুখ ও নাক দিয়ে লালা ঝরতে থাকে এবং তা দড়ির মতো ঝুলতে থাকে।
* গর্ব নির্জীব হয়ে যায় এবং কোনো কিছু খেতে চায় না।
* দুধ দেয়া গর্ব হলে দুধের পরিমাণ কমে যায়।
* মুখের ভেতর ছোট ছোট পানি ফোস্কা পড়ে। এ ফোস্কাগুলো পরবর্তীতে মিশে গিয়ে বড় ধরনের ৰতের বা ঘায়ের সৃষ্টি করে।
* পানির মতো ফোস্কাগুলো ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফেটে যায়। ফেটে লাল দগ দগে ঘা হয় এবং জিহ্বার ওপরের চামড়া উঠে যায়।
* গর্ব খোঁড়াতে শুর্ব করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে ক্ষুর ও চামড়ার সংযোগ স্থলে পানি ফোস্কা ঘা হয়। মনে হয় ক্ষুরটা খসে পড়েছে। গর্বর পায়ের ক্ষুরগুলো অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে যায়। তখন দেখা যায় গর্ব ঠিকভাবে হাঁটতে পারে না।
* দুধ দেওয়া গাভী আক্রান্ত হলে গাভীর বাঁটের ওপরে বা পাশে ছোট ছোট পানি ফোস্কা পড়ে। তার পরে ঠুনকো রোগ হয় এবং বাঁট থেকে দুধ বের হয়ে আসে।
* সপ্তাহখানেক পর্যন্ত গর্ব কিছু খাবার খেতে পারে না। শরীরের ওজন কমে যায়।
* দুধালো গাভীর দুধ দেয়ার ৰমতা কমে যায়। য় গর্ভবতী গাভী এ রোগে আক্রান্ত হলে অনেক সময় বাচ্চা গর্ভপাতের ফলে নষ্ট হয়ে যায়।
* হালের বলদ আক্রান্ত হলে গর্বর কার্য ৰমতা কমে যায়।
* গায়ের লোমগুলো অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে যায়। এ রোগের বিস্তার বা সংক্রমণ এক পশু থেকে অন্য পশুতে যেভাবে হয়ে থাকে তা হলো-
এ রোগে আক্রান্ত পশুর মুখ দিয়ে প্রচণ্ড লালা ঝরে। লালার সাথে এ রোগের ভাইরাস বেরিয়ে আসে। এ লালা যেখানে পড়ে সেখানে ধূলিকণার সাথে মিশে বাতাসে উড়ে বেড়ায় ও বাতাসের গতি যে দিকে থাকে সেদিকে সংক্রমিত হতে থাকে।
* আক্রান্ত প্রাণীর সাথে সুস্থ প্রাণী রাখলে বা সংস্পর্শে আসলে সুস্থ প্রাণীটিও আক্রান্ত হয়।
* আক্রান্ত প্রাণীর যারা সেবা বা দেখা শোনা করেন তাদের মাধ্যমেও এ রোগটি ছড়ায়।
* রোগাক্রান্ত মৃত প্রাণী যেখানে সেখানে ফেলে দিলে মৃত প্রাণীর দেহ মাটির সাথে মিশে গিয়েও রোগটি ছড়িয়ে থাকে।
* আক্রান্ত গাভীর দুধ যখন তার বাছুর খায় তখন দুধের মাধ্যমে বাছুরে রোগটি সংক্রমিত হয়। ক্ষুরারোগের চিকিৎসা সম্বন্ধে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যা এ রোগে আক্রান্ত পশুর জন্য মারাত্মক ৰতিকর। এমন কি এর জন্য অনেক আক্রান্ত পশু সহজেই মারা যায়। ভ্রান্ত ধারণাগুলো হলো-
* এ রোগে আক্রান্ত হলে গর্বকে কাদায় দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে।
* অনেক সময় গর্বর গলায় মাদুলি জুলিয়ে রাখলে এ রোগ সেরে যাবে।
* মনে করা হয় খারাপ বাতাস লেগে এ রোগ হয়।
* এ রোগ হলে গোয়ালে ধোঁয়া দিলে রোগ সেরে যায়। সুতরাং ক্ষুরারোগে আক্রান্ত হলে ওপরে বর্ণিত কাজগুলো কোনোভাবেই করা যাবে না এবং আশপাশের কেউ যাতে না করে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিরোধমূলক কিছু ব্যবস্থা বা পদৰেপ নিলে এ রোগটি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে। প্রতিরোধকমূলক ব্যবস্থাগুলো হলো-
* গর্বকে নিয়মিত টিকা দিতে হবে।
* বাছুরের বয়স যখন চার মাস হবে তখন তাকে ক্ষুরারোগের প্রথম টিকা দিতে হবে। তারপর ৬ মাস পরপর নিয়মিতভাবে টিকা দিতে হবে।
* গর্ভবতী গর্বকে টিকা দেয়ার ৰেত্রে মনে রাখতে হবে যে, ৬ মাস গর্ভকালীন অবস্থায় থাকা পর্যন্ত টিকা দেয়া যায়।
* এ রোগ যদি কোনো গ্রামে বা গোয়ালে হয় তবে অসুস্থ গর্বগুলোকে আলাদা করে রাখতে হবে।
* এ রোগে আক্রান্ত গর্বর খাবারের পাত্রগুলো সুস্থ গর্বর জন্য যাতে ব্যবহার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
* অসুস্থ গর্বর যিনি সেবা করেন তিনি যেন সুস্থ গর্বর কাছে না যান।
* অসুস্থ গর্ব যেন হাটে কেনাবেচা না হয় তার জন্য স্থানীয়ভাবে পদৰেপ নিতে হবে। এ রোগটিতে গর্ব আক্রান্ত হলে প্রতিকার হিসেবে যে কাজগুলো আমাদের করতে হবে তা হলো-
* যে খামারে যখন এ রোগটি শুর্ব হয়ে যায় তখন কাপড় কাচা সোডার ৪% জলীয় দ্রবণ তৈরি করে গোয়াল ঘরে ছিটাতে হবে। তাহলে এ রোগের ভাইরাস ২ মিনিটের মধ্যে মরে যাবে।
* সোহাগা গরম কড়াইয়ে ভেজে নিয়ে তারপর পাটায় বেটে নিতে হবে। এরপর মধু দিয়ে অথবা ৮ গ্রাম সোহাগায় ২০ মিলিলিটার গিৱসারিন এবং ৪৮০ মিলিলিটার পানি মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করে গর্বর মুখে দিনে ৩-৪ বার মাখাতে হবে।
* পায়ের ঘায়ের জন্য ১ লিটার পানিতে ১ গ্রাম পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট মিশিয়ে পানি দিয়ে গর্বর ক্ষুর ভালো করে দুয়ে নরম কাপড় দিয়ে মুছে দিয়ে মাছি নিয়ন্ত্রক মলম লাগিয়ে দিলে ঘা তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।
* মুখ, পা পরিষ্কার করার পর সালফার পাউডার লাগাতে হবে।
* ভাতের মাড়, ধানের কুঁড়া, খুদের ভাত এবং বিভিন্ন রকমের সুষম খাবার আক্রান্ত গর্বকে খেতে দিতে হবে। খাবারের সাথে খনিজ লবণ, ভিটামিন মিশিয়ে খাওয়াতে হবে এতে অসুস্থ প্রাণীর শরীরের স্বাস্থ্যহানি দূর হয়। য় ঘা যদি বেশি হয় তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গর্বর প্রতি কেজি ওজনের জন্য পেনিসিলিন ইনজেকশন প্রয়োগ করতে হবে। য় দ্বিতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ দূর করার জন্য ডায়াডিন/ভেসাডিন/স্ট্রেপ্টোপেনএসব অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে হবে।
* এ ছাড়াও বিভিন্ন বেদনানাশক হিসেবে প্যারাসিটামল ইনজেকশান দেয়া যেতে পারে। ক্ষুরারোগ আমাদের দেশের গবাদি পশুপালনের ৰেত্রে বড় ধরনের অন্তরায়। তবে আমাদের সচেতনতাই পারে এ ধরনের সমস্যা থেকে রেহাই দিতে।
No comments:
Post a Comment